মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির অসম সাহস ও বীরত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে জেগে থাকে মুক্তিযুদ্ধ। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে এই প্রজন্মের অনেকেই কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। তেমনি একজন দেশপ্রেমিক অপূর্ব শর্মা। তার লেখনীতে প্রমান হয়, তিনি কতটা দেশপ্রেমিক। আজকের এই অবস্থানে আসার গল্প শুনতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি শৈশবে কবিতা লিখতাম। কলেজে অধ্যয়নকালে কবিতার সঙ্গে যুক্ত হয় গল্প। কিন্তু এক পর্যায়ে সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। উপজেলা শহর শ্রীমঙ্গল থেকে শুরু করি সাংবাদিকতা। স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় লেখার সুবাদে সিলেট থেকে প্রকাশিত প্রাচীন সংবাদপত্র দৈনিক যুগভেরীতে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে ২০০১ সালে যোগদান করি। পরবর্তীতে যুগভেরীর চিফ রিপোর্টার ও বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর বর্তমানে নির্বাহী সম্পাদক পদে কর্মরত। এ ছাড়াও ২০০৪ সালে দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে নিয়োগলাভ এবং পরবর্তীতে সিলেট বিভাগের ব্যুরো হিসেবে, বন্ধন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছি। সাপ্তাহিক ‘২০০০’ বিভাগীয় প্রতিনিধি এবং অনলাইন দৈনিক ‘শীর্ষ নিউজ’-এ ব্যুরো চীফ হিসেবে বর্তমানে দায়িত্বরত। ছোটবেলা থেকেই আমার বই পড়ার শখ। তার মধ্যে ইতিহাসভিত্তিক বইয়ের প্রতিই আমার আগ্রহ ছিল বেশি। মূলত, মুক্তিযুদ্ধের বই পড়তে গিয়েই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখির সূত্রপাত। পরবর্তীতে তার সঙ্গে যুক্ত হয় প্রবন্ধ। সাংবাদিকতা লেখালেখির ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। সাংবাদিকতাই আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে আমাকে।’ লেখালেখির শুরুটা কিভাবে হয়েছিল জানতে চাইলে অপূর্ব শর্মা মৃদু হেসে বলেন, ‘শুরুটা হয়েছিল কবিতা দিয়ে ১৯৯৮ সালে। প্রায় একই সময়ে কলেজ ম্যাগাজিনে একটি গল্প ছাপা হয়। ‘অপুর চিঠি’ নামের ওই গল্পটি ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের দ্বারা বিপুল প্রশংসিত হয়। এরপর বেশ কিছুদিন কবিতা লিখি। পরবর্তীতে অনেকটা কাকতালীয়ভাবে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। সাংবাদিকতার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার পর সৃজনশীল লেখালেখির দিকে মনোনিবেশ করি।’ তার প্রথম কবিতা ‘স্বপ্ন ’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে মৌলভীবাজার থেকে প্রকাশিত ‘মনুবার্তা’ পত্রিকায়। আর তার লেখা প্রথম বই ‘অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি’ ২০০৯ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয়। জগৎজ্যোতির দুঃসাহসিক বীরত্ব, গেরিলা যুদ্ধের একান্ত নিজস্ব পরিকল্পনা, আত্মোৎসর্গ এবং সর্বোপরি তার বঞ্চনার কাহিনি তাকে জগৎজ্যোতির প্রতি বলতে গেলে মোহাবিষ্ট করে তুলেছিল। তা ছাড়া প্রথম সর্বোচ্চ খেতাবের ঘোষণা ও তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত নানা কিংবদন্তি তাকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করে। বইটি বিপুল প্রশংসিত হয় পাঠকসমাজে। একটি লেখা সম্পন্ন হবার পর আপনার মনে আনন্দের হাসি খেলা করে মনোভূমিতে। অপেক্ষায় থাকেন কবে তা মলাটবদ্ধ হবে। লেখালেখির ক্ষেত্রে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশের কবিতা তার মনের মধ্যে অনুরণন তুলত। সেই অনুরণনই তাকে কবিতা লেখার প্রতি আগ্রহী করে তোলে।

‘এইচএসবিসি কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার-২০১০ পাওয়ায় তার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুরস্কার প্রাপ্তিটা অবশ্যই আনন্দের। পুরস্কার লেখককে দায়বদ্ধ করে। এ ছাড়া পুরস্কার নিজের সৃষ্টির স্বীকৃতিও বটে। একটি বই প্রকাশের পর পাঠকের কাছ থেকে আপনি কেমন সাড়া পান ? এমন প্রশ্নের জবাবে অপূর্ব শর্মা বলেন, ‘যেহেতু আমি অনুসন্ধানী বা গবেষণাধর্মী কাজ করি, সেহেতু এর পাঠক নির্দিষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আনন্দের বিষয় হচ্ছে, আমার এ পর্যন্ত প্রকাশিত ৭টি গ্রন্থের প্রায় প্রতিটিই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। পাঠকদের বিপুল সাড়া আমাকে নতুন নতুন কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করছে।’ অনেক বই-ইতো বাজারে পাওয়া যায় আপনার বইয়ে এমন কি রহস্য আছে- যে কারনে পাঠক আপনার বইটি পড়তে আগ্রহী হবে। তার উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমি সবসময়ই ব্যতিক্রম। বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাস তুলে ধরাই আমার লেখনীর মূল উদ্দেশ্য। কৌতূহলী পাঠকরা সে বিষয়টিকেই পছন্দ করেন।’ এপর্যন্ত তার লেখা ৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া সম্পাদনা করেছেন দুটি বই। এরমধ্যে ২০০৯ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয়-‘অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি’। বইটি বের করে সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা। ২০১০ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয়-‘সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র’, ‘বিপ্লবী অসিত ভট্টাচার্য’ ও ‘বাউল সম্রাট’(সম্পাদনা)। এই তিনটি বই প্রকাশ করেছে ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ, ঢাকা। এছাড়া ২০১০ সালের জুন মাসে ‘সিরাজুন্নেসা চৌধুরী জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ’ (যৌথ সম্পাদনা) প্রকাশিত হয়। গত বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে দুটি বই-‘মুক্তিপথের অভিযাত্রী আমিনূর রশীদ চৌধূরী’ ও অভিজাত গণতন্ত্রী আবদুর রশীদ চৌধুরী’। দুটি বই-ই প্রকাশ করেছে সাহিত্য প্রকাশ।
একজন লেখক হিসেবে পাঠকসমাজের প্রতি আপনি কী দায়বদ্ধতা অনুভব করেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেটা হচ্ছে কোনোভাবেই সত্য গোপন করা যাবে না। আমি মনে করি সত্যটা জানার অধিকার পাঠকের আছে। আর তা যদি গোপন করা হয়, তাহলে তা হবে প্রতারণার শামিল।’ জীবনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কখনও কি কোনো বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন? উত্তরে অপূর্ব শর্মা বলেন, কখনও মৌলবাদীদের হুমকিধামকি, কখনোবা প্রশাসনের চোখ রাঙানি-এসব কিছু উপেক্ষা করেই পথ চলতে হচ্ছে আমাকে। ২০০৪ সালে সিলেটে হযরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারে আনোয়ার চৌধুরীকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। স্থানীয় জঙ্গিদের এর সাথে সম্পৃক্ততার বিষয়টি তুলে ধরে দৈনিক ‘আজকের কাগজ’ ও ‘যুগভেরী’ পত্রিকায় রিপোর্ট করার কারনে মৌলবাদীরা আমাকে প্রকাশ্যে জনসভায় দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। একই সময়ে আমিসহ সিলেটের ১৭ সাংবাদিককে বোমা মেরে হত্যার হুমকি দেয় জঙ্গিরা। ২০০৭ সালের ১/১১ পরবর্তী সময়ে দূর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে, বিশেষ করে প্রশাসনের দূর্নীতিবাজদের নিয়ে লেখার কারনে আমাকে বিপাকে ফেলার ফন্দি আঁটা হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কোনো অভিযোগ ছাড়াই আমাকে গ্রেফতার করে। এ কারণে প্রায় পাঁচ মাস কারান্তরীণ থাকতে হয় আমাকে।’ সেই অবস্থা থেকে উৎরানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি জানি অন্যায় কখনো ন্যায়ের পথচলা থামাতে পারে না। আমার পথচলা সত্যের পক্ষে। সত্য সব সময়ই সুন্দর। সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকা যায় না। শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হয়। এই বিশ্বাসই আমাকে প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আগামীর পথে অগ্রসর হতে সহায়তা করে। ’ লেখালেখি এবং পেশা নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কথা জানতে চাইলে অপূর্ব শর্মা বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যেগুলো এখনও বিস্তৃত পরিসরে উঠে আসেনি। এমন অনেক গৌরবগাথা রয়েছে, যা বিস্মৃত হতে চলেছে। এসব বিষয় নিয়ে কাজ করতে চাই। তা যত দীর্ঘই হোক।
লেখক : ফিচার ইনচার্জ, দৈনিক ইত্তেফাক : প্রকাশকাল, ৩০ এপ্রিল ২০১১, দৈনিক ইত্তেফাক