স্বপন নাথ: অপূর্ব শর্মা পেশায় সাংবাদিক এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ইতিহাস চর্চায় নিবিষ্ট একজন লেখক। যিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা ও সাংবাদিকতায় কালি ও কলম তরুণ লেখক এবং বজলুর রহমান স্মৃতি পুরস্কার অর্জন করেছেন। ফলে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে লেখালেখিতে তাঁর একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তিনি তৈরি করে নিয়েছেন। তাঁর লিখিত ও প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর আলোচনা প্রাসংগিক একারণে যে, ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন লেখা বা বই থাকলেও তৃণমূল পর্যায়ে তথ্যবহুল গবেষণা অপ্রতুল। পাঠক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধে ব্যক্তিগত অবদান বর্ণনার বহু লেখা সুলভ। সেক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে তথ্য- উপাত্ত সংগ্রহকৃত পূর্ণাঙ্গ সংকলন আরও প্রকাশ হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। তৃণমূল পর্যায়ে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ বা গবেষণাকর্মে নিয়োজিত রয়েছেন, তাঁদের সংগে সৃজনশীল ব্যক্তি অপূর্ব শর্মার নামও যুক্ত হলো। আঞ্চলিক পরিসরে হলেও তিনি উদাহরণতুল্য কাজ করে চলেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেমন ছিলো, কীভাবে, কী ত্যাগ করেছেন এদেশের সাধারণ মানুষ; এসব তৃণমূল পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমেই জানা সম্ভব। তা ছাড়া যাঁরা শরণার্থী না হয়ে মাটি কামড়ে রয়ে গেছেন সেসময়, তাঁরা কীভাবে দিন অতিবাহিত করেছেন বৈরি পরিবেশে এটি জানা অবশ্যই প্রয়োজন। এসূত্রে জনমানুষের সংগ্রাম, বেঁচে থাকার লড়াই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবেই বিবেচিত। প্রসংগত, যাঁরা মাঠে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, তাঁদের অনেকেই নিভৃতে রয়েছেন, অনেকেই কষ্ট বুকে চেপে রেখে পরিচয় গোপন রাখেন নানা কারণে। মুক্তিযুদ্ধে সম্পদ-সম্পত্তি ও স্বজন হারিয়ে ’৭১-এর পর অনেকে নিঃস্ব হয়েছেন, তাদের আর্থিক ও সামাজিক শক্তি ক্ষয় হয়েছে। ফলে, সাহসে আর দাঁড়াতে পারেননি। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষালম্বনকারী মানুষের এ আর্থ-সামজিক সমস্যা হয়তো অনেকেই বিবেচনা করেন না। এসব বিষয়ও অপূর্ব শর্মা তাঁর গ্রন্থগুলোতে নিয়ে এসেছেন। যে স্বপ্নে ও বাসনায় মৃত্যু জেনেই যুদ্ধে গেছেন, তাঁরা এদেশে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বিশেষত ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী পরিস্থিতি আশা করেননি।

লেখক অপূর্ব শর্মা নিজে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করে কয়েকটি বই লিখেছেন। সংগ্রহ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক ও শহিদ পরিবারের উত্তরাধিকারী এবং সহযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার। একইসংগে সেসময়ের পত্র-পত্রিকা ও অন্যান্য দলিল পর্যবেক্ষণ করেছেন নিজের তথ্য প্রতিপাদনে। তাঁর আলোচিত গ্রন্থসমূহে তিনি অনেক অজানা তথ্য দিয়েছেন, যা আমরা এর আগে কখনও পাই নি। ঘটনা পূর্বাপর বর্ণনায় নির্মোহ থাকার চেষ্টা করেছেন। বলাবাহুল্য যে, লেখক অপূর্ব শর্মা এ বিবেচনায় অসামান্য কাজ করেছেন।
অপূর্ব শর্মা লিখিত ও প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো : অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি (২০০৯/২০১৪), সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র (২০১০), ফিরে আসেনি ওরা : মুক্তিযুদ্ধের এক অসমাপ্ত অধ্যায় (২০১৩), বীরাঙ্গনা কথা (২০১৩) মুক্তিসংগ্রামে নারী (২০১৪), চা বাগানে গণহত্যা : ১৯৭১(২০১৬), মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর (২০১৬)।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর শিরোনামা থেকেই সহজে বোঝা যায় কোন বিষয়ে তাঁর আগ্রহ বেশি এবং তিনি কী লিখেছেন ও কী নিয়ে লিখতে চান। শিরোনামা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে দুটি বিষয় প্রথমত : লেখা ও ভাবনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে নিষ্ঠা, দ্বিতীয়ত : তৃণমূলে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা ও ইতিহাসের সত্য উন্মোচিত করা। কারণ, আমরা জানি ইতিহাসের ডামাঢোলে মৌল সত্য অনেকক্ষেত্রে চাপা পড়ে যেতে পারে। কালে- কালান্তরে খুব বেশি আমরা লক্ষ করেছি যে, প্রতাপ ও শক্তির চাপে নিম্নবর্গের ইতিহাস হারিয়ে যায়। কৃত্রিম ভাষার প্রলেপে ইতিহাসের লুকানো কথা আর স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাবলি প্রসংগে সাধারণ মানুষের কাছে ধুম্রজাল সৃষ্টিকারী নানা কথা প্রচার ও প্রসার করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। অনেকেই যে যার মতো করে ইতিহাসের পাঠ তৈরি করেছেন। মনে রাখা আবশ্যক যে, মুক্তিযুদ্ধই হলো এদেশের জাতিরাষ্ট্রের উৎসসূত্র। জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধই হলো ভিত্তি। সে কারণে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, চেতনা ও ঐতিহ্যের পথ ধরেই নির্মিত হবে আমাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা। ওই বিষয়টি ধারণ না করা হলে ইতিহাসের তথ্য ও উপকরণ বিশ্লেষণে, প্রচারে ও বক্তব্যে বিভ্রান্তি থাকাটাই স্বাভাবিক।

গ্রামবাংলার নিভৃত অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনি ও এদেশীয় সহায়তাকারী রাজাকার-আলবদর বাহিনি নির্যাতন, হত্যায় ছিলো সক্রিয়। সেক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ের উপকরণই হতে পারে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার আকর-উৎস। আঞ্চলিক ইতিহাসের উপকরণ বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় অঞ্চলভিত্তিতে সঠিক তথ্য ও উপকরণ ব্যাপক অবদান রাখবে বলে মনে করি। এছাড়াও তৃণমূলের ইতিহাসেই প্রমাণিত হবে এদেশের মানুষ কেন, কী কারণে যুদ্ধে গেলো এবং এ বিষয়ক বিভ্রান্তি দূর করতে সহায়ক হতে পারে। বস্তুত, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষা বিশ্লেষণে জনমানুষের সম্পৃক্ততার বৈশিষ্ট্য জানাবোঝা আবশ্যক। শুধু ইতিহাস রচনা নয়, মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে শুরু হওয়া ঘটনাবলির লক্ষণ, চারিত্র্য বোঝার জন্য এ তৃণমূলের খন্ড খণ্ড ঘটনা জানা জরুরি। এক্ষেত্রে আমরা অপূর্ব শর্মার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করি।
তিনি ইতিহাসের ঘটনা উল্লেখ বা বিবরণে স্থির থাকেননি। বিষয় ও ঘটনাবলির উপস্থাপনে ভাষার মাধ্যমে বর্ণনায় প্রাণ সঞ্চার করেছেন। ফলে, বহুরৈখিক ট্্রাজিক বিষয়ও হয়ে উঠেছে প্রাণময় ও প্রাঞ্জল। যা পাঠককে ক্লান্ত করে না। বার বার পর্যবেক্ষণে, পঠনে নিবিষ্ট রাখে। অন্যদিকে তৃণমূলেই প্রতিপাদিত হবে ইতিহাসের পথরেখা, মূল্যবোধ ও আদর্শকেন্দ্রিক নির্দেশনা- এর মাধ্যমে লক্ষ্য স্থির করা সহজ। সে নিরিখে অপূর্ব শর্মার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর পর্যালোচনায় এ যুক্তির প্রাসংগিকতা প্রমাণিত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি
প্রচ্ছদ : অশোক কর্মকার
প্রকাশকাল : ২০০৯/২০১৪
প্রকাশক : সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা
মূল্য : ১৫০.০০ টাকা।
অনন্য সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধার জীবনালেখ্য। আমরা পাঠক হিসেবে পত্রিকায় ফিচারধর্মী বিভিন্ন পাঠ থেকে জানতে পারি সিলেট এলাকায় একজন দুরন্ত, সাহসী যোদ্ধা ছিলেন জগৎজ্যোতি দাস। যিনি হবিগঞ্জের হাওরাঞ্চলে সাহসের সাথে যুদ্ধ করে শহিদ হয়েছেন। জগৎজ্যোতির যুদ্ধজীবন পড়ে কল্পনাই করা যায় না যে, এভাবে কেউ সাহসী হতে পারে। আসলে সময় ও পরিস্থিতি মানুষকে নির্মিত করে। জ্যোতি সে রকমই একজন, সময়ের সাহসী সন্তান। দেশের জন্যে স্বেচ্ছায় যিনি মৃত্যুকে বরণ করতে পারেন। আমরা ভাবতে পারি, এরকম অনেক সাহসী যোদ্ধা ১৯৭১ সালে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁদের কয়েকজনকে জানি মাত্র, তবে অনেকে রয়ে গেছেন আড়ালে। এ বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনী লিখে অসামান্য কাজটি সম্পন্ন করেছেন লেখক অপূর্ব শর্মা। পাঠক হিসেবে তাঁর জীবনী পাঠে আবেগাপ্লুত হয়েছি, অভিভূত হয়েছি। লেখক জগৎজ্যোতির যুদ্ধকালীন কথা শুধু বলেননি, তিনি তাঁর বাল্য-শৈশব, কিশোর বয়সের ব্যক্তিবৈশিষ্ট্য, তাঁর স্বজন, সহযোদ্ধার কথাও এখানে উল্লেখ করেছেন। ফলে, এ জীবনী আরও বেশি তথ্যসমৃদ্ধ ও প্রামাণিক হয়ে উঠেছে।
জগৎজ্যোতির জন্ম আজমিরিগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামে। সেখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা। জ্যোতি কিশোর বয়সেই রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠেন। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে লেখাপড়ার সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি ও তাঁর এলাকায় খাসজমি আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। সেসময় ওই ভাটি অঞ্চলের অধিকাংশ জমি ছিলো জোতদার, প্রভাবশালীদের দখলে। এ আন্দোলনে যুক্ত হলে তিনি নিজ এলাকা আজমিরিগঞ্জেই নির্যাতনের শিকার হন। ১৯৭১ সাল জ্যোতি শিলং-এ ট্রেনিং গ্রহণের পর সুনামগঞ্জের টেকেরঘাটে সাব-সেক্টরের সংগে যুক্ত হন। সেখানে বাছাই করেন সহযোগী ৪২জন যোদ্ধা। সাহসী ও চৌকস কয়েকজনকে নিয়ে তৈরি করেন স্বীয় দাস পার্টি। এ যেন বিপ্লবী দলের মতো বিশেষ গেরিলা বাহিনি। সে সময় সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ এলাকায় যাতায়াতের জন্য একমাত্র মাধ্যম ছিলো জলযান। কমাণ্ডার জগৎজ্যোতির নেতৃত্বে অনেকগুলো সফল ও দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালিত হয় বিভিন্ন স্থানে। বানিয়াচং, পাহাড়পুর ভেড়ামোহনা, আজমিরিগঞ্জ থানা, বদরপুর, জামালগঞ্জ থানা, শ্রীপুর, খালিয়াজুরি, রাণীগঞ্জ, কাদিরগঞ্জ, দিরাই-শাল্লা, শাহজিবাজার-আশুগঞ্জ প্রভৃতি। লেখক অপূর্ব শর্মা ব্যক্তি ও মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতির যেসকল তথ্য-উপাত্ত উল্লেখ করেছেন, তাতে লক্ষণীয়, এরকম যোদ্ধা ১৯৭১ সনে খুব অল্পই পাওয়া গেছে। শেষ অপারেশনের বর্ণনায় লেখক জানাচ্ছেন, ‘‘যুদ্ধস্থলে কেবল ইলিয়াস আর জ্যোতি। চারদিকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি আর গুলি। তখনো ইলিয়াসের শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। উদ্বিগ্ন জ্যোতি। আশে পাশে কেউ নেই। সুযোগ নেই গুলি করে পিছু হটারও। ইলিয়াস জিগ্যেস করেন, কি করবো দাদা? নিরুত্তর জগৎজ্যোতি। পুনরায় নিচুস্বরে যোদ্ধা ইলিয়াস বলেন, ‘চলো আমরা আত্মরক্ষা করি?’ তেজোদীপ্ত হয়ে বীরকণ্ঠে জ্যোতি বলেন, ‘পালাবো না, সবকটাকে শেষ করে যাব’ … বিকেল পৌনে পাঁচটা নাগাদ একটি বুলেট বিদ্ধ হয় জ্যোতির শরীরে, সুঠাম দেহের প্রাণবন্ত জ্যোতি শেষবারের মতো চিৎকার করেন, ‘আমি যাইগ্যা’।’’ (পৃ ৫৬)
লেখক উল্লেখ করেছেন এ বীরযোদ্ধার নামে সুনামগঞ্জে পাবলিক লাইব্রেরির নামকরণ করা হলেও কোনও বড় জাতীয় পদক তাঁকে দেওয়া হয়নি এমনকি হবিগঞ্জের স্মৃতিস্তম্ভেও তাঁর নাম নেই। এখনও ওই অঞ্চলে দাস পার্টি ও শহিদ জগৎজ্যোতির ভূমিকার কথা সকলে স্মরণ করে। লেখক অপূর্ব শর্মা শুধু শহীদ জগৎজ্যোতির ওপর তথ্য সংগ্রহ করে জীবনী লিখেননি, পুরো জাতির পক্ষে যথার্থ দায়িত্ব পালন করেছেন।
সিলেটে যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র
প্রচ্ছদ : সমর মজুমদার
প্রকাশকাল : ২০১০
প্রকাশক : ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা
মূল্য : ২০০.০০ টাকা।
১৯৭১ সনের মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহিদ ও দু-লক্ষ মা বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। সকলেই জানেন এ গণহত্যা পৃথিবীতে বিরল। নির্মমভাবে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। একাত্তরে সারা বংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনি ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার আলবদর বাহিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক গণহত্যা পরিচালনা করে। স্বাধীনতা উত্তরকালে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর এ বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে হয়ে যায়। ১৯৯৬ সনে শেখ হাসিনার নেতৃৃত্বে মহাজোট সরকার গঠনের পর এ যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে পুনরায় তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০০৯ সনে আবার বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে বিচার প্রক্রিয়া গতিশীল হয় এবং ক্রমান্বয়ে বিচারের রায় বাস্তবায়ন শুরু হয়। গণহত্যায় জাতীয় পর্যায়ে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের কয়েকজনের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। ইতোমধ্যে রায় ঘোষণার পর কারান্তরালে যুদ্ধাপরাধী কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে। এ সময়েই গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই লিখিত হয়। মূলত, এ বিচার প্রক্রিয়াই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণায় লেখকদের উৎসাহ যোগায়। লেখক অপূর্ব শর্মা লিখিত গ্রন্থটি যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে একটি অনন্য দলিল। যা এ-প্রজন্মকে যুদ্ধাপরাধ ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নতুনভাবে জানতে উৎসাহ যোগাবে। এ গ্রন্থটি ১১টি অধ্যায়ে বিভক্ত : শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনির গঠন প্রক্রিয়া, আলবদর বাহিনি গঠনের পটভূমি, দালাল অধ্যাদেশ, বিচার ও বাস্তবতা, যেভাবে থমকে গেল বিচার প্রক্রিয়া, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে হাজিরা দিয়েছিল যারা, সিলেটে বিচার হয়েছিল যাদের, ৭১-এ ঘাতক দালালদের সিলেটে সভা-সমাবেশ, গ্রেফতার হয়েছিল যারা, স্বাধীন দেশে বেপরোয়া যুদ্ধাপরাধীরা, সুনামগঞ্জের দালাল-রাজাকারদের হাজির হওয়ার নির্দেশ। পরিশিষ্টাংশে বিচার বন্ধের সামরিক ডিক্রি ও রাজাকার আলবদর বাহিনির কর্মতৎপরতার আলোকচিত্র সংযোজিত হয়েছে। লেখক শুধু শান্তি কমিটির নামে পরিচালিত অপরাধের বিবরণ দেননি। ’৭১ সনে ৯ মাসব্যাপী তাদের তৎপরতা কেমন ছিলো, এর বিবরণও দিয়েছেন। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্বাধীনতাবিরোধীরা কত শক্তিশালী ছিলো। স্বাধীনতা উত্তরকালেও রাজাকার আলবদর বাহিনি সমশক্তিতে তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে; সে বিষয়টিও লেখক তথ্যসহ উল্লেখ করেছেন। তিনি সে সময়ের পত্রিকার সাহায্য নিয়েছেন, মাঠ পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন। মাঠ পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনির সহযোগী হত্যাকারী যারা ছিলো, তাদের অনেকেই নাম পরিবর্তন করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তারা আবার এলাকায় ফিরে আসে এবং শক্তিসঞ্চয় করে। যদিও তাদের শক্তি আগে থেকেই ছিলো। শ্রেণিগতভাবে যারা সম্পদশালী ও ক্ষমতার অধিকারী, তারাই ছিলো পাকিস্তান রাষ্ট্রের রক্ষাকারী ও সাম্প্রদায়িকতার সমর্থনকারী। অপূর্ব শর্মার গ্রন্থ পাঠ করে এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, লুটেরা, বিকৃত রুচি, সাম্প্রদায়িক ও ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধিরাই পাকিস্তানকে বহাল রাখতে চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতার পর অনেকেই স্থানীয় সরকার ও জাতীয় সংসদে নির্বাচন করে জয়ী ও মন্ত্রী হয়েছে। ১৯৭১ সনে যে অপকর্ম করেছে, সেসব ঢেকে রাখতে ’৭৫ এর পর লোকদেখানো সমাজসেবায় নিয়োজিত হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। চমৎকার নিয়তি হলো- অনেক এলাকায় যুদ্ধে জয়ী হয়েও সাধারণ মানুষ অপরাধীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে এখনও সাহস করে না। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসী ও রাণীগঞ্জ গুরুত্বপূর্ণ দু-টি স্থান। যেখানে কুখ্যাত রাজাকার আহমদ আলী ও আছাব আলীর নেতৃত্বেই গণহত্যা ঘটে। লেখক তথ্য সংগ্রহে রাজাকার আছাব আলীর সাথে যোগাযোগ করতে সচেষ্ট হন। আছাব আলী তার বক্তব্যে পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেয় যে, সে যুদ্ধাপরাধের সংগে জড়িত ছিলো এবং বর্তমানে অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে আছাব আলী বলে, ‘এলাকার চেয়ারম্যান হওয়ার কারণে পাকবাহিনী আমাকে কমিটিতে রাখতে চাইবে তাই আমি শান্তি কমিটি গঠনের দিন জগন্নাথপুর ছেড়ে সিলেটে চলে আসি। শ্রীরামসী ও রাণীগঞ্জে হত্যাযজ্ঞের পর এলাকার হিন্দু-মুসলমানরা আমাকে গিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করার অনুরোধ জানায়। এসব মানুষের কথা ভেবেই আমি শান্তি কমিটিতে যোগ দেই। এ সময় আমি মানুষের সামান্যতম ক্ষতি করেছি এ কথা আমার সামনে কেউ বলতে পারবে না। আমার শত্রুরা কেবল আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এগুলো সত্য নয়। সে সময় মানুষজনকে রক্ষা করেছিলাম বলেই ৮৪ সালে হিন্দু-মুসলমানের ভোটে আমি ইউপি নির্বাচিত হয়েছি। এ নির্বাচনে আমার এক টাকাও খরচ হয়নি। আমাকে ভালোবেসে জনগণই সব করেছে। আমি মানুষের কোনো ক্ষতি করিনি বলেই এখনো জগন্নাথপুরের সব কলেজ, স্কুল মাদ্রাসার সভাপতি/ সম্পাতকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে আমাকে রাখা হয়েছে।’ (পৃ ৭৫)
এধরনের অনেক রাজাকার-আলবদর বাহিনি ও শান্তি কমিটির প্রধান ও সদস্যদের বক্তব্য সংগ্রহ করেছেন লেখক। ফলে, একদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের বাকি ইতিহাস প্রণয়নে এসব তথ্য অবশ্যই অপরিহার্য হিসেবে বিবেচিত হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য পরিচালনায় সাক্ষ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হতে পারে। কারণ, এ সময়ে দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারকার্য চলমান রয়েছে। সময় ও বিষয়ের প্রাসংগিকতায় এ গ্রন্থটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লেখক এ-দেশের মানুষের একজন হয়ে প্রতিনিধিত্বমূলক কাজটি সম্পন্ন করেছেন, তা বলাই বাহুল্য। ঘটনা ও বিষয়কে প্রামাণিক করতে লেখক ১৯৭১ সনে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার দ্বারস্থ হয়েছেন। যেখানে যা প্রয়োজন, সেখানে তিনি উল্লেখ ব্যবহার করেছেন। নিজে থেকে কোনো ঘটনা ও বিষয়ের কৃত্রিম বা মাধুরি মেশানো কাহিনি তৈরি করেননি। এ-গ্রন্থে তথ্যসমৃদ্ধ পরিশিষ্টও রয়েছে। রাজাকার আলবদরসহ গণহত্যায় অংশগ্রহণকারীদের অঞ্চলভিত্তিক তালিকা সংযোজিত আছে। এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ক লেখাগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা উল্লেখ করা হয়। কিন্ত স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করা হয় না। এছাড়াও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক ফরমান জারি করে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়াকে যে বন্ধ করে দেওয়া হয়, এ বিষয়টি এখানে যুক্ত করা হয়েছে। বিষয়টি সময়োপযোগী, তথ্য সমৃদ্ধ ও সুলিখিত বলেই এ গ্রন্থের গুরুত্ব রয়েছে।
বীরাঙ্গনা কথা
প্রকাশকাল : ২০১৩
প্রকাশক : সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা
প্রচ্ছদ : অশোক কর্মকার
মূল্য : ১৭৫.০০ টাকা
’৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা ও বিভৎস নারী নির্যাতন সংঘটিত হয়েছে। বাংলাদেশের শহর থেকে গ্রামে সমানতালে চলেছে নারী নির্যাতন। এসব নির্যাতন, কষ্ট ও অপমান সহ্য করে এখনও বেঁচে আছেন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা নারী। কত নারীকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে। অনেক গবেষক মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী নির্যাতন, ধর্ষণ নিয়ে গবেষণারত আছেন, যা অবশ্যই আশাসঞ্চারী কাজ। এর মধ্যে একজন অপূর্ব শর্মা। তাঁর সংগৃহীত তৃণমূলে নির্যাতিত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা শুনে শিহরে উঠতে হয়। যা বোধে নিতে হয়, ভাষায় ওই বর্ণনার মধ্যেও পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, ঘটনাবহুল নির্যাতনের বর্ণনা মুখে বলা প্রায় অসম্ভব। এসব নির্যাতন ছিলো মর্মস্পর্শী, দুঃখ, কষ্ট মাত্রাহীন, ভাষাহীন। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে অনেক বীরাঙ্গনাকে নানা ধরনের উপহাস সহ্য করতে হয়েছে, হচ্ছে ।
লেখক অপূর্ব শর্মা সরাসরি মাঠ পর্যায়ে, পর্যবেক্ষণে বীরাঙ্গনা নারীদের নিজের বয়ানে সেসব বিভৎস ইতিহাসের দলিল লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর বীরাঙ্গনা কথা গ্রন্থে বারো জন নারীর বিবরণ তিনি গ্রন্থিত করেছেন। যে মাত্রার নির্যাতনের বর্ণনা এখানে তুলে আনা হয়েছে, তা ভাষা দিয়ে ধরা যায় না। শুধু সচেতনতার সংগে অনুধাবন করা কর্তব্য মনে করি। মুক্তিযুদ্ধ কী?- এ প্রশ্নের উত্তরে হাজার হাজার নির্যাতনচিত্র পাঠের প্রয়োজন নেই। বীরাঙ্গনা কথা পাঠেই বোঝা যায় বাংলাদেশ কেমন ছিলো ১৯৭১ সনে। লেখক সুসান ব্রাউনমিলারসহ কয়েকজন গবেষক ও নির্যাতিত নারী পুনর্বাসন কর্মীর কথাও উদ্ধৃত করেছেন। সুসান বলেছেন, ‘একাত্তরের ধর্ষণ নিছক সৌন্দর্যবোধে প্রলুব্ধ হওয়া কোনো ঘটনা ছিলো না আদৌ; আট বছরের বালিকা থেকে শুরু করে পঁচাত্তর বছরের নানি-দাদির বয়সী বৃদ্ধাও শিকার হয়েছিল এই লোলুপতার।’ (পৃ ১২)
মুক্তিযোদ্ধা নারীদের আলাপচারিতা ও সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে পাঠকের অন্তর্জগৎ স্পর্শ করে এমন ভাষাই ব্যবহার করেছেন লেখক তাঁর লেখায়। তাঁর ভাষা, উপস্থাপন এমনই যে, আবেগে তাড়িত হতে হয়। যে কোনো পাঠককে তা বিচলিত করতে বাধ্য। এমন নির্যাতনের সংখ্যা অগণিত, এখানে মাত্র বারোজন নারীর ওপর বিভৎস নির্যাতনের কথা বিবৃত হয়েছে। বস্তুত, এটাই তো বাংলাদেশ। ‘আমি আর কাঁদতে চাই না’, ‘পাঞ্জাবির বউ’, ‘আমি স্বাধীনতার কাজে লেগেছি, ‘আমার তালাশ কে করে’, ‘মনোয়ারার মনোবেদনা’, ‘ছাবেদার যাতনা’, ‘ আমার দুঃখ মইলে যাইব’, ‘অজানা শঙ্কা তাড়া করে ফিরে’, ‘কেউ নেই তার’, জ্যোৎস্নার বিদায়বেলা’, ‘তরওতো মা বইন আছে’, ‘রক্তে মুছে গেছে সিঁথির সিঁদুর’-এ বারোটি শিরোনামায় বারোজন মুক্তিযোদ্ধা নারীর সংগ্রামের কাহিনি বয়ন করেছেন লেখক। একইসংগে সংশ্লিষ্ট এলাকার গণহত্যা, ’৭১-এর যুদ্ধগাথাও বর্ণিত হয়েছে। চাবুকে ঝলসে ওঠার মতো কাহিনি। বারুদের স্ফূলিংগ স্পর্শ করার মতো নির্যাতনের কথামালা।
তাঁর বর্ণনায় ওঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধোত্তর আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার অকপট চিত্র। যেক্ষেত্রে আমাদের হীন, ক্ষুদ্র ও প্রথাগত মানসিকতার সচল ছবি। ‘পাঞ্জাবির বউ’ শিরোনামে যে প্রভারনীর কথা বলা হয়েছে, তাঁর জীবনযাপনে আমাদেরই ক্ষুদ্রত্বের পরিচয় ফুটে ওঠে। পাঞ্জাবি সেনাদের কাছে নির্যাতিত হয়েছেন বলে প্রভারানী হয়ে গেলেন পাঞ্জাবির বউ। এ উপহাস কত নির্মম এবং তা নিয়েই তিনি বেঁচে আছেন। ‘‘তার নাম প্রভারানী। এলাকার লোকজন তাকে ব্যঙ্গ করে ‘পাঞ্জাবির বউ’ বলে ডাকে। তার একমাত্র ছেলে কাজলকে বলে পাঞ্জাবির ছেলে’।… মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পনের দিন পর গ্রামে আসে পাকিস্তানি সৈন্যরা। আমাদের বাড়ির পেছনের বাড়ি নাজির মিয়ার। তাকে দোলাভাই ডাকতাম। একদিন সন্ধ্যার আগে নাজির মিয়া অন্য এক রাজাকারকে নিয়ে প্রভাদের বাড়ি আসে। তাকে জোরপূর্বক পাশ^বর্তী বাদল মাস্টারের বাড়িতে নিয়ে যায়।…সে রাতে বাদল মাস্টারের বাড়িতে অবস্থান নেয়ায় সব সদস্য তাদের লালসা মেটায়।…প্রভারানীকে নিয়ে যাওয়া হয় শমসেরনগর ডাকবাংলোয় পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে। সারারাত পাকিস্তানি সেনারা তাকে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করে। নিজেকে বাঁচানোর সব চেষ্টা করেও তিনি রক্ষা পাননি। …নির্যাতনের এক পর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। প্রভারানী জানান ‘রাত ভোর হলে জ্ঞান ফিরে আসে। আমি মড়ার মতো পড়ে থাকি। তারা আমার মাথা তুলে দেয়। দেখে বাইচ্চা আছিনি। আমারে ঐখানে রাইকা তারা অন্যত্র যায়। এই সুযোগে আমি পালিয়ে আসি।’’ (পৃ ২৫)
আরেকজন নির্যাতিত- সন্ধ্যারাণী জানান স্বাধীনতা-উত্তর জীবনের কতকথা। ‘এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে কোনোরকম বেঁচে আছি। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। জীবনের সাথে যুদ্ধ করেই চালাচ্ছি বেঁচে থাকার নিরন্তর চেষ্টা। ভাই যেটুকু পারেন সহায়তা করেন। শরীর আর চলে না।’ (পৃ ৭৯)
আমি পাঠক হিসেবে এ বই পড়তে বার বার থমকে গেছি। পাঠ এগুতে পারি না। নিজের আবেগ সংযত করতে পারিনি। ঝলসে ওঠে আমার দু-চোখ। বার বার ভেবেছি এ আমার বাংলাদেশ, এ আমার স্বাধীনতার আখ্যান। আর এ আমার মা। বাংলাদেশের উৎস জানতে গেলে এ বিভীষিকাময়, মর্মস্পর্শী, বেদনার আখ্যানসমূহ পাঠ করতেই হয়। লেখক অপূর্ব শর্মা তাঁর দায়বোধ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ভেতরের যুদ্ধকে তুলে এনেছেন।
ফিরে আসেনি ওরা
প্রকাশকাল : ২০১৩
প্রকাশক : গদ্যপদ্য, ঢাকা
প্রচ্ছদ : চারু পিন্টু
মূল্য : ১৫০.০০ টাকা।
যে কারও জন্য অপেক্ষা করে না, সে বুঝে না অপেক্ষার যন্ত্রণা কত তীব্র হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ গেল, স্বাধীনতার এত বছর পরও স্বজনের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছেন অনেকে। যাপিত জীবনে এ দিনগুলো এত গভীর, যা ভাষারও অতীত। জীবন চলমান থাকে কষ্টের ওপর ভর করে। ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকার যন্ত্রণাবিদ্ধ কথার বয়ানই ‘ফিরে আসেনি ওরা’ গ্রন্থ। ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কত মানুষকে ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনি আর এদেশীয় রাজাকার-আলবদর গোষ্ঠী। অনুমান করাই যায় যে, ১৯৭১-এ যাদের পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার আলবদররা ধরে নিয়ে গেছে, নির্যাতনের প্রক্রিয়াতেই তাদের হত্যা করেছে। তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। লেখক অপূর্ব শর্মা এ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর অতিবাহিত হয়ে গেছে ৪২ বছর। কিন্তু ফিরে আসেননি যুদ্ধের দামামায় হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতাকমীরা। নিঁখোঁজ হয়ে যাওয়া এসব লোকজনেরা ফিরে না আসায় ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক পরিবার। ছন্দপতন ঘটেছে অনেক পরিবারের চলার পথে। কিন্তু তাদের শেষ পরিণতি নিশ্চিত না হওয়ায় স্বজন হারানোর পাশে দাঁড়ায়নি কেউ।’ এ হলো মৌল বাস্তবতা। দেশ হলেও স্বজন হারানোর কান্না এখনও থামেনি। এ-গ্রন্থে লেখক ২০টি পরিবারের মর্মস্পর্শী কাহিনি গ্রন্থিত করেছেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন তাঁরা নিজের ভেতরে চাপা কষ্ট, যন্ত্রণা ধারণ করেই অপেক্ষা করে চলেছেন। যদিও তা অবাস্তব, তারপরও বেঁচে থাকলে এ অপেক্ষা না করা ও যন্ত্রণা ভুলে যাওয়া কঠিন। হারিয়ে যাওয়া সিরাজুল আবদাল-এর স্ত্রী সৈয়দা সাকিনা আবদাল বলেছেন, ‘মাঝে মাঝে মনে হয় অলৌকিকভাবে হয়তো তিনি একদিন আমার সামনে এসে হাজির হবেন। এরকম একটি অলীক জাল বুনে চলেছি আজো’। (পৃ ১১)
এসব বিবরণ পড়তে পড়তে যুদ্ধের সময়ে চলে যাওয়া যায় আর পাঠক হিসেবে দুঃসহ বেদনার চাকা সচল হয়ে ওঠে। সরাসরি যুদ্ধে প্রাণ হারানোর পাশাপাশি বাড়ি থেকে ধরে নেওয়া, পালিয়ে যাওয়া অবস্থায় ধরা পড়া, অথবা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারী হিসেবে ধরে নিয়ে গেছে। মূলত, পাকিস্তানি সেনারা এদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং কোন এলাকায় কোন মানুষটি কী কাজ করে, তা কিছুই জানতো না। গ্রন্থিত বিবরণ থেকে সহজইে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এ দেশীয় রাজাকার আলবদর বাহিনির সদস্যরাই পথ, ঘাট, যোগাযোগ, সেসময়ের আওয়ামী লীগ কর্মী, সংস্কৃত ও রুচিবান, প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ, নৌকার সমর্থক ও ভোটারসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কার কী অবস্থান, বাড়ি ও পরিচয় নির্দেশ করে দিয়েছে। এরকম বহু ঘটনার মর্মন্তুদ ঘটনার কাহিনি লেখক সংগ্রহ করেছেন। যেমন : রাকেশ সরকারকে অনেকের সংগে আটকালেও তাকে পাকিস্তান সেনারা ছেড়ে দেয়নি। ‘সেদিনের পর থেকে রাকেশ সরকারের খোঁজ কেউ দিতে পারেনি। রাকেশ সরকারকে ধরে নিয়ে যাওয়ার দুমাস পর তাঁর ছোট ভাই যোগেশ সরকারকেও বাড়ি থেকে এসে ধরে নিয়ে যায় পাক আর্মি। … দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাড়ি ফিরে ভিটে ছাড়া আর কিছুই পাননি রাকেশ সরকারের পরিবারের সদস্যরা। …অতিবাহিত হতে থাকে সময়। দেখতে দেখতে কেটে যায় একযুগ। ফিরে আসেনি ওরা। … ১২ বছর পর্যন্ত বৈধব্য গ্রহণ করেননি দুই জা। বৈধব্য গ্রহণ করার ইচ্ছে ছিল না তাদের। তাদের বিশ্বাস ছিলো ওরা ফিরে আসবে।’ (পৃ ৫৬)
এভাবেই অপেক্ষা করেছেন পুষ্পরাণী বৈদ্য। জ্যৈষ্ঠ মাসের ১২ তারিখ রাখালসহ তিনভাইকে স্থানীয় রাজাকার তরিক আলির সহযোগিতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনি ধরে নিয়ে যায়। রাখালের অন্য দুই ভাইকে সংগে সংগে হত্যা করে। কিন্তু রাখালকে নিয়ে যাওয়া সহ তার স্ত্রী ও বড় ভাইয়ের স্ত্রীকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তাদের ওপর চলে পাশবিক নির্যাতন। মুক্তিযুদ্ধের পর এ দুই নির্যাতিত নারী মুক্তি পেলেও রাখালকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ‘গর্ভধারিণীর মতো একই বিশ^াস হৃদয়ে লালন করে পুষ্পরাণী একযুগ স্বামীর জন্য সিঁথিতে সিঁদুর পড়েছেন। কিন্তু ফিরে আসেননি রাখাল।’ (পৃ ৮১)
নিখোঁজ হওয়া এসব মুক্তিযোদ্ধদের সম্পর্কে সহযোদ্ধা, আত্মীয়-স্বজন যে যা জানেন লেখককে তথ্য দিয়েছেন। আমাদের মনে হয়েছে এ সংশ্লিষ্ট আরও অনেক তথ্য তৃণমূলে পাওয়া যাবে। তবে যা-ই সংগ্রহ ও গ্রন্থিত হয়েছে এসব আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনের পেছনে ত্যাগের যে মর্মন্তুদ ইতিহাস, সেদিকে নজর দিতে প্রণোদিত করে।
মুক্তি সংগ্রামে নারী
প্রকাশকাল : ২০১৪
প্রকাশক : শুদ্ধস্বর, ঢাকা
প্রচ্ছদ : তৌহিন হাসান
মূল্য : ২১০.০০ টাকা।
১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতা নারী পুরুষ উভয়ের অবদানের ফসল। নারী প্রসংগের আলাদাভাবে আলোচনার উদ্দেশ্য রয়েছে। কারণ, অনেকক্ষেত্রে নারীর অবদান সম্পর্কে আলোচনা বিশদ হয়নি। সকলেরই জানা দু-লক্ষ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। বস্তুত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীসমাজের অবদান অবিস্মরণীয়। একাত্তরে অংশগ্রহণকারী নারীদের ভূমিকা, ত্যাগের বাস্তবতা লেখক অপূর্ব শর্মা তুলে এনেছেন তৃণমূল পর্যায় থেকে। সংগঠক, অস্ত্র হাতে লড়াইয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গোপনে তথ্য আদান-প্রদান, হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাদান, পাকিস্তানি সেনাবাহিনির হাতে নির্যাতন, স্থানীয় সহযোগীদের হিংসাত্মক ভূমিকা, নির্যাতনের ঘটনা ইত্যাদি ১২টি শিরোনামায় বর্ণনা করা হয়েছে। যেসব মুক্তিযোদ্ধা নারী ’৬৯-এর অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ছিলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সংগঠক এবং মাঠের যোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা নারীদের দুঃসাহসী ভূমিকা, এখন কীভাবে জীবন যাপন করে দিনানিপাত করছেন, এসবই লেখক তাঁর প্রতিবেদনে উপস্থাপন করেছেন। লেখক খুব সচেতনভাবেই বলেছেন, ‘ মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের অবদান যেভাবে উঠে এসেছে, ঠিক সেভাবে আসেনি নারীদের অংশগ্রহণের কথা।’ তাঁর নিজস্ব বয়ানেই বোঝা যায় এসব তথ্যসংগ্রহে তাঁর কি ধরনের উদ্দেশ্য ছিলো। ‘সংগঠক ছিলেন যাঁরা’ অধ্যায়ে ১৯জন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নারীর অবদান বিবৃত করা হয়েছে। যাঁরা তাদের কর্মগুণেও এ সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। এর মধ্যে সুহাসিনী দাস, সিরাজুন্নেসা চৌধুরী, সৈয়দা জেবুন্নেছা হক, হেনা দাস, উষাদাশ পুরকায়স্থ প্রমুখের নাম সর্বজনেই পরিচিত।
নারীরা শুধু সংগঠক, সেবা শুশ্রুষার কাজে জড়িত ছিলেন না, অস্ত্র হাতে সম্মুখযুদ্ধে লড়াই করেছেন। অনেকে শহিদ হয়েছেন, যুদ্ধের মাঠে পাকিস্তান সেনাবাহিনির কাছে ধরা পড়ে বিভৎস নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অপূর্ব শর্মার সংগে আমরাও মনে করি, ‘সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়া অনেক নারী আজও রয়ে গেছেন নিভৃতে’। তবে এ-গ্রন্থে যেটুকু বলা হয়েছে, তা থেকেই অনুমান নয়, সিদ্ধান্তে আসা যায় মুক্তিযোদ্ধা নারীদের অবদান ও ত্যাগ কোনোভাবেই কম ছিলো না। অস্ত্রহাতে দুঃসাহসী ভূমিকা রেখেছেন এমন পাঁচজন নারীর কথা এ-গ্রন্থে লেখক উল্লেখ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা কাকনবিবির নাম ইতোমধ্যে জেনেছি আমরা। তাঁর ব্যক্তিগত ও যুদ্ধজীবনের কিছু প্রসংগ এখানে তুলে ধরা হয়েছে। ‘তখন ছিল জুন মাস পাকবাহিনির সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই চলছিল। শিশুকন্যা সখিনাকে সীমান্তবর্তী ঝিরাগাাঁও গ্রামে জনৈক শহীদ আলীর আশ্রয়ে রেখে দোয়ারাবাজারে টেংরাটিলা ক্যাম্পে তিনি স্বামীর খুঁজে যান, কিন্তু পাননি। স্বামীকে খুঁজতে গিয়ে তিনি পাকবাহিনির হাতে আটক হন। …তাঁকে ব্যাঙ্কারে আটকে রেখে নির্যাতন করে কয়েকদিন পর ছেড়ে দেওয়া হয়। …গুপ্তচরের কাজ করতে গিয়ে বাংলাবাজারে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন কাকন। তাঁকে একনাগাড়ে ৭দিন বিবস্ত্র করে অমানুষিক নির্যাতন চালায় হায়নার দল।…তাঁকে মৃত ভেবে পাঞ্জাবিরা ফেলে রেখে যায়।… ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে টেংরাটিলায় পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে তিনি অংশ নেন। সেই যুদ্ধে কয়েকটি গুলি তাঁর শরীরে বিদ্ধ হয়। টেংরাটিলা যুদ্ধের পর আমবাড়ি, বাংলাবাজার, টেবলাই, বালিউরা, মহব্বতপুর, বেতুরা, দূর্বিনটিলা, আধারটিলাসহ প্রায় ৯টি সম্মুখসমরে অস্ত্র সহকারে তিনি যুদ্ধ করেন।…নভেম্বর মাসের শেষ দিকে তিনি রহমত আলীসহ আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে জাউয়া ব্রীজ অপারেশনে যান। ব্রীজ অপারেশনে তারা সফল হন।’ (পৃ ৪২)
মানুষের যেমন বৈচিত্র্য রয়েছে। যুদ্ধের মাঠে রয়েছে নানান কৌশল। বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধারা সে সময় ভয়কে উপেক্ষা করে যুদ্ধ করেছেন সাহসের সংগে। এরকমই আরেক মুক্তিযোদ্ধা আম্বিয়া খানমের দুঃসাহসের কথা বর্ণিত হয়েছে এ গ্রন্থে। ‘‘হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে সীমান্তবর্তী গ্রাম টিলাবাড়ির মেয়ে আম্বিয়া খানম।… মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনাদের হটাতে নানামুখি তৎপরতা চালান। সোর্স হিসেবে নিযুক্ত করেন আম্বিয়া খানমকে। আম্বিয়া পাকসেনাদের গতিবিধি জানাতেন মুক্তিযোদ্ধাদের।…পাক সেনারা ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে চায় তার সাথে। কৌশলী আম্বিয়া ফন্দি আটেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পরামর্শ করে পাকসেনাদের তার এক আত্মীয় বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান।… আম্বিয়া খানম জানান, ‘পাকসেনারা যখন টিলাবাড়িতে আসে তখনই মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ঘিরে ফেলে। আমি রামদা দিয়ে এক পাকসেনাকে আঘাত করি। সাথে সাথে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে আহত হয় অপরজন।’’ (পৃ ৫১)
লেখক অপূর্ব শর্মা তাঁর এ গ্রন্থে তৃণমূল পর্যায়ের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নারীর বীরত্বগাথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এখনও বাকি রয়েছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই কোনো সরকারি স্বীকৃতি বা সনদ পাননি। অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেক গ্লানি অপমান সহ্য করে বেঁচে আছেন শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে। অনেকের স্বপ্ন, আশা বলতে কিছুই নেই, নিরুত্তরের নির্জনতাই তাঁদের একমাত্র সম্বল।
চা বাগানে গণহত্যা : ১৯৭১
প্রকাশকাল : ২০১৬
প্রকাশক : সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা
প্রচ্ছদ : অশোক কর্মকার
মূল্য : ২৫০.০০ টাকা।
চা বাগান আর বিয়োগান্তক ঘটনাবলি যেনো একসূত্রে গাথা। অবিভক্ত ভারতে চা বাগান প্রতিষ্ঠা, শ্রমিক নিয়োগকালে এবং পরবর্তীতে অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অনেক শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। অবশেষে ১৯৭১-এ শহিদ হয়েছেন প্রতিটি চা বাগানের অসংখ্য চা শ্রমিক। চা শ্রমিকরা আজও নিপীড়িত, নির্যাতিত এক জনগোষ্ঠী। উৎপাদনের সংগে জীবনকে নিয়োজিত রেখেছে না খেয়ে, জীবনের মূল্য না বুঝে। প্রায় দু-শতক থেকেই তারা এ সভ্যতার আলো থেকে বঞ্চিত রয়েছে। কিন্তু কখনও তারা নীতির প্রশ্নে আপোষ করেনি। ১৯৭০ সনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের নৌকায় সামষ্টিক প্রত্যয়ে তারা বিশ^াস স্থাপন করে এখনও অবিচল রয়েছে। এ বিশ^াস থেকে কেউ তাদের টলাতে পারেনি। তারা অকাতরে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। এত ত্যাগ ও কষ্টের জীবন তাদের, কিন্তু চা শ্রমিকদের অবদানের কথা কোথাও তেমন উল্লেখ নেই। হয়তো আরও কেউ চা শ্রমিকদের আত্মত্যাগের কাহিনি লিখবেন। তবে লেখক অপূর্ব শর্মা এ গ্রন্থ লিখে শূন্যতা পুরণের দায়িত্ব পালন করেছেন নিঃসন্দেহে। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে ৯ মাসব্যাপী চা বাগানে ব্যাপক গণহত্যা হয়েছে। এর মধ্যে লেখক পাঁচ শতাধিক শহিদের তালিকা উল্লেখ করেছেন। প্রসংগত, চা শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ অবস্থায় বসবাস করে। ফলে, প্রতি বাগানে বস্তি থেকে বস্তি হত্যা নির্যাতনে আক্রান্ত হয়েছে। সুতরাং, লেখকের এ হিসেব ছাড়াও আরও হয়তো শহিদ হয়েছেন, তাদের নাম পরিচয় উদ্ধার এখনও সম্ভব হয়নি। এ ছাড়াও চা বাগানে গণহত্যার পেছনে অনেক যন্ত্রণাময় কাহিনি অনুক্ত রয়েছে। অপূর্ব শর্মা পাকিস্তান সেনাবাহিনির মেজর শের খান ও সিন্দুর খান বাগানের তথ্য সংগ্রহে এমনই সাক্ষ্য দিয়েছেন, ‘বাগানবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে সীমান্তের বিভিন্ন বাগান থেকে ধরে এনে শুধু চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর কম করে হলেও অর্ধশত লোককে হত্যা করেছে সে।’ (পৃ ২১) এমনও হয়েছে কোন পরিবারের একজনও বেঁচে নেই। চা শ্রমিকরা চরিত্রগতভাবে নির্বিরোধ ও শান্ত স্বভাবের। এদের মাঝে সচেতনতারও অভাব রয়েছে। সেক্ষেত্রে ১৯৭১-এর গণহত্যার দুঃখভারাক্রান্ত স্মৃতি বহন করা ছাড়া তেমন কিছু করার ক্ষমতাও তাদের নেই। চা বাগানগুলোতে শুধু গণহত্যা নয়, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে সীমাহীন। চা বাগানে এত নির্যাতনের কারণ কি?- এ প্রশ্নের উত্তর-অনুসন্ধানে লেখক জানাচ্ছেন,
‘প্রথমত, চা শ্রমিকদের অধিাকংশই সনাতন ধর্মের অনুসারী এবং তারা আওয়ামী লীগের সমর্থক;
দ্বিতীয়ত, সত্তরের নির্বাচনে শ্রমিকদের নৌকা মার্কায় ভোট দেয়া পরবর্তীকালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান; তৃতীয়ত, ভাষাগত দিক দিয়ে চা শ্রমিকরা হিন্দিভাষী এবং ভারত থেকে আগত।’ (পৃ ১৩)
লেখক অপূর্ব শর্মা চা বাগান ঘুরে ঘুরে একাত্তরের ভয়াল স্মৃতি উত্তরাধিকারীদের মনে জাগিয়ে দিয়েছেন। বর্ণনায় বোঝা যায় তারা ভুলে যায়নি। লেখকের অন্যান্য গ্রন্থের মতো এ গ্রন্থেও মর্মন্তুদ, বিষাদের আখ্যান লক্ষণীয়। খেঁজুরিছড়া বাগানের রামধন কৈরির স্ত্রী মুরতিয়া কৈরিকে যেভাবে হত্যা করা হলো তা মুরতিয়া কৈরির ছেলে মহেষ কৈরির বর্ণনায় লক্ষণীয় : ‘রাত ৮টায় বাগানের বাসিন্দা রাজাকার গফুর মিয়া এসে বাবার নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করে। বিপদ যে আসন্ন তা আর আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না। তাৎক্ষণিকভাবে বাবা মাকে শোবার পালঙ্কের নিচে প্রবেশ করতে বলেন।…ঘরের মধ্যে মাকে না পেয়ে একজন সেনাসদস্যকে নিয়ে লাইটের আলো ফেলতেই মাকে পেয়ে যায়। টেনে-হেঁচড়ে তাকে সেখান থেকে বের করে। আমরা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলে বন্দুকের বাঁট দিয়ে আমাদের পেটায় তারা। মাকে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। নিরূপায় হয়ে আমরা বাগান ব্যবস্থাপক ফিলিপস সাহেবের কাছে যাই। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে তার গাড়িতে করে আমাদের নিয়ে ক্যাম্পের উদ্দেশে রওয়ানা হন। আমরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে যায়। তিনি সেখান থেকে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় মাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। কিন্তু মাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি।’ (পৃ ২৬)
আমরা সকলেই জানি তেলিয়াপড়া যুদ্ধের কথা। তেলিয়াপাড়ায় ৩ নম্বর সেক্টরের দপ্তর স্থাপন করা হয়েছিলো। এখানে অসামান্য সাহসিকতায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করে। প্রতিশোধ হিসেবে তেলিয়াপাড়ায় নিরীহ শ্রমিকদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। তা ছাড়া তারাপুর চা বাগানে ৪০জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনি। এ ছাড়াও যাদের হত্যা করেছে, তাদের ঘর থেকে মেয়েদের ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং ক্ষতবিক্ষত কিংবা অর্ধমৃত অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছে বা রাস্তায় ফেলে দিয়েছে।
অসংখ্য মৃৃত্যু আর রক্তের আখ্যানে অঙ্কিত চা বাগানগুলোর সবুজ প্রান্তর। লেখক তাঁর মতো সচেষ্ট ছিলেন সেসব আখ্যান গ্রন্থনে। পরিশিষ্টাংশে সেসব চা বাগানের নাম ও গণহত্যায় শহিদ শ্রমিকদের তালিকা সংযোজিত হয়েছে। এ-গ্রন্থের প্রতিটি পাতায় হত্যা নির্যাতনের ঘটনা পড়তে পড়তে বিষাদের একটি কালো ছায়া গ্রাস করে নেয় মনোজগৎ। আপন অস্তিত্বের দিকে ফিরে তাকাতে প্রণোদিত করে। এখানেই এ গ্রন্থের সার্থকতা। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় একটি অনন্যগ্রন্থ হলো ‘চা বাগানে গণহত্যা : ১৯৭১’। লেখক অপূর্ব শর্মা বাগানের দুর্গম পথ থেকে পথে হেঁটে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন। ফলত, তিনি উপেক্ষিত একটি ক্ষেত্র নুতন করে উপস্থাপন করেছেন।
মক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ইতিহাস, ঘটনার বিবরণসহ বহু গ্রন্থ লেখা ও প্রকাশিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর প্রজন্মের কাছে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রীয় আর্কাইভসের দলিল, তথ্যাদি ইতিহাসের আকর, সেসব নির্ভর করেই ইতিহাস চর্চায় সমৃদ্ধি ঘটবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় মাঠ পর্যায়ের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং তৃণমূলের ইতিহাস জাতীয় ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করতে সহায়তা করবে বলে আমরা মনে করি। তৃণমূল মানুষের ত্যাগ, সংগ্রাম ও জীবনালেখ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; এর স্বীকৃতি ও ঋণ স্বীকার করতেই হবে আমাদের। আলোচিত গ্রন্থগুলোই প্রমাণ করে লেখক অপূর্ব শর্মা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা, চর্চায় সৃজনশীল দায়িত্ব পালনে নিবিষ্ট রয়েছেন।
অভিমত : মার্চ ২০১৬