‘জগৎজ্যোতিকে বীরশ্রেষ্ঠ পদক প্রদান করা উচিত’

অপূর্ব শর্মা পেশাগত জীবনে সাংবাদিক। আর সাংবাদিকত বলেই তিনি অনুষন্ধিষ্ণু। তার এই অনুসন্ধানেই একদিন খুঁজ মেলে মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য বীর জগৎজ্যোতি দাসের। দীর্ঘ ও শ্রমসাধ্য গবেষনার মাধ্যমে তিনি তুলে আনেন এই ভাটির বীরের বিস্মৃতপ্রায় অমর বীরত্বগাঁথা।

এবারের বইমেলায় যা মলাট বন্ধি হয়েছে অন্যন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতিনামে। প্রায় হারিয়ে যাওয়া জগৎজ্যেতিকে নিয়ে গবেষনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে নিউজ-বাংলার প্রতিনিধি চৌধুরী ভাস্কর হোমের সাথে কথা হয় বইটির লেখক অপূর্ব শর্মার।

নিউজ বাংলা: মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষনা কিংবা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষনা গ্রন্থগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে বিষয় ভিত্তিক কাজ হয়েছে। যেমন- গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মুক্তিযুদ্ধে নারী প্রভৃতি। আপনি নির্দিষ্ট কোন বিষয় বাদ দিয়ে ব্যাক্তিকে নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হলেন কেন?

অপূর্ব শর্মা : জগৎজ্যোতির দুঃসাহসিক বীরত্ব, গেরিলা যুদ্ধের একান্ত নিজস্ব পরিকল্পনা, আত্মোৎসর্গ এবং সর্বপোরি তাঁর বঞ্চনার কাহিনী আমাকে জগৎজ্যোতির প্রতি বলতে গেলে মোহাবিষ্ট করে তুলেছিল। তাছাড়া প্রথম সর্বোচ্চ খেতাবের ঘোষণা ও তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত নানা কিংবদন্তি আমাকে আকৃষ্ট করেছে। আমার মনে হয়েছে জগৎজ্যোতির কাহিনী সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের একটা বিশাল পার্টকেই তুলে ধরা হবে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধের সময় কেবল দুইটি কমান্ডই  দেশের ভেতরে থেকে গেরিলা যুদ্ধ করেছে। বাকীরা যুদ্ধ করেছে সীমান্ত এলাকা থেকে। এই দুইটি কমান্ডের একটির কমান্ডার ছিলেন জগৎজ্যোতি। ফলে জগৎজ্যোতি তো নিজের বীরত্বের মাধ্যমে ব্যক্তি  থেকে বিষয়ে পরিণত হয়েছেন।

নিউজ বাংলা: জগৎজ্যোতিকে তো তাঁর সহযোদ্ধাদের অনেকেই ভুলে গেছেন। নতুন প্রজন্ম তাঁর নামই জানেন না। আপনিও তো ৭১র পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধি। জগৎজ্যোতিকে আপনি কি করে খুঁজে  পেলেন?

অপূর্ব শর্মা : ছোটবেলা থেকেই আমার বই পড়ার সখ। তার মধ্যে ইতিহাস ভিত্তিক বইয়ের প্রতিই আগ্রহ ছিলো বেশি। মূলতঃ মুক্তিযুদ্ধের বই পড়তে গিয়েই জগৎজ্যোতি ও তার দাস পার্টির বীরত্বের কথা আমি  জেনেছি। অনেক মুক্তিযুদ্ধার কাছেও তাঁর প্রশংসা ও বঞ্চনার কথা শুনেছি। বিভিন্ন প্রত্রিকায়ও জগৎজ্যোতি সম্পর্কে আর্টিকেল ছাপা হয়েছে। মূলতঃ এভাবেই আমার জগৎজ্যোতিকে জানা।

নিউজ বাংলা: জগৎজ্যোতিকে নিয়ে গবেষণা ও বই করার পরিকল্পনাটা কবে থেকে নেয়া এবং শ্রমসাধ্য কাজটা কি করে সম্ভব হলো?

অপূর্ব শর্মা : জগৎজ্যোতিকে নিয়ে কিছু একটা করার পরিকল্পনা বেশ আগে থেকেই ছিলো; তবে সাংবাদিকতা জীবনের নিত্যকার ব্যস্ততার কারনে তা সম্ভব হচ্ছিলো না। গত দুইবছর থেকে আমি এ নিয়ে গবেষণা চালাই। জগৎজ্যোতির বাড়িতে কেউ না থাকায় এবং উত্তরসূরীরা কোথায় আছেন সে সম্পর্কে কেউ না জানায় তথ্য খঁজে পেতে অনেক দূর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তারপর পরিবারের যখন  খোঁজ পাওয়া গেলো তারা কেবল তার জীবনবৃত্তান্তটাই বলতে পারলেন। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা ও সেসময় তাঁর অপারেশনগুলোর কাহিনী জানতে খুঁজে বের করতে হলো তাঁর সহযোদ্ধাদের। এব্যাপারে জগৎজ্যোতির সহযোদ্ধা জনাব ইলিয়াস অনেক সহযোগীতা করেছেন। সালেহ চৌধুরীসহ আরো অনেকের সহযোগীতায় কাজটা শেষ করতে পেরেছি।

নিউজ বাংলা: দেশে এখন আবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জোরালা হয়েছে। সরকারও এ ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছে। আপনার বইটিতে রাজাকাদের বিভিন্ন বিভৎস কর্মকাণ্ড ও নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন। তো আপনি কী এইসব রাজাকারদের নাম পরিচয় এবং তাদের ধ্বংসযজ্ঞের নির্দিষ্ট করে কিছু খুঁজে পেয়েছেন যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পক্রিয়ায় তথ্য-উপাত্ত হিসেবে কাজে আসতে পারে?

অপূর্ব শর্মা : এ ব্যাপারে আমি নতুন আরেকটি কাজ শুরু করেছি। সিলেটে অঞ্চলের রাজাকার ও তাদের  সেই সময়ের দুবৃত্তয়ান নিয়ে আরো বর্ধিত কলেবরে একটি বই করার ইচ্ছে রয়েছে আমার।

নিউজ বাংলা: কেনো ঘোষণা দিয়ে জগৎজ্যোতিকে মরনোত্তর সর্বোচ্চ খেতাব দেয়া হলো না, আপনি কি মনে করেন?

অপূর্ব শর্মা : আসলে আমি তো মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধি। ওই সময়ের ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে আমরা যা জানি তা তো বই, পত্রিকা পড়ে এবং গল্প শুনে। এইসব সূত্র থেকেই আমি যতদূর জেনেছি, নিয়মিত বাহিনীর বাইরের লোক হওয়ায় তাকে এই সম্মান দেয়া হয় নি। যাদেরকে বীরশ্রেষ্ঠ পদক দেয়া হয়েছে তারা কিন্তু প্রত্যেকেই কোন না কোন বাহিনীর সৈনিক ছিলেন।

নিউজ বাংলা: আপনি কী মনে করেন সরকারের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ি জগৎজ্যোতিকে বীরশ্রেষ্ঠ পদক প্রদান করা উচিত?

অপূর্ব শর্মা : অবশ্যই দেয়া উচিত। এখন যেহেতু আলীগ সরকার ক্ষমতায় রয়েছে তাই তাদের একটা বিরল সুযোগ এসেছে নিজেদের দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার। আমার মনে হয়, সকল সংকীর্নতার উর্ধে উঠে জগৎজ্যোতিকে বীরশ্রেষ্ঠ পদক প্রদান করা হলে সরকারের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে।

নিউজ বাংলা: আপনাকে ধন্যবাদ।

অপূর্ব শর্মা : আপনাকেও।

নিউজ-বাংলা ডটকম, প্রকাশকাল ২২ মার্চ ২০০৯