মুক্তিযুদ্ধ আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন
সত্যের সাধনায় যারা অবিরত ছুটে চলেন কোন মোহ তাঁদের আবিষ্ট করে না লালসা তাড়িত করে না, সকল দুর্দশা, প্রতিবন্ধতাকে উপেক্ষা করে তাঁরা ছুটে চলেন অবিরত। একটি জাতির সঠিক বিকাশের পথে অন্যতম হাতিয়ার হলো সেই জাতির প্রকৃত ইতিহাস যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা। এরকম সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় রত নিরলস নিষ্ঠাবান অনন্য এক সত্যসন্ধানীর নাম অপূর্ব শর্মা।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের নাম না জানা অজানা প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের ও বীরাঙ্গনাদের অসামান্য আত্মত্যাগের ইতিহাস সঠিকভাবে সংরক্ষণের প্রয়াসে একনিষ্ঠভাবে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। প্রকৃতদেশপ্রেম ও দেশগড়ার আদর্শে ও বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতি তার প্রগাঢ় ভালোবাসা আর নতুন প্রজন্মের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে তথ্য আহরণের নিরিখে সকল ক্লান্তি, বাঁধা উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে ছুটে চলেছেন পথে প্রান্তরে।
শুধুমাত্র খেয়ে পরে বেঁচে থাকার গতানুগতিক চক্রে তিনি জীবনের উপযোগিতাকে খুঁজে পান না।বিলাস বসনের মধ্যে নিজের জীবনকে সীমিত রাখার আদর্শ তিনি কখনোই প্রলোভিত হননি।স্বাধীনতা যুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের সনাক্তকরণ, নাম না জানা অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক আলোচনা, মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ করে উত্তর পূর্বাঞ্চলের সিলেট জেলায় প্রান্তিক পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধাদের না জানা কথা তিনি তার অনবদ্য লেখনীর ভাষায় সুস্পষ্টতা পেয়েছে। তাঁর ঐতিহাসিক ও বাস্তবধর্মী মাঠ পর্যায়েরগবেষণা কর্মে আলোচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মা–বোনদের সর্বোত্তম আত্মাহুতি ও আত্মত্যাগের কথা। তাঁর ‘বীরঙ্গনা কথা’ গ্রন্থে ১২ জন নারীর যারা জীবনের করুণ কাহিনীর বাস্তব অভিজ্ঞতা ও তাদের সাথে কথপোকথনের ভিত্তিতে হৃদয়স্পর্শী অনবদ্য ভূমিকায় তুলে এনেছেন। মুক্তিযুদ্ধে সহায় সম্ভ্ৰম হারানো মহিয়সী মা ও বোনদের আত্মত্যাগের কথা এবং স্বাধীনতার পরবর্তীকালে বর্তমান সময়ে তাদের বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রামের কথা তিনি সাক্ষাৎকার তুলে ধরেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের এক মহানায়কমুক্তিযোদ্ধা ছিলেন হবিগঞ্জের আজমিরী গঞ্জের জগৎ জ্যোতি, দুঃসাহসিক এই গেরিলা মুক্তিযুদ্ধার কথা সসম্মানে লোকচক্ষুর সামনে তুলে ধরেছেন নতুন প্রজন্মের কলম মুক্তিযোদ্ধা অপূর্ব শৰ্মা। অপূর্ব শর্মার বিস্তৃত কর্মময় অধ্যায়ে আরো আলোচিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকেরদের নির্মমতার কথা, উত্তর পূর্বাঞ্চলের সিলেট অঞ্চলের নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও সাহসিকতার কথা, মুক্তিযুদ্ধে সিলেট অঞ্চলের চা শ্রমিকদের কথা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় তাঁর আলোচনায় আলোকিত হয়েছে। তার অনন্য এই কর্মের মূল্যায়ন স্বরূপ এসেছে অনেক স্বীকৃতি, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গবেষক ও সাংবাদিক হিসেবে পেয়েছেন বিশেষ সম্মাননা ও স্বীকৃতি। অত্যন্ত সদালাপী, বিনম্র ও এক কথায় প্রচারবিমুখ এই ব্যক্তিত্ব কর্তব্যের প্রতি অবিচল থেকেই প্রবহমান রেখেছেন সৃষ্টিশীলতা।

CBN’কে দেয়া একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর বিস্তৃত কর্মময় জীবনের নানা না বলা কথা। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন CBN-এর হ্যালিফ্যাক্স প্রতিনিধি এবং উপদেষ্টা ফারজানা নাজ শম্পা।
ফারজানা নাজ শম্পা: শুরুতেই একরাশ শুভেচ্ছা জানাই অপূর্ব শর্মা। আপনার বিস্তৃত কর্মময় জীবনের মূল উপজীব্য বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ। তাই প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণায় সম্পৃক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে চাই?
অপূর্ব শর্মা: মুক্তিযুদ্ধ আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতার যে রক্তিম সূর্য উদিত হয়েছিল পুবাকাশে সেই অর্জনযাত্রার পরতে পরতে লেগে আছে ত্রিশলক্ষ শহিদের আত্মত্যাগ, চার লক্ষ মা– বোনের আর্তনাদ, অশ্রুগাঁথা। সেই গৌরবের, সেই অর্জনের, সেই বিসর্জনের কতটুকুই বা আমরা জানি কিংবা জানতে পেরেছি? আমাদের জানার পরিধি যেমন একেবারেই সীমিত, তেমনই জানানোর ক্ষেত্রেও আমরা পিছিয়ে! সাংবাদিকতা করতে গিয়েই উপলব্ধি করেছি মুক্তিসংগ্রামের আখ্যান প্রচার করা জরুরী। বীরত্ব এবং আত্মত্যাগের ঘটনাগুলোর গুটি কয়েকও যদি তুলে ধরতে পারি তাহলে সমৃদ্ধ হবে আমাদের জাতীয় ইতিহাস–এমন চিন্তা থেকেই ২০০৬ সালে মাঠে নামি। প্রথমেই আবিষ্কার করি ভাটি–বাংলার অকুতোভয় বীর সেনানী জগৎ জ্যোতিকে। এরপর ধারাবাহিকভাবেই চলতে থাকে অনুসন্ধান। যা আজও অব্যাহত আছে।
ফারজানা নাজ শম্পা: কোন চিন্তা ও আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আপনি প্রান্তিক পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন, এ প্রসঙ্গে যদি বলেন?
অপূর্ব শর্মা: ভাবনা–চিন্তা করে আসলে আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা শুরু করিনি। নিজস্ব দায়বদ্ধতা থেকেই এ পথে অগ্রসর হয়েছি। একের পর এক যখন ঘটনা অনুসন্ধান করতে শুরু করলাম আমার আগ্রহের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকলো। মনে হলো, সাধারণের এত এত আত্মত্যাগে ভাস্মর হয়ে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, তার মধ্য থেকে যেটুকু পারি তা তুলে এনে জাতিকে জানানো দরকার। বিশেষ করে প্রান্তবর্তী মানুষ যাদের আত্মত্যাগের অশ্রুত আখ্যান ছাইচাপা পড়ে আছে শুধুমাত্র অবস্থানগত কারণে। তাদের ত্যাগের, সহ্যের অকৃত্রিম সেই ভূমিকার কথা যদি এখনই সংরক্ষণ করা না যায় তাহলে একদিকে যেমন সেটা সময়ের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে তেমনই অন্যদিকে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে আমাদের গৌরবের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস। সেই চিন্তা থেকেই প্রান্তবর্তী মানুষের অবদানের কথা লিখতে শুরু করি।
ফারজানা নাজ শম্পা: দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আপনি কাজ করেছেন এই বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কি? একটু আলোকপাত করবেন কি?
অপূর্ব শর্মা: দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের নারীরা আন্দোলনে–সংগ্রামে সবসময়ই অগ্রণী। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আত্মাহুতি দিতে কখনও কুন্ঠিত হননি তারা। কিন্তু প্রচার–প্রচারণার ক্ষেত্রে তারা সবসময়ই পিছিয়ে। নিজেদের গৌরবগাঁথা নিয়ে তাদের কোনও অহমিকা নেই। অন্যদিকে প্রান্তবর্তী নারীরা ভীষণ লাজুক প্রকৃতির। বিশেষ করে একাত্তরে যারা নির্যাতিত হয়েছেন, শারীরিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে, তারা একেবারেই বিভিষীকাময় সেই সময়ের কথা বলতে নারাজ। সেইসব নারীদের খুঁজে বের করে তাদের অশ্রুত আখ্যান প্রথমে অবগত হওয়া এবং এরপর সেটা সংবেদনশীলভাবে উপস্থাপন করা সত্যিই আমার জন্য কঠিন কাজ ছিলো। কারণ একজন পুরুষের কাছে আমাদের সমাজের যে কোনও পর্যায়ের নারীরা তার সাথে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনা খুলে বলতে কখনই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। তাদের বিশ্বাস অর্জন করেই অবগত হতে হয়েছে দুর্বিসহ সেইসব বেদনাগাঁথা সম্পর্কে। এমনও হয়েছে একজনের একটি তথ্যের জন্য বার বার ছুটে যেতে হয়েছে। কিন্তু কখনো হাল ছাড়িনি। সে কারণেই শেষ পর্যন্ত কাজগুলো করতে সক্ষম হয়েছি। তারই ফলশ্রুতিতে নির্মিত হয়েছে ‘বীরাঙ্গনা কথা’ ও ‘মুক্তিসংগ্রামে নারী’ নামের পৃথক দুটি গ্রন্থ।
ফারজানা নাজ শম্পা: অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
অপূর্ব শর্মা: জগৎজ্যোতি দাস আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য সেনানী। বীরত্বে, সাহসে, যুদ্ধকৌশলে তিনি ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। ভাটি–বাংলাকে শত্রুমুক্ত রাখতে গঠিত গেরিলা বাহিনী দাস পার্টির কমান্ডার ছিলেন তিনি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে যাদের নাম লেখা থাকবে তাদেরই একজন জগৎজ্যোতি। হাসিমুখে স্বাধীনতার বেদীমূলে নিজের জীবন উৎসর্গ করে যারা আমাদেরকে পরাধীতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছেন–তাঁদের মধ্যে তিনি বীরত্বে শীর্ষস্থানীয়। আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামের এক অখ্যাত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ওঠে এসে জগৎজ্যোতি মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে প্রতিনিধিত্ব করেছেন তা অনেকটা বিস্ময়কর ব্যাপার। ১৯৭১ সালের ১৬ নভেম্বর জ্যোতি হবিগঞ্জের বদলপুরে পাক আর্মির সাথে সম্মুখসমরে শহিদ হন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জগৎজ্যোতির নেতৃত্বাধীন দাস পার্টি ভাটি অঞ্চলে পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের কাছে ছিল আতংকের নাম। অনেকটা নিজস্ব পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনাকারী এই দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধার কাছে অসম্ভব বলে কিছু ছিলনা। হাসি মুখে বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে পারতেন তিনি। দাস পার্টির আক্রমনের তীব্রতায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আজমিরীগঞ্জ–শেরপুর রুটে নৌ–যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পাক সরকার। দাস পার্টি নৌপথে এতটাই আক্রমণাত্মক ছিল যে তারা কখনো কখনো দিনে আট নয়টি কার্গো–কনভয়ও ডুবিয়েছেন বা ধ্বংস করেছেন। এছাড়াও একের পর এক ভাটির জনপদকে হানাদার মুক্ত করে জগৎ জ্যোতি যুদ্ধের ময়দানে হয়ে ওঠেছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তির নায়ক। যে যুদ্ধে তিনি শহিদ হয়েছেন সেদিনও তাঁর নির্ভুল নিশানায় প্রাণ হারায় ১২ জন পাকসেনা। এরপরই তাকে সর্বোচ্চ মরনোত্তর খেতাব প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা এই মুক্তিযোদ্ধাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে দূরে ঠেলে রেখেছে। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত সম্মাননা আজো যুক্ত হয়নি তাঁর নামের পাশে। যা সত্যিই দুঃখজনক।
ফারজানা নাজ শম্পা: আমরা জানতে পেরেছি আপনি কয়েকজন সঙ্গীত প্রতিভাদের নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং করছেন, বিষয়টি সম্বন্ধে আমাদের একটু আলোকপাত করুন?
অপূর্ব শর্মা: সংস্কৃতিমনস্ক সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখতে চাইলে অবশ্যই আপনাকে সংস্কৃতির প্রতিটি অনুসঙ্গ নিয়ে কাজ করতে হবে। সে উদ্দেশ্য থেকেই সঙ্গীত সাধকদের নিয়ে মূলত কাজ করার তাগিদ অনুভব করি। আপনি যদি আপনার দৃষ্টিসীমা প্রসারিত করেন তাহলে দেখতে পাবেন প্রত্যেক সঙ্গীত সাধকই মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তাদের সেই কথাগুলোকে যদি আমরা লেখালেখির মাধ্যমে প্রচার করতে পারি তাহলে যেমন আমাদের চেতনবিশ্ব সম্প্রসারিত হবে তেমনই মনোভূমি হবে উদার, সংকীর্ণতা মুক্ত। যা আমাদের সার্বিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। সেই চিন্তা থেকেই এ ধরণের লেখালেখির প্রতি আত্মনিয়োগ করি।
ফারজানা নাজ শম্পা: দেশে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরাধীদের নিয়ে যে গবেষণা চলছে তা কি পর্যাপ্ত? এই প্রসঙ্গে আপনার কাজের দিক গুলি কী কী?
অপূর্ব শর্মা: অধিকাংশ গবেষণা যেহেতু ব্যক্তিপর্যায়ে এবং গণমাধ্যমের বদৌলতে হচ্ছে সেহেতু অনেকক্ষেত্রেই অসম্পূর্ণতা থেকে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বর্তমানে প্রচুর পরিমানে লেখালেখি এবং বই–পুস্তক বের হলেও সেগুলোর অধিকাংশই হচ্ছে ব্যক্তির উদ্যোগে। সরকারীভাবে উদ্যোগ নিলে সম্পূর্ণতা পেতো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা প্রশাসনিকভাবে যে অনুসন্ধান প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে সেটা ব্যক্তিক সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে তারা পরিচালনা করতে পারছেন সরকারি কাজের সুবাদে। এই প্রক্রিয়াটি যদি অব্যাহত থাকে এবং দলমত রাজনীতির উর্ধে উঠে যদি তা পরিচালনা করা যায় তাহলে অবশ্যই মানবতাবিরোধীদের প্রত্যেকেই বিচারের আওতায় চলে আসবে এবং তখন ব্যক্তি পর্যায়ে যারা কাজ করছেন তাদের কাজের ক্ষেত্রও সহজতর হবে।
আমি যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করছি সেহেতু আবশ্যিকভাবেই যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি আমার গবেষণায় উঠে এসেছে। এটাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
ফারজানা নাজ শম্পা: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আপনার গবেষণা গ্রন্থ ও প্রকাশনাগুলো কী কী? অন্য কোন মাধ্যমে কি আপনি লেখালিখি করছেন?
অপূর্ব শর্মা: এপর্যন্ত আমার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ৮টি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থগুলো হচ্ছে, ‘অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি’ (সাহিত্যপ্রকাশ, ২০০৯), ‘সিলেটের যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র’ (ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ, ২০১০), বীরাঙ্গনা–কথা (সাহিত্যপ্রকাশ, ২০১৩), মুক্তিযুদ্ধের এক অসমাপ্ত অধ্যায়: ফিরে আসেনি ওরা (গদ্যপদ্য, ২০১৩), মুক্তিসংগ্রামে নারী (শুদ্ধস্বর ২০১৪), মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর (নাগরী, ২০১৬), চা–বাগানে গণহত্যা: ১৯৭১ (সাহিত্যপ্রকাশ, ২০১৬) ও মুক্তিযুদ্ধে সিলেট জেলা (তাম্রলিপি ২০১৭)। এরমধ্যে অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি ও চা বাগানে গণহত্যা: ১৯৭১ গ্রন্থ দুটি অনুবাদ হয়েছে। অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্র গবেষক মিহিরকান্তি চৌধুরী।
আমি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সাহিত্য পত্রিকা কালি ও কলম, শব্দঘর এবং দৈনিক জনকন্ঠ, দৈনিক মানবকন্ঠ, দৈনিক যুগভেরী, অনলাইন নিউজপোর্টাল বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা সংস্করণসহ সাহিত্য–সাময়িকী, সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ, নিবন্ধের পাশাপাশি সমকালীন প্রসঙ্গ নিয়ে লেখালেখি অব্যাহত রেখেছি।
ফারজানা নাজ শম্পা: আপনার কর্মজীবন ও মহিমাময় কাজের ক্ষেত্রে এসেছে নানা স্বীকৃতি, এ সম্পর্কে সম্যক আলোকপাত করবেন–
অপূর্ব শর্মা: আমার প্রাপ্তিযোগটা বেশ ভালো। অনেকে পুরস্কার, পদক নিয়ে নানা কথা বলেন। তবে, আমি যেটা বলবো সেটা হচ্ছে আপনি যদি কর্মের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ হন, কর্মের প্রতি যদি আপনার ভাবাবেগ থাকে, সৃজনের ক্ষেত্রে যদি আপনি কোন রূপ কার্পণ্য না করেন, দায়িত্বের প্রতি যদি শতভাগ সৎ থাকেন আজ নয়তো কাল স্বীকৃতি আসবেই। লেখক, গবেষক, কবি–সাহিত্যিক কেউই পুরস্কারের জন্য লেখালেখি করেন না। পুরস্কার আসলে লেখককে পাঠকের কাছে দায়বদ্ধ করে। লেখক প্রত্যয়ী হন ভালো কাজের প্রতি। সেটাই তাকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। যেমনটি বলেছিলাম এক্ষেত্রে আমার প্রাপ্তিযোগটা কিন্তু বেশ ভালো। ২০১০ সালে ‘সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র’ গ্রন্থের জন্য এইচএসবিসি কালি ও কলম তরুণ লেখক পুরস্কার এবং ২০১৩ সালে চা–বাগানে গণহত্যা শীর্ষক ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাংবাদিকতায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রবর্তিত বজলুর রহমান স্মৃতিপদক লাভ করি। দুটি পুরস্কারেরই অর্থমূল্য ছিলো ১ লাখ টাকা। এছাড়া শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণাগ্রন্থগুলো নিয়ে ‘অপূর্ব শর্মার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা: প্রান্তজনের কথা’ শীর্ষক একটি সেমিনার সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেমিনারের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন শাবিপ্রবির সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর জাফর সেতু। পুরস্কারের পাশাপাশি এটিও আমার কর্মের বড় একটা স্বীকৃতি।
ফারজানা নাজ শম্পা: আপনি কি সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে কর্মপরিচালনা করেন? আপনার কর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়কে অন্তরায় মনে করেন?
অপূর্ব শর্মা: হ্যা আমি ব্যক্তিগত প্রচেষ্ঠাতেই গবেষণা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। আমি যে কাজটি করি সেটা অনেক শ্রমসাধ্য, তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের জন্য অনেক মাঠ–ঘাট ঘুরতে হয়। অবস্থান করতে হয় অপরিচিত এলাকায়। যা অনেক ব্যয় সাপেক্ষ। মূলত ব্যায় নির্বাহটাই প্রতিবন্ধকতা। যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বেশি মাত্রায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা বা অনুসন্ধান চালানো হতো অথবা ব্যক্তিক পর্যায়ে উদ্যোক্তাদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হতো তাহলে আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করি তাদের চলার পথ মসৃণ হতো এবং বৃদ্ধি পেতো কাজের মাত্রা।
ফারজানা নাজ শম্পা: মুক্তিযুদ্ধ ও অন্যান্য বিষয়ে লেখালেখি নিয়ে আপনার আগামী পরিকল্পনা জানতে চাই–
অপূর্ব শর্মা: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এতটাই বিস্তৃত যে এক জীবনে কাজ করে তার কূলকিনারা পাওয়া যাবেনা। এখনও এমন অগনন ক্ষেত্র রয়েছে যেসব বিষয় ছাইচাপা পড়ে আছে। আত্মত্যাগের, যুদ্ধের, মানবিকতার সাহায্যের–এমন অনেক আখ্যান রয়েছে যেগুলো আমরা আবিস্কার করতে পারিনি। যুদ্ধের প্রতিটি ঘটনা, অনুঘটনাই আমাদের অমূল্য সম্পদ। যেহেতু নিজ উদ্যোগে প্রচেষ্টায় গবেষণা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি তাই অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। তবে আমি কখনও আমার চেষ্টার কোনও ত্রুটি করিনা। আত্মত্যাগের অনেক ছাইচাপা পড়ে থাকা ঘটনা অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধের এসব অশ্রুগাঁথা জাতির সামনে উন্মোচিত হলে সমৃদ্ধ হবে আমাদের মানচিত্র বিনির্মানের ইতিহাস। কিন্তু সেই ইতিহাসকে ছাত্র–ছাত্রীদের মধ্যে, তরুন প্রজন্মের মধ্যে যদি আমরা ছড়িয়ে দিতে না পারি তাহলে এই কষ্ট স্বার্থক হবে না। নতুন প্রজন্মের মধ্যে যদি স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস পৌঁছে দেওয়া যায়, আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরা যায়, তাহলে আমরা যেসব বিষয় নিয়ে শংকিত অর্থাৎ অন্ধকার তা তাদেরকে কখনো গ্রাস করতে পারবে না। আলোর ধারায় তারা প্রবহমান রাখবে জীবনের গতিপথ। আধার তখন আপনাআপনি উবে যাবে।
ফারজানা নাজ শম্পা: অপূর্ব, এইবার আপনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কিছু বলুন আর ব্যস্ত জীবনের মাঝে অবসর সময় কীভাবে কাটান ?
অপূর্ব শর্মা: আমার বাবার নাম অতূল শর্মা। মায়ের নাম রাধারানী শর্মা। আমার জন্ম শ্রীমঙ্গলের হরিনাকান্দি গ্রামে। আমরা ৩ ভাই, ১ বোন। আমি মোঝো। বড়ভাই অজয় শর্মা গ্রামীনব্যাংক থেকে অবসর নিয়ে বর্তমানে একটি ঔষধ কোম্পানীতে কর্মরত। বড়বোন রত্না শর্মা এবং ছোটো ভাই অমৃত শর্মা কুয়েত প্রবাসী। আমি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে সিলেট থেকে প্রকাশিত দেশের প্রাচীন সংবাদপত্র দৈনিক যুগভেরী পত্রিকায় নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। ২০১১ সালের ২১ নভেম্বর যুগলজীবনে পদর্পান করি। জীবনসঙ্গী প্রিয়াংকা শর্মা একজন সঙ্গীত শিল্পী। অবসরে বই পড়তে ভালো লাগে। ফুটবল এবং ক্রিকেট খেলা দেখি সুযোগ পেলে।
ফারজানা নাজ শম্পা: অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা আপনাকে, কানাডায় বাংলাদেশের মুখপত্র সংবাদ মাধ্যম CBN-এর পক্ষ থেকে আপনার জন্য রইলো আন্তরিক শুভকামনা।
অপূর্ব শর্মা: আপনাকে এবং CBN’কে অসংখ্য ধন্যবাদ।