এ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা অপূর্ব শর্মা

চৌধুরী ভাস্কর হোম: অপূর্ব শর্মা পেশায় সাংবাদিক। সিলেটের প্রাচীন দৈনিক যুগভেরী পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক। শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাও ইউনিয়নের হরিকান্দি গ্রামে জন্ম তার। বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবোজ্জল ও অহংকারের অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি। এ কারনেই অনেকে এ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা বলে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ না করেও গবেষণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অংশীদার কওে নিয়েছেন নিজেকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রেখে এবং প্রান্থিক পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি নিজেই অন্য এক উচ্চতায় পৌছেছেন। আর মুক্তিযুদ্ধেও ইতিহাসকে করছেন সমৃদ্ধ।

সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত ‘অপূর্ব শর্মার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা: প্রান্থজনের কথা’ শীর্ষক সেমিনারে এমনটি দাবি করে আরও বলা হয়েছে, ‘অধিকাংশ গবেষক প্রান্তিক মানুষের মুক্তিযুদ্ধকে এড়িয়েই গেছেন বলা যায়। তবে যেকজন তাঁদের গবেষণায় গ্রাম-শহরের সাধারণ মানুষ তথা প্রান্তিক মানুষকে লক্ষ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নবনির্মিত করতে চেয়েছেন, তাদের মধ্যে তরুণ গবেষক অপূর্ব শর্মা অন্যতম। …মনে হয় এটাই যেন তার দায় জাতির প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন গবেষণায় এমন কিছু অনুষঙ্গ এনছেন বা সত্যকে নির্মাণ করেছেন ইতিহাসের আলোয় যা তার জীবনের পক্ষেও ঝুঁকিপূর্ণ। …সুতরাং বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। সত্যিকার দেশপ্রেমিক তো বটেই।’ শুধু শাবিপ্রবির সেমিনারেই নয়, দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরাও একবাক্যে অপূর্ব শর্মাকে তাঁর কাজের জন্য অনন্য বলে থাকেন। সেই কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ২০১০ সালে সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র গ্রন্থের জন্য এইচএসবিসি কালি ও কলম তরুন সাহিত্য পুরস্কার, ২০১৩ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতায় বজলুর রহমান স্মৃতিপদক লাভ করেছেন তিনি। সিলেট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে …সালে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে তাঁকে।   

পেশায় সাংবাদিক অপূর্ব শর্মার মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হিসেবে যাত্রা শুরু হয় ২০০৯ সালে। সে বছর বইমেলায় তাঁর প্রথম গবেষণা গ্রন্থ অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের এক অসীম সাহসী যোদ্ধার সাথে তিনি জাতীকে পরিচিত করান। এই গ্রন্থ অবলম্বনে দৈনিক প্রথম আলোর ছুটির দিনে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আলোচনায় আসেন জগৎজ্যোতি। তাঁর এই গ্রন্থ মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রখ্যাত লেখক দ্বিজেন শর্মা দৈনিক সমকাল পত্রিকার কালের খেয়ায় লিখেন,‘ পরম যত্ন ও নিষ্ঠার সঙ্গে জগৎজ্যোতির সংগ্রামী জীবন ও সাহসিক যুদ্ধাভিযানের সবিস্তার বিবরণ সংগ্রহ করেছেন অপূর্ব শর্মা। দেশের জন্য মেলে ধরে এক অগ্নিসন্তানের বীরগাথা, যে-বই নতুন প্রজন্মকে পরিচিত করবে অনন্য এক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে।’

এরপর ২০১০ সালে তিনি তাঁর বহুল আলোচিত গ্রন্থ ‘সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র নিয়ে হাজির হন জাতীর সামনে। এই গ্রন্থের জন্য পুরস্কৃত হন অপূর্ব শর্মা। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হায়াৎ মামুদ তাঁর এই কাজকে ‘অপরিশুধ্য ঋণ’ বলে আখ্যায়িত করেন। ২০১১ সালের ৮ জুলাই দৈনিক প্রথম আলোতে তিনি লিখেন, ‘লেখক বিস্তৃত পাঠকশ্রেণীর পক্ষ থেকে নিরঙ্কুশ সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। নিজের প্রাণের তাগিদে প্রচুর সময় ও শ্রম ব্যয় করে তিনি তথ্যসংগ্রহ করেছেন; এই ঐকান্তিকতার জন্য তাঁর ঋণ অপরিশোধ্য বলেই মনে করি।’

এরপর একে একে অপূর্ব শর্মা লিখেন বীরাঙ্গনা-কথা (২০১৩), মুক্তিযুদ্ধের এক অসমাপ্ত অধ্যায়: ফিরে আসেনি ওরা (২০১৩), মুক্তিসংগ্রামে নারী (২০১৪), মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর (২০১৬), চা-বাগানে গণহত্যা : ১৯৭১ (২০১৬) ও মুক্তিযুদ্ধে সিলেট জেলা (২০১৭)। তন্মধ্যে অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি ও চা বাগানে গণহত্যা: ১৯৭১ গ্রন্থ দুটি অনুবাদ হয়েছে। অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্র গবেষক মিহিরকান্তি চৌধুরী।

অপূর্ব শর্মার লেখা গ্রন্থে যেমন উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে প্রান্থজনের বীরত্বগাথা, তেমনই উঠে এসেছে তাদের আত্মত্যাগের কাহিনী। এসব ঘটনার অনেকগুলোই এতদিন ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। বিগত ৪৫ বছর ধরে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া বীরাঙ্গনাদের আকুতি তিনি এমনভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন, যা পাঠে  চোখের জল আটকে রাখা কঠিন। হৃদয়ে ক্ষরণ হয় বীরাঙ্গনাদের বেদনাগাথায়। আর চা-বাগানে গণহত্যা ১৯৭১ গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি মুক্তিযুদ্ধের এমন একটি অধ্যায়কে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন যা এতদিন ছিলো একেবারেই লোকচক্ষুর অন্তরালে। এই বই প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক ‘অপূর্ব শর্মা ও তাঁর কাজ’ শিরোনামে সবুজের রক্তগাথা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন. ‘অপূর্ব শর্মা বাগানে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। অনেক শহীদের সাথি, সঙ্গীজন অথবা পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। কাজটি শ্রমসাধ্য, তবে এই কাজ তিনি করেছেন আন্তরিকতা ও সংবেদনশীলতা নিয়ে। এখানেই তাঁর সার্থকতা এবং তিনি কেবল গণহত্যার রূপ, প্রকৃতি ও সংখ্যাগত পরিসংখ্যান মেলে ধরেন নি, মানবিক ইতিহাসও নির্মাণ করেছেন।’

নিজের লেখা নিয়ে অপূর্ব শর্মার অভিব্যক্তি, তরুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্যই তিনি মাঠ পর্যায়ে গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর মতে, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস অনুসন্ধানের এখনই প্রকৃত সময়। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছেন আমাদের মাঝে। তাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সমৃদ্ধ করতে হবে ইতিহাস। যা খুবই জরুরী’

শুধু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনুসন্ধানই নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতেও নির্ভিক এই কলম সৈনিক সোচ্চার রয়েছেন। গণজাগারণ মঞ্চ থেকে শুরু করে স্বাধীনতার শত্রুদের বিচারের দাবির প্রতিটি প্লাটফর্মের সঙ্গেই যুক্ত রয়েছেন তিনি। তাঁর দাবি, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে কলংক মুক্ত করতে হবে জাতীকে। অন্যথায় ইতিহাস ক্ষমা করবে না আমাদের।’