অশোক বিজয় রাহা

বিশ্বভারতীর অধ্যাপক হিসেবে অশোক বিজয় রাহা যতটা পরিচিত তার চেয়ে অধিক পরিচিত কবি হিসেবে। কাব্যচর্চা অশোক বিজয় রাহাকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করে রেখেছে।

আধুনিক কবিতার সূচনালগ্নে যে ক’জন বঙ্গীয় কবি কবিতার ভূবন দাপিয়ে বেরিয়েছেন স্বমহিমায় তাদের মধ্যে অশোক বিজয় রাহা অন্যতম। ব্যক্তি জীবনে তিনি পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিলেও কাব্যচর্চা ছিল তাঁর মর্মমূলে। যদিওবা অশোক বিজয় রাহাকে নানাভাবেই চিত্রিত করা যায়। কারণ তাঁরমধ্যে নানা গুণের সমন্বয় ঘটেছিল। ‘অধ্যাপকরূপে তিনি ছিলেন অসাধারণ। তাঁর কগ্মীতা, পাণ্ডিত্য, বিশ্লেষণী ক্ষমতা ছিলো অপূর্ব। তাঁর আবৃত্তি ছিল অনুকরণীয়।’

অশোক বিজয় রাহা ১৯৮০ সালের ১৪ নভেম্বর সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানার ঢাকাদক্ষিণ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বঙ্ক বিহারী রাহা চা বাগানে কাজ করতেন। বঙ্ক বিহারীর চার ছেলের মধ্যে অশোক বিজয় ছিলেন সবার ছোট। অশোক বিজয় অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। স্কুল জীবনে তিনি ছিলেন অন্যদের চাইতে আলাদা। মেধাবি ও বিনয়ী হওয়ার কারনে শিক্ষকরা অত্যাধিক স্নেহ করতেন তাঁকে। সিলেট গভর্ণমেন্ট হাইস্কুল থেকে অশোক বিজয় প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। আইএ পরীক্ষাতেও তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। দর্শনশাস্ত্রে অনার্স এবং বাংলায় এমএ পাশ করে রসময় মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি।

দুই
শিক্ষকতার পাশাপাশি অশোক বিজয় রাহা কাব্যচর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। কবিতার সাথে শৈশবে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। কবিতার সাথে মিতালী করেই পথচলা অব্যাহত ছিল তাঁর। সময়ের সাথে সাথে সমৃদ্ধ হতে থাকে তাঁর কাব্যচর্চায় ভাণ্ডার। তাঁর ফলস্বরূপ যৌবনে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিভার স্বীকৃতি পান তিনি। ‘তাঁর ১৯ বছর বয়সের একগুচ্ছ কবিতা পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রশংসা বাণী লিখে দিয়েছিলেন। শুরুটা শৈশবে হলেও তাঁর কবিতা গ্রন্থভুক্ত হয় ১৯৪১ সালে। এবছর তাঁর ‘ডিহাং নদীর বাকে’ ও ‘রুদ্র বসন্ত’ প্রকাশিত হয়। সিলেট থেকে কবিতার বইগুলো প্রকাশিত হলেও কাব্যরসিক বাঙালীদের মধ্যে তাঁর কবিতা স্থান করে নেয়। কলকাতার সাহিত্যাঙ্গনে বিপুল প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থগুলো। এর একবছর পর ১৯৪২ সালে বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘কবিতা ভবন’ থেকে ‘ভানুমতির মাঠ’ প্রকাশ করে তাঁকে প্রথম শ্রেণীর কবি হিসেবে অভিনন্দিত করেন।

কবিগুরুর প্রশংসা বাণী, আর বুদ্ধদেব বসুর স্বীকৃতি কাব্যাঙ্গনে প্রবেশের পর কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে অশোক বিজয় রাহাকে তাই আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁর শ্যামল, সতেজ কথামালা বিদগ্ধজনের হৃদয়ে তাঁর জন্য-আসন তৈরী করে। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, আর মানুষের জীবনাচার তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু হওয়ায় কাব্যাঙ্গনে তার অবস্থান সুদৃঢ় হতে থাকে। সিলেট ও কাছাড়ের শ্যামলবেষ্টিত চা বাগানে কৈশর উত্তীর্ণ হয়েছে তার। পিতার কর্মক্ষেত্রের সুবাদে তিনি চা-বাগানের নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্য ছেলে বেলায়ই অবগাহন করেন। সেই প্রভাব পরিস্ফুটিত হয়েছে তাঁর কবিতায় ক্যানভাসে। সিলেট ও কাছাড়ের জীবনযাত্রার চিত্র তিনি তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন সন্তর্পণে :

একদিকে পাহাড়-চূড়ায়
প্রকাণ্ড সেগুন-বন ঢেকে আছে অর্ধেক আকাশ
জমাট রাত্রির মতো,
বুকে তা’র
ঝিঁঝিঁ- ডাকা গায় অন্ধকার,
শতাব্দীর ঘুম।

অন্যদিকে পাহাড়ের কোলে
ঘুমায় পড়ন্ত- রোদে শালবন,
ছায়া পড়ে ঢালুর কিনারে,
পাশ দিয়ে একখানি আঁকাবাঁকা পথ
নেমেছে সাপের মতো।

মাঝখানে ধূ-ধূ ফাঁকা মাঠ,
একফালি আকাশের ফাঁক,
একটি পাখির শিষ রেখা টেনে যায়
সূর্যাস্তের দিকে।

 (দিনান্ত, ‘জল-ডম্বরু পাহাড়’)

সাবলীল ও নিখুঁতভাবে তিনি বনাঞ্চলবেষ্টিত সিলেটের বর্ণনা দিয়েছেন এই কবিতায়। পাহাড়ঘেরা সিলেট অঞ্চলের প্রতিচিত্র যেন ‘দিনান্ত’ কবিতায় ভাস্বর। নিসর্গের প্রতিচ্ছবি তিনি নিখুঁতভাবে চিত্রন করেছেন শব্দ দক্ষতায়।

কবি অশোক বিজয় ছিলেন বৈষ্ণব ভাবনার অনুগত। তাঁর পিতা-মাতা দুজনেই ছিলেন শ্রী চৈতন্যের ভাবশিষ্য ও বৈষ্ণব ভাবাপন্ন। তবে পারিবারিক, আবহের কারণে নয়, বৈষ্ণব ভাবধারার প্রতি নিজেই অনুরক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর ব্যক্তি জীবনের সেই ভাবধারার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

আমি শুধু জানি এ জ্যোৎস্না রাতে
কত কচি ডালে ফুলের প্রসব-ব্যথা,
কুমারীর বুকে কত যন্ত্রণা নিয়ে
জন্ম নিতেছে প্রথম প্রেমের কুঁড়ি।
 (চিঠি, ডিহাং নদীর বাঁকে)

কোমলে কঠোরে, তার কবিতা বিচিত্ররূপীনী। অরন্যক প্রকৃতিই হোক, কিংবা মানুষের প্রতিদিনের আনন্দ বেদনাই হোক, তাঁর লেখনীর যাদুস্পর্শে আমাদের পরিচিত জীব ও জগৎ এক অপরূপ সত্তায় রূপায়িত হয়েছে। অভিনব রূপকল্প নির্মাণে তাঁর সমকক্ষ কবি দুর্লভ।

অশোক বিজয় রাহার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১০। এগুলো হচ্ছে ডিহাং নদীর বাকে (১৯৪১), রুদ্র বসন্ত (১৯৪১), ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয় জলডম্বরু পাহাড়, রক্ত সন্ধ্যা, শেষ চূড়া, ১৯৫১ সালে বের হয় ‘উড়ো চিঠির মাঠ’, ১৯৬১ সালে ‘সেথা এই চৈত্রের শালবন’ ১৯৮১ সালে ‘ঘণ্টা বাজে, পর্দা সরে যায় এবং ১৯৮৪ সালে ‘অশোক বিজয় রাহার শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশিত হয়।

গদ্যও লিখেছেন তিনি। তাঁর লেখা প্রথম গদ্যগ্রন্থ ‘বাণী শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ’ ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। ‘পত্রাষ্টক’ প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি হিরণ কুমার বসু স্মারক বক্তৃতা করেন। ভাষণটি উৎকৃষ্ট সাহিত্য সমালোচনা হিসেবে গ্রন্থভূক্ত হয়েছে। ‘কবিতার শিল্পরূপ’ নিবন্ধে কবি অশোক বিজয়ের কাব্যদর্শন ও কবি ভাবনা বিধৃত হয়ে আছে। কবিতার আঙ্গিক ও বৈচিত্রতা অশোক বিজয় রাহাকে রূপদক্ষ কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অনুভূতির সূক্ষè রূপায়ন তাঁর কবিতায় স্বার্থভাবে বিধৃত হয়েছে। জীবনের প্রয়োজনে তিনি বিভিন্নস্থানে অবস্থান করলেও তাঁর কবিতার শিল্পরূপ ছিল বর্তমান।

একদিন বহু আগে পৃথিবীর আদিম জঙ্গলে
উঠেছে প্রকান্ড সূর্য। দীর্ঘ এক অজগর-রাত
হঠাৎ উঠেছে ন’ড়ে পাকে-পাকে ছাড়ায়ে কুণ্ডলী
আঁকা-বাঁকা ছায়াপথে টেনে তা’র বিসর্পিল দেহ
লুকায়েছে পশ্চিম-সাগরে।

এদিকে সকাল বেলা
সবুজ বনের শাখা পাখিদের কোলাহলে ভরা,
নানা আলোছায়া থেকে বেরিয়েছে হরিণের দল-
বিচিত্র রঙের রামধনু, মাটির ঘাসের বুকে
উড়েছে অসংখ্য প্রজাপতি; ফুটন্ত ফুলের ডালে
ভ্রমরেরা জুড়েছে গুঞ্জন।

তবু এ-সবের ফাকে
ক্ষণে ক্ষণে আতঙ্কিত ত্রাস, -ওদিকে পাহাড় ভেঙ্গে ছুটেছে
উন্মুক্ত হ’য়ে খড়গনামা প্রকাণ্ড গণ্ডার,
খাগের বনের ধারে চকচকে বাঘ-চাটা জল
হঠাৎ উঠেছে জ্ব’লে ঝকঝক আয়নার মতো।
একধারে নেমে আসে হুড়মুড় মহিষের পাল
লাল-চোখ অদ্ভুত মাতাল, -সহসা বিছুটি বনে
এস্তপায়ে লুকায় গোসাপ, -দূরের জঙ্গল থেকে
বার দুই শোনা যায় চিতার করাত-চেরা ডাক।
(চিরজীবী, শোষ-চূড়া)

প্রকৃতি ও জীবজন্তুকে এক সুতোয় গেয়েছেন তিনি কবিতায়। দীর্ঘ পংক্তিমালায় কল্পনা এবং বাস্তবতার মিশেল ঘটিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন ভিন্নধারার।

অশোক বিজয় রাহার কবিতা পর্যালোচনা করলে অপূর্ব শিল্প দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। মানব মনের বিচিত্র অনুভূতি তাঁর কাব্যে বাক্সময় হয়ে উঠেছে। তাঁর কবিতা হিন্দি, ইংরেজি, ফরাসি ও স্পেনিশ ভাষায় অনুদিত হয়েছে। অন্নদাশঙ্করের জীবনসঙ্গিনী লীলা রায় অনুদিত তাঁর নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ Enchanted tree বহুল প্রশংসিত।

কবি বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা ছিল। বুদ্ধদেব বসু কবিতা পত্রিকা বের করলে এর প্রতি সংখ্যায় তিনি লিখেছেন। An Acre of green grass গ্রন্থে বুদ্ধদেব বসু অশোক বিজয় রাহার কবিতাকে Cooldewy Lyrics বলে অভিহিত করেছেন। কবি বিশ্বভারতীকে যোগদান করলে বুদ্ধদেব বসু লিখেন ‘ভগবান তাঁকে নির্মল রাখতে চান বলেই শান্তি নিকেতনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।’ অশোক বিজয় রাহার বন্ধুভাগ্য খুবই ভালো ছিল। অকালপ্রয়াত কবি প্রজেশ কুমার রায়- কবি অশোক বিজয় রাহাকে তাঁর ‘যাত্ররম্ভ’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেন। বিশ্বভারতীকে জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করার কারণে অবসর গ্রহণের পরও শান্তি নিকেতনের সকল কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন তিনি। অশোক বিজয় রাহা শান্তি নিকেতনে ১৯৯০ সালের ১৯ অক্টোবর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।