‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই, কেন মনে রাখো তারে।’ হিমাংশু বিশ্বাসের প্রিয় গান এটি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই গানটি তার এতটাই প্রিয় যে কোথাও গান গাইতে গেলে তাঁর কন্ঠে অবশ্যই শোনা যাবে এটি। জীবনে ঠিক কতবার এই গানটি গেয়েছেন তার কোনো হিসেব নেই। ৫৮ বছরের সংগীত জীবনে কম করে হলেও হাজারবার গেয়েছেন, এটা বলা যায় নিঃসন্দেহে। কালজয়ী এই গানটি গাইতে গাইতে তিনি কোথায় যেনো হারিয়ে যান! সুর ও বানীর মেলবন্ধনে সজল হয়ে উঠে তাঁর আখি যোগল। গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। তখন মন্ত্রমুদ্ধ না হয়ে উপায় থাকেনা। হিমাংশু বিশ্বাস ঠিক এমনই। মাতিয়ে রাখতে ভালোবাসেন। কেবল এই গানটিই নয়, তাঁর দরাজ গলায় গাওয়া প্রতিটি গানই ভিন্নমাত্রা পায়। সে কারনে ছয় দশক ধরে সিলেটে সমান জনপ্রিয় তিনি। সেই জনপ্রিয়তা দেশের গ-িতেই আবদ্ধ নয়। দেশের বাইরেও রয়েছে তাঁর অগনন ভক্ত শ্রোতা।

সিলেটে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে আর এতে ডাক পড়বেনা হিমাংশু বিশ্বাসের- গত কয়েক দশকে এমনটি হয়নি কখনো। গানপাগল এই মানুষটির গানের সাথেই কাটে দিনরাত। সংগীতে মগ্ন থাকেন জেগে থাকার প্রায় সবটুকু সময়। শুধুকি তিনি, পরিবারের অন্য দুই সদস্যও একই ভুবনের বাসিন্দা। স্ত্রী এবং মেয়ে তারা দু’জনেই ভালো শিল্পী। তাই সংগীতমগ্নতাই হয়ে উঠেছে বিশ্বাস পরিবারের পাথেয়।
হিমাংশু বিশ্বাসের শৈশব কেটেছে চা বাগানের শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে। দুটি পাতা একটি কুড়ি তোলার শৈল্পিক দৃশ্য তার মনে সেইযে অনুরণন তুলেছিলো তা আজও অব্যাহত আছে। বাবা ছিলেন গানপাগল মানুষ। প্রতি সন্ধ্যায় তাদের বাড়িতে গানের জলসা বসতো। আর বাবার কোলে বসে গান শুনতেন হিমাংশু বিশ্বাস। তাঁর ভাষ্য-‘এ বি সি ডি শেখার আগেই আমি সারেগামা শিখেছি, শিখেছি গান।’ প্রথম মাইকের সামনে আসেন বারো বছর বয়সে। বড়লেখার একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাবার এক বন্ধুর শেখানো গান দিয়ে শুরু হয় তাঁর গানের পথচলা। ‘এমন মজা হয়না’ গানটি তার শিশুকণ্ঠে শুনে সেদিন মুগ্ধ হন উপস্থিত সকলে। ‘চা বাগানের কর্মকতা বাবার বুকটা গর্ভে ভরে উঠে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন আমাকে গান শেখানোর।’ শুরু হলো গান শেখা! ওস্তাদ রাসবিহারী চক্রবর্তী প্রায় দু’বছর গান শেখানোর পর গানের ওপারে পাড়ি জমান। ছন্দপতন ঘটে, কিন্তু থামেনি অগ্রযাত্রা। নিজে নিজেই অব্যাহত রাখেন চর্চা। সেই চর্চা নিজস্বতায় অনন্য করে তুলে তাকে। পরবর্তী পর্যায়ে সংগীতের নানা শাখায় বিচরন তার নিজস্বতারই ফল।
শুরুটা হয়েছিলো রবীন্দ্র সংগীত দিয়ে। কিন্তু যখন বুঝতে শিখতে শুরু করলেন, পাল্টাতে থাকলো তাঁর চর্চার ক্যানভাস। সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে তাঁর ভালোলাগা। অগ্নিবীণার নজরুল হয়ে উঠেন তাঁর সুরের পথের পথপ্রদর্শক। তার মতে- ‘নজরুলগীতির মাঝে কি নেই! সংগীতের সবকিছুতে ভরপুর নজরুলের গানের শাখা-প্রশাখা। শ্যামা সংগীত, গজল, আধুনিক, পল্লীগীতি-সব সবকিছুই আছে তাতে। আমি আকৃষ্ট হলাম। প্রেমে পড়লাম নজরুল সংগীতের।’ সেই প্রেমে পরিপূর্ণ হলেন হিমাংশু বিশ্বাস। জীবনের প্রথম পুরস্কার জিতলেন নজরুল সংগীতে। ১৯৬৬ সালে সিলেট সারদা হলে পাকিন্তান আর্ট কাউন্সিল আয়োজিত প্রতিযোগীতায় প্রথম স্থান অর্জন করে তাক লাগিয়ে দিলেন সকলকে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ’৬৭ সালে সিলেট বেতারে অডিশন দিলেন নজরুল সংগীতে, নির্বাচিত হলেন। দ্যুতি ছড়াতে থাকলেন হিমাংশু। সুরমাপাড়ের শহরে বাড়তে থাকলো তাঁর জনপ্রিয়তা, কদর। সময় পরিক্রমায় সংগীতাঙ্গনের অন্যতম অপরিহার্য্য একজনে পরিণত হলেন তিনি। মৌলভীবাজার থেকে যে যাত্রাপথ শুরু করেছিলেন তিনি তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলো সিলেটে। এখানে লেখাপড়া শেষ করে চাকুরি নিলেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে। কিন্তু থেমে থাকেনি তাঁর সংগীত চর্চা।
হিমাংশু বিশ্বাসকে সৌভাগ্যবান বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবেনা। সাংস্কৃতিক জাগরনের সময়টায় তিনি ছিলেন তারুণ্যদ্বীপ্ত যুবক। বিরুদ্ধ পরিবেশ জয়ের সেই আন্দোলনে স্বভাবতভাবেই জড়িয়ে পড়লেন। হলেন মুক্তিপথের সুরসৈনিক। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্তান, মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনসহ সময়ের প্রায় সকল আন্দোলন সংগ্রামেই কণ্ঠযোদ্ধা হিসেবে অংশ নিয়েছেন তিনি। ঊনসত্তরে গেয়েছেন আয়রে চাষি মজুর কুলি/ বন্য শাপের ছুবলে আহত জননী, স্বদেশ কাঁদে/ শিকল পড়ার ছল/ মানবনা বন্ধনে প্রভৃতি গান।
মুক্তিযুদ্ধ তাঁর জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জল অধ্যায়। মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে ভারতে মুক্তিযুদ্ধের তহবীল সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশী শিল্পীদের নিয়ে বেশ কয়েকটি দল গঠন করা হয়। এর একটির নেতৃত্বে ছিলেন সুজয় শ্যাম। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন হিমাংশু বিশ্বাস। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ দিয়ে শুরু হতো গানের অনুষ্ঠান, শেষ হতো ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ দিয়ে। আর সুরের ঢেউ তুলে মানুষকে মাতোয়ারা করতে অন্যতম ভূমিকা রাখতেন হিমাংশু বিশ্বাস। এই দলটি মূলত আসাম অঞ্চলের জন্য গঠন করা হয়েছিল।
দেশ স্বাধীন হলে আত্মমগ্ন হন লোকসংগীতে। বিদিত লাল দাস ও তার দল-এর অন্যতম সদস্য হিসেবে সংগীত পরিবেশন করে পরিচিতি লাভ করেন সারা দেশে। রাজধানীতে অনুষ্ঠিত লোকসংগীতের দুটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করে এই দলটি খ্যাতির চূড়ান্ত শিখরে পৌছে। বঙ্গভনেও সংগীত পরিবেশন করেন এই দলের সদস্যরা। হিমাংশু বিশ্বাসের ভাষ্য অনুযায়ি, ‘সেদিনের স্মৃতি আজও জাগরুক আমার মনে। বঙ্গবন্ধু হাছন রাজার গান শুনতে চাইলেন। তাকে লোকে বলে, বলেরে ঘরবাড়ি বালা নায় আমার- গেয়ে শুনিয়েছিলাম। প্রশংসা করেছিলেন তিনি।’
হিমাংশু বিশ্বাস শুধু গান গাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন নি নিজেকে। ৩শ’র মতো গান লিখেছেন। সুর করেছেন তারও অধিক গানে। রেডিওর একজন অতিথি পরিচালক তিনি। বের হয়েছে তার লোকসংগীতের একক দুটি গানের এ্যালবাম। দেশের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে গেয়েছেন গান। আমেরিকা, কানাডা, ভারত, যুক্তরাজ্য, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, সুইডেন প্রভৃতি দেশ ভ্রমন করে পেয়েছেন সংগীত প্রিয় মানুষের ভালোবাসা। তবে আজকের পর্যায় পর্যন্ত পৌছতে যে দু’জন মানুষের কাছে তিনি ঋনি তারা হচ্ছেন আমীনূর রশীদ চৌধূরী ও তারু মিয়া। তার মতে, ‘তাদের আকুণ্ঠ সাহায্য, সহযোগিতা এবং ভালোবাসা না পেলে হয়তো আজকের পর্যায়ে পৌছা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না।’
সারল্যে ভরা হিমাংশু বিশ্বাসের জীবন। সরল রেখায় চলতে তিনি পছন্দ করেন। নিজের অর্জনকে সার্বজনীন করতে তিনি যেনো বদ্ধপরিকর। তাই সংগীত চর্চার পাশাপাশি গানশেখান। সিলেট শিল্পকলা একাডেমির সংগীত বিভাগের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন দীঘদিন ধরে। সেই সাথে নজরুল একাডেমির সংগীত শাখার অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। বিলুপ্তপ্রায় লোকসংগীতকে ধরে রাখার তাগিদে তিনি এবং হ্যারল্ড রশীদ প্রতিষ্ঠা করেছেন উজান নামের একটি ব্যতিক্রমী গানের দল। স্ত্রীকে সাথে নিয়ে শহরতলীর সাদিপুর এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘গীতশ্রী’ নামে সংগীত বিদ্যালয়। এ পর্যন্ত তার কাছ থেকে গান শিখেছেন পাঁচশতাধিক ছাত্র-ছাত্রী। এদের অনেকেই আজ প্রতিষ্ঠিত। তাদের মাঝেই বেঁচে থাকতে চান তিনি। ইচ্ছে আছে, একটি লোকসংগীত একাডেমি প্রতিষ্ঠার। তার মতে, ‘লোকসংগীতের বানী ও কথা পরিবর্তন করে গাওয়া হচ্ছে। বিকৃতি রোধের জন্য একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই।’
অনেকের মতো তাঁর গান আমারও ভালো লাগে। সেদিন (১৩.১২.২০১৫ খ্রি.) গান শুনতে গিয়েছিলাম তাঁর বাসায়। তাকে অনুরোধ করেছিলাম দুটি গান শোনানোর। সাথে সাথেই বসে পরলেন হারমোনিয়াম নিয়ে। প্রথমে গাইলেন আমীনূর রশীদ চৌধূরীর লেখা জনপ্রিয় গান- ‘মাটির মাঝে বাঘ চড়ে, পানিতে হাঙর।’ এরপর শোনালেন তার ভালোলাগার গান। ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই।’ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম। আত্মমগ্ন শিল্পীর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকলে অশ্রু। টিসু দিয়ে বার কয়েক মুছলেন। কিন্তু থামলনা গান-এইতো হিমাংশু বিশ্বাস; কাঁদতে কাঁদতেও তিনি গাইতে পারেন। এভাবে গানের মাঝে অব্যাহত থাকুক তাঁর পথচলা, সত্তরতম জন্মদিনে এটাই প্রত্যাশা।