মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের দেশে যে ক’জন ব্যক্তি গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন অপূর্ব শর্মা তাদের মধ্যে অন্যতম। নিভৃত ও আড়ালে পড়ে থাকা ইতিহাসের চুর্ণাংশ তুলে আনার অদম্য প্রত্যয় ও নেশা থেকেই তিনি প্রবাহমান রেখেছেন তার অনুসন্ধানের গতিধারা। চারণ গবেষকের মতো মাঠ পর্যায়ে বিচরণ করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিস্মৃত হতে চলা অনেক বিষয়কে তিনি সযতনে তুলে এনে তা জাতির সামনে উপস্থাপন করছেন সাবলীল ভাষায়। যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করে চলেছে। কঠোর পরিশ্রমী অপূর্ব শর্মা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে নিজেকেও আসীন করেছেন অনন্য উচ্চতায়। গবেষণা কর্মের স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি।
অপূর্ব শর্মার জন্ম ১৯৭৯ সালের পহেলা মার্চ। পিতার নাম অতূল শর্মা, মায়ের নাম রাধা রানী শর্মা। পৈত্রিক নিবাস মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানার হরিনাকান্দি গ্রামে। কবিতার মাধ্যমেই লেখালেখিতে হাতেখড়ি তার। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক মনুবার্তা পত্রিকায়, ১৯৯৮ সালে। শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজে অধ্যয়নকালেই তিনি যুক্ত হন সাংবাদিতার সাথে। কিন্তু সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিলেও নিজের আগ্রহ ও নেশার বিষয় লেখালেখি থেকে কখনো এতটুকু দূরে সরেননি। নিবিষ্টমনে চালিয়ে যেতে থাকেন চর্চা। জন্মস্থান শ্রীমঙ্গলে সাংবাদিকতা শুরু করলেও পরবর্তীতে ২০০১ সালে পাড়ি জমান সিলেটে। যোগ দেন দৈনিক যুগভেরী পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে। সাংবাদিকতা ও লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকেন সমানতালে। কবিতাচর্চায় (কাব্যচর্চায়) আত্মমগ্ন থাকা অপূর্ব শর্মা, সময়ের সাথে সাথে লেখালেখির অন্যান্য শাখায়ও বিচরণ করতে শুরু করেন। ইতিহাসচর্চা তাকে গবেষণার প্রতি আকৃষ্ট করে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণায় তিনি এতটাই আত্মমগ্ন হয়ে পড়েন, একসময় এটি তার লেখার অন্যতম বিষয়ে পরিনত হয়। তার লেখা প্রথম গবেষণাগ্রন্থ ‘অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি’ ২০০৯ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয়। প্রথম গবেষণাতেই এই অঙ্গনে নিজের অবস্থান তৈরি করে নেন তিনি। ‘অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি’ গ্রন্থ অবলম্বনে দৈনিক প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’ কাভার স্টোরি করে। সাহিত্যিক দ্বিজেন শর্মা, কবি দিলওয়ার, প্রফেসর আবদুল আজিজ, গবেষক শেখ ফজলে এলাহী প্রমুখ-বইটির ভূয়সি প্রশংসা করে আলোচনা করেন। আর দ্বিতীয় গবেষণায় অর্জন করেন দেশসেরা তরুণ গবেষকের মর্যাদা। সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র গবেষণাগ্রন্থের জন্য ২০১০ সালের এইচএসবিসি কালি ও কলম পুরস্কার লাভ করেন তিনি। বইটিতে সিলেটের পাঁচশতাধিক যুদ্ধাপরাধীকে মলাটবন্ধি করেছেন তিনি। তাদের যুদ্ধাপরাধের বিবরণ ও দালিলিক প্রমান এতে উত্থাপন করেছেন তিনি। প্রখ্যাত লেখক প্রফেসর হায়াৎ মামুদ তার এই কাজকে ‘অপরিশোধ্য ঋন’ হিসেবে অখ্যায়িত করেছেন। ২০১১ সালের ৭ আগস্ট দৈনিক ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় এই গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি এই অভিমত ব্যক্ত করেন। একই বছর প্রকাশিত হয় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূর্যসৈনিক অসিত ভট্টাচার্যকে নিয়ে তার লেখা জীবনী গ্রন্থ ‘বিপ্লবী অসিত ভট্টাচার্য’। ২০১১ সালে সাহিত্য প্রকাশ থেকে বের হয় মুক্তিপথের অভিযাত্রী আমীনূর রশীদ চৌধূরী ও অভিজাত গণতন্ত্রী আব্দুর রশীদ চৌধুরী। গ্রন্থ দুটি সুধি মহলে বিপুল প্রশংসিত হয়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশগঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী সাংবাদিকতার দিকপাল আমিনূর রশীদ চৌধূরী ও দৈনিক ‘যুগভেরী’র প্রতিষ্ঠাতা, আসাম ব্যবস্থাপনা পরিষদ সদস্য আবদুর রশীদ চৌধুরীর পূর্নাঙ্গ জীবনী গ্রন্থ অপূর্ব শর্মার গবেষণার পরিধিকেই বিস্তৃত করেনি, নিষ্ঠাবান গবেষক হিসেবে পরিচিত করে অনুসন্ধানী পাঠক মহলে।
২০১৩ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয় তার আরেক সাড়া জাগানো গ্রন্থ বীরাঙ্গনা-কথা। সাহিত্য প্রকাশ কতৃক প্রকাশিত বইটি বাজারে আসার সাথে সাথেই বিপুল প্রশংসিত হয়। কালি ও কলম পত্রিকায় বইটি নিয়ে আলোচনা করেন চঞ্চল শাহরিয়ার। সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির ক্ষেত্রে বইটিকে রেফারেন্স বুক হিসেবে কাজে লাগায়। অনেকে বইটিকে ড. নিলিমা ইব্রাহিমের লেখা আমি বীরাঙ্গনা বলছি গ্রন্থের সাথে তুলনা করে থাকেন। একইসালে প্রকাশিত হয় তার ‘মুক্তিযুদ্ধের এক অসমাপ্ত অধ্যায়: ফিরে আসেনি ওরা’ গ্রন্থটি। প্রকাশনা সংস্থা গদ্যপদ্য প্রকাশ করে এটি। গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য সংযোজন। মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের নিয়ে মর্মস্পর্শী বয়ানে লেখা বইটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য সংযোজন।
২০১৪ সালের বইমেলায় শুদ্ধস্বর বের করে তার ‘মুক্তিসংগ্রামে নারী’ গ্রন্থটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নারীদের ভূমিকা বিধৃত হয়েছে বইটিতে।
২০১৬ সালে তার লেখা চারটি বই প্রকাশিত হয়। এরমধ্যে প্রবন্ধ বিষয়ক দুটি এবং দুটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক। প্রায় দেড় দশক ধরে প্রবন্ধ লিখলেও ‘সুর শব্দের ধ্রুবতারা’ এবং ‘সাহিত্য সংস্কৃতি ও অন্যান্য’ গ্রন্থের মাধ্যমে প্রথমবারের মত মলাটবন্দি হয় তার প্রবন্ধ।

‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর’ এবং ‘চা-বাগানে গণহত্যা’ গ্রন্থ দুটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণায় তার সর্বশেষ সংযোজন। এরমধ্যে ‘চা বাগানে গণহত্যা’ গ্রন্থটি বিপুল প্রশংসিত হয়েছে। এই গ্রন্থের প্রকাশনা উপলক্ষে গত ১৭ মে (২০১৬) মদনমোহন কলেজ সাহিত্য পরিষদ ‘সবুজের রক্তগাথা’ নামে একটি প্রকাশনা স্মারক বের করেছে। স্মারকটি সম্পাদনা করেছেন মদনমোহন কলেজের অধ্যক্ষ ডক্টর অধ্যাপক আবুল ফতেহ ফাত্তাহ ও মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির পরিচালক (অর্থ) ও রবীন্দ্র গবেষক মিহিরকান্তি চৌধুরী। এই গ্রন্থে ১৮ জন লেখক মূল্যায়ন করেছেন অপূর্ব শর্মার কাজ। এছাড়াও বইটি নিয়ে সাহিত্য পত্রিকা ‘কালি ও কলম’ এবং ‘শব্দঘর’-এ গ্রন্থালোচনা বের হয়েছে।
পরিশ্রমী সম্পাদক
লেখালেখি, গবেষণা এবং সাংবাদিকতার পাশাপাশি সম্পাদনায়ও রয়েছে অপূর্ব শর্মার মুন্সিয়ানার ছাপ। শুধু দৈনিক যুগভেরী সম্পাদনাই নয়, সাহিত্যপত্রিকা, স্মারক সংখ্যা, সন্মাননাগ্রন্থ সম্পাদনায় তিনি সিদ্ধ হস্ত। বয়সে তরুণ হলেও মেধায় মননে প্রজ্ঞায় তিনি নিজেকে অন্যতর আসনে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। কর্মনিষ্ঠা এবং একাগ্রতার ফলে নিজ সম্পাদনার পরিধিকেও তিনি বিস্তৃত করেছেন বহুদূর।
পত্রিকা ও সাময়িকী সম্পাদনার সাথে যুক্ত থাকলেও তার সম্পাদিত প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ২০১২ সালের বইমেলায়। বাউল শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে তার সম্পাদনায় ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ বের করে ‘বাউল স¤্রাট’ নামের প্রবন্ধ গ্রন্থ। একই বছরের জুন মাসে ইত্যাদি থেকেই বের হয় মহিয়সী নারী ‘সিরাজুন্নেসা চৌধুরী জন্মশতবর্ষ স্মারক’ গ্রন্থ। যৌথভাবে স্মারকটি সম্পাদনার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি।
প্রতিবছর ঢাকা থেকে জাতীয় দৈনিক এবং সাপ্তাহিকগুলোর ঈদসংখ্যা প্রকাশ যেনো সংস্কৃতিতে পরিনত হয়েছে। রাজধানীকেন্দ্রিক এই সাহিত্যচর্চা অব্যাহত থাকলেও সিলেট থেকে কোনো ঈদসংখ্যা বের না হওয়া ছিল এই অঞ্চলের সাহিত্যিকদের কাছে অনুতাপের বিষয়। এই বন্ধ্যাত্ব দূরে উদ্যোগি হন অপূর্ব শর্মা। তার উদ্যোগে ২০০৯ সালে দৈনিক যুগভেরী র ঈদসংখ্যা বের হয়। স্থানীয় কোনো দৈনিক পত্রিকার উদ্যোগে এটিই ছিলো সিলেট থেকে প্রকাশিত প্রথম কোনো ঈদসংখ্যা। এরপর ২০১০, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে যুগভেরীর ঈদসংখ্যা বের হয়েছে। প্রতিটি ঈদসংখ্যায় অঞ্চল সাধনার একটি প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে। সিলেট বিভাগের লেখকদের প্রাধান্য দিয়ে বের করা হয়েছে এই সংখ্যাগুলো। এতে ইতিহাস, ঐতিহ্যের পাশাপাশি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, স্মৃতিচারনসহ সাহিত্যের অন্যান্য বিষয় যেমন গুরুত্ব পেয়েছে, তেমনি এই অঞ্চলের সাহিত্যচর্চাকে বেগবান করতে এই সংখ্যাগুলোর গুরুত্বও কোনো অংশে কম নয়। ২০১৬ সালের শুরুতে একই উদ্দেশ্যে তিনি সম্পৃক্ত হন সাহিত্য পত্রিকা অভিমতের সাথে। লন্ডন-সিলেটের যৌথ প্রকাশনার এই ম্যাগাজিনে সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে।
তার সম্পাদিত অভিমতের সংখ্যাগুলো যেমন বৈচিত্রে ভরপুর তেমনি সম্পাদনায়ও রয়েছে আধুনিকতার ছাপ। সাহিত্য সংস্কৃতিতে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সমন্বয়ের চেষ্টাও লক্ষ্য করা যায় অভিমতের পাতায়।
অপূর্ব শর্মার সম্পাদনার অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে সত্য প্রকাশে সাহসিকতা। সম্পাদনার ক্ষেত্রে অনেক সম্পাদককে আপোষকামী হতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে তিনি নির্ভার। লেখকের পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন তিনি। সেজন্য লেখকরা সাচ্ছন্দবোধ করেন তার সম্পাদনায়।
এক কথায় বলতে গেলে অপূর্ব সব কাজ করে চলেছেন অপূর্ব শর্মা। বিষয়বৈচিত্র ও উপস্থাপনায় নান্দনিকতা তার এক একটি গবেষণাকে করে তুলেছে অনবদ্য। একজন কাব্যপ্রাণ, দক্ষ সংবাদকর্মী অপূর্ব শর্মা নিত্য হেঁটে চলেছেন ইতিহাসের নিভৃত আনাচে-কানাচে। তার এই যাত্রাপথ অগনিতকাল অব্যাহত থাকুক-এমনটিই প্রত্যাশা।