সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র: জাকির জাহামজেদ

একাত্তর সালে বৃহত্তর সিলেটে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ এবং বৃহত্তর সিলেটের রাজাকার, আলবদরদের নিয়ে অপূর্ব শর্মার লেখা ‘সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র’ নামের একটি বই প্রকাশ করেছে ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সিলেট অঞ্চলে সংঘটিত গণহত্যা, পাকবাহিনীর বর্বরতা, রাজাকার বাহিনী গঠন ও রাজাকারদের কর্মতৎপরতা, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজাকার ও আলবদরদের গ্রেপ্তার হওয়া এবং পরবর্তী সময়ে আইনের ফাঁক গলে তাদের মুক্তি পেয়ে যাওয়া, একাত্তর পরবর্তী সময়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত নানা ধরনের সংবাদ ও সেসব সংবাদের বিশ্লেষণ করা হয়েছে ‘সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র’ গ্রন্থটিতে।

‘সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র’ গ্রন্থের প্রথম পর্বে লেখক একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পাকবাহিনীর নির্যাতন, শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন এবং বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে এদের কর্মতৎপরতার কথা বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। রাজাকারদের ট্রেনিং, শান্তি কমিটি কর্তৃক রাজাকারদের শপথ করানো এবং রাজাকার-আলবদর বাহিনী গঠনের পটভূমি অপূর্ব শর্মা তার গ্রন্থে বিশদভাবে তুলে ধরেছেন।

অপূর্ব শর্মা ‘সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র’ গ্রন্থে বাংলাদেশে রাজাকার বাহিনী গঠন ও তাদের  বেতন বা ভাতার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ এবং সিলেটের রাজাকার বাহিনীর জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের কথা তুলে ধরেছেন। এই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ছয় মাসের জন্য। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘একজন রাজাকারের জন্য মাসিক বরাদ্দ ছিল ৯০ টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী সিলেটের প্রদত্ত বরাদ্দে গোড়ার দিকে ছয় হাজার রাজাকার প্রতিপালনের পরিকল্পনা ছিল শত্রু সরকারের।’ প্রতিবেদনে সুনামগঞ্জ সদর থানায় ১৮১৬ জন রাজাকারের নামের তালিকা বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়।

সিলেটের মুসলিমদের মধ্যে যে জেলে সমপ্রদায় আছে (যাদের সংখ্যা চার থেকে পাঁচ লাখ হবে বলে প্রকাশ) তারা সম্প্রদায় হিসেবে ইয়াহিয়া চক্রকে সমর্থন দিয়েছিল। জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন একাত্তর সালে ব্যাপক হারে রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছিল। এই সম্প্রদায়ের নিঃসঙ্কোচ সমর্থনের পুরস্কারস্বরূপ তাদের মধ্য থেকে একজনকে মন্ত্রিত্ব দিয়েছিল দখলদার বাহিনী। এ ছাড়া সিলেট মোল্লা প্রভাবিত জেলা। এ জেলার পুরনো ধাঁচের (ওল্ড স্কিম) মাদ্রাসার আধিক্য অবিশ্বাস্যরূপে বেশি। এগুলোর পরিচালনায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিক্রিয়াশীল আলেমকুল ও সমাজের শীর্ষস্থানীয় বিত্তবান লোকজন থাকায় মাদ্রাসার ‘তালাবা’রা অধিক হারে বাধ্যতামূলকভাবে রাজাকার শ্রেণীভুক্ত হয়েছিল। মোল্লাদের ধর্মীয় ফতোয়া জারি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্যথলেখক অপূর্ব শর্মা ‘সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র’ গ্রন্থে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই বিষয়গুলোর বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করেছেন।

দালাল অধ্যাদেশ, বিচার ও বাস্তবতাপর্বে অপূর্ব শর্মা লিখেছেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল তাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকার দালাল অধ্যাদেশ জারি করে। ১৬ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে দালালদের সম্পর্কে প্রথম সরকারি প্রেসনোট প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, সরকার দালাল অথবা এ ধরনের অপরাধীদের দেখা পেলে তাদের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রেখে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য  বেসামরিক পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে এবং জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে পুলিশকে দালালদের খবর প্রদানের জন্য। দালাল ও অপরাধীদের বিচারের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারি সংস্থাগুলোকে ক্ষমতা  দেওয়া হচ্ছে বলে প্রেসনোটে জানানো হয়।

এ ছাড়া গ্রন্থের এই পর্বে লেখক আরো লিখেছেন, ‘তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমার যে ঘোষণা দিয়েছিল এর মধ্যে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের জন্য সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্ত দালালদের ক্ষমা করা হয়নি। কিন্তু তার পরও এই  ঘোষণাকে কৌশলে কাজে লাগিয়ে তৎকালীন সময়ে গ্রেপ্তারকৃত অনেক দালাল-রাজাকার তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তি পেতে থাকে। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর দালালরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ক্রমান্বয়ে প্রায় সব দালালই ছাড়া পেয়ে যায়। অসংখ্য দালালকে পুনর্বাসিত করা হয়। বিভিন্ন স্থানে দালালরাই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। এমনকি দালালরা মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর পদও অলংকৃত করে।’

বৃহত্তর সিলেটে যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে দালাল আইনে অভিযুক্তদের কথা এবং তাদের অপরাধনামা ‘সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র’ গ্রন্থের একটি পর্বে তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে সিলেটের প্রথম সারির উনত্রিশজন দালাল ও তাদের অপরাধনামা অপূর্ব শর্মা গ্রন্থের এই অংশে লিখেছেন। এছাড়া দালাল আইনে বিচার হওয়া রাজাকারদের কথাও লিখেছেন অপূর্ব শর্মা।

‘সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র’ গ্রন্থের একটি পর্বে লেখক বর্তমানে সিলেটে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের কথা তুলে ধরেছেন। এদের কেউ কেউ নিজের এলাকায় প্রভাব প্রতিপত্তির সঙ্গেই টিকে আছে, আবার কেউ একাত্তরে নিজের কুকর্ম ঢেকে ফেলার জন্য নিজের নামও পাল্টে ফেলেছে। সমাজের চোখে ফাঁকি দিলেও পেশায় সাংবাদিক অপূর্ব শর্মা সাহসী  লেখনীতে একাত্তরের সেসব বর্বর রাজাকারদের ভদ্রতার মুখোশ উন্মোচন করেছেন তাঁর এই গ্রন্থে।

একাত্তরে বৃহত্তর সিলেটে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ, রাজাকার-আলবদরদের অপরাধনামা, তাদের পরিচয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ, বৃহত্তর সিলেটের রাজাকার-আলবদরদের বিচার, বর্তমানে একাত্তরের সেসব কুখ্যাত রাজাকারদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে চলাফেরা করাথএসব কারণেই অপূর্ব শর্মার ‘সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র’ নামের গ্রন্থটি বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসের এক অনন্য সংকলন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের বৃহত্তর সিলেটের অনেক জানা অজানা তথ্য, সংবাদ ও লেখকের নিজস্ব ভঙ্গিমার বিশ্লেষণ পাঠককে নতুন করে অনেক কিছুই জানাবে। মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাস জানার জন্য ‘সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র’ বইটি অবশ্য পাঠ্য।

দৈনিক কালের কণ্ঠ : ১১ মার্চ ২০১০