টাঙ্গুয়ার হাওর: জলের রাজ্যে অপরূপ প্রকৃতি

হাওর, পাহাড় আর আকাশের মিতালী দেখতে চান? চলে আসুন টাঙ্গুয়ার হাওরে। শুধু কি মিতালী! স্বচ্ছ স্ফটিক জলরাশি, নৌকার ঢেউয়ের শব্দে মাছেদের লাফিয়ে উঠা, পাখিদের কলতান-জলকেলি, আকাশে উড়াউড়ি, জলের নীচ থেকে চিলেদের রুপালি মাছ শিকার, নীল জলের নিচে রঙিন বনের বসতি, সবুজ বৃক্ষরাজি ঘেরা প্রকৃতি-সবই আছে টাঙ্গুয়ায়। সুনামগঞ্জের সীমান্ত ঘেষা দেশের অন্যতম বৃহৎ এই হাওরকে প্রকৃতি যেনো আপনার মনের মাধুরি দিয়ে সাজিয়েছে। 

অদ্ভুত, অভূতপূর্ব সব দৃশ্যপটের এই হাওরকে দেখলে মনে হবে-এ যেনো অন্যএক বাংলাদেশ। মুহুর্তেই মন্ত্রমুগ্ধতায় আচ্ছাদিত হবে হৃদয়।

প্রকৃতি যেনো ভিন্ন এক আবেশের ডালা সাজিয়ে বসে আছে, টাঙ্গুয়ার হাওরে। এখানে সূর্যদয় হয় আগে, চাঁদ এসে জলের আয়নায় থমকে দাঁড়ায় রাতের নিস্তব্ধতায়; ঢেউয়ের কোলে দুলতে দুলতে ঘুমিয়ে পড়ে তারার সারি। হেমন্ত এবং শীত এই দুই ঋৃতুতেই প্রত্যক্ষ করা যায় টাঙ্গুয়ার অপরূপ রূপ। স্থানীয় ভাষায় টাঙ্গুয়ার হাওরকে বলা হয়- ‘নয় কুড়ি কান্দার, ছয় কুড়ি বিল।’ কান্দাভর্তি হাওরে রয়েছে সারি সারি হিজল, করচ ও নলখাগড়া বন। একদিকে মেঘালয় পাহাড়। অন্য তিনদিকে সুনামগঞ্জের তিন উপজেলা তাহিরপুর, মধ্যনগর ও ধর্মপাশা। ৫১ টি বিল আর ৮৮ টি গ্রামবেষ্টিত টাঙ্গুয়ার হাওরের দৈর্ঘ্য ১১ কিলোমিটার এবং প্রস্থ সাত কিলোমিটার। বর্ষায় এর আয়তন দাঁড়ায় ২০ হাজার একরের বেশি আর হেমন্তে প্রায় সাত হাজার একর। এই হাওরে রয়েছে প্রায় ২শ’ প্রজাতির গাছ-গাছালি।

টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশর দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝর্ণা এসে মিশেছে এই হাওরে। টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্রের মধ্যে অন্যতম হল বিভিন্ন জাতের পাখি। বাংলাদেশী জাতের পাখি ছাড়াও শীতকালে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে এখানে পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। ‘ন্যাশনাল কনজারভেশন স্ট্র্যাটেজি’ এবং ‘ম্যানেজমেন্ট প্লান ফর টাঙ্গুয়ার হাওর’ সূত্রে জানা যায়- টাঙ্গুয়ার হাওরে বর্তমানে ২০৮ প্রজাতির দেশি-বিদেশি পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১১২ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। এরমধ্যে বিলুপ্ত প্রায় ১০ প্রজাতির পাখি, ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৪ প্রজাতির সাপ, ৩ প্রজাতির কচ্ছপ, ২ প্রজাতির গিরগিটি ও ১ প্রজাতির উভচর এবং বাংলাদেশের বিলুপ্ত প্রায় ৫৫ প্রজাতির মাছ ও ৩১ প্রজাতির পাখি তাদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে টাঙ্গুয়ার হাওরকে বেছে নিয়েছে। অবাধে মৎস্য নিধনের ফলে গত ২০ বছরে এই হাওর থেকে মাছের ২০টি প্রজাতি একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পরিবেশগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বের মোট ১ হাজার ৩১টি স্থানকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ রামসার সাইট’ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে টাঙ্গুয়ার হাওরই সর্বশেষ রামসার সাইট। বাংলাদেশ রামসার কনভেনশনে ১৯৯২ সালের ২০ এপ্রিল স্বাক্ষর করে। 

দেশের অন্যতম বৃহওম এই জলাভূমিকে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ‘মাদার ফিশারিজ’ এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিশ্বের বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, বৃহদাকার গ্রে কিংস্টর্কও রয়েছে এখানে। ইজারাদারদের নির্বিচার মাছ নিধনের কারণে হাওরের জীব-বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়লে ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি টাঙ্গুয়ার হাওরকে রামসার এলাকাভূক্ত করা হয়। এলাকার জনগণকে সম্পৃক্ত করে হাওর পরিচালনার জন্য তৎকালীন সরকার হাওরটিকে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করে। এব্যাপারে ভূমি এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি সাক্ষরিত হয়। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন রামসার নীতি বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে। প্রশাসনের আওতায় নিয়ে আসা হয় হাওরটিকে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈচিত্র্যময় টাঙ্গুয়া হাওরের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার কাজ চলছে। আর এ থেকে সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমান রাজস্বও পাবে। টাঙ্গুয়ার অবকাঠামোগত উন্নয়ন আর সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে স্থানীয় মানুষকে কাজে লাগিয়ে এখানে বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে। হাওরের সৌন্দর্য্য দেখতে সারা বছরই দর্শনার্থীদের আনাগোনা রয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরে। ভ্রমনার্থীরা হাওর দেখে মুগ্ধ হলেও দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে হাওরের রূপ-লাবন্য প্রত্যক্ষ করতে দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের। এ কারনে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত করা প্রয়োজন।

‘আমরা হাওরবাসী’ সংগঠনের কার্যকরী সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশ তথা জীববৈচিত্র রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি বাড়াতে হবে। হাওর পাড়ের মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি এ ক্ষেত্রে অনেকটা সমাধান এনে দিতে পারে। আবাসন সংকটের কারনে টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকেরা এসে বিভ্রান্ত হন। যদি সরকারি বা বেসরকারিভাবে টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় তাহলে পর্যটন শিল্পে এ হাওর উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। টাঙ্গুয়ার হাওরে যাতায়াত করতে সুনামগঞ্জ শহরে অবস্থান করে নৌপথে যাতায়াত করতে হয়। শহরের সাহেব বাড়ি নৌকা ঘাট থেকে ইঞ্জিন বোট বা স্পীড বোট যোগে সরাসরি টাঙ্গুয়ায় যাওয়া যায়। ইঞ্জিন বোটে ৫ ঘন্টায় এবং স্পীড বোটে ২ ঘন্টা সময় লাগে। সেক্ষেত্রে ইঞ্জিন বোটে খরচ হয় ২ হাজার টাকা থেকে, আড়াই হাজার টাকা, পক্ষান্তরে স্পীড বোডে খরচ হয় ৭ হাজার ৫শ থেকে ৮ হাজার টাকা। বেসরকারী ব্যবস্থায়পনায় সেখানে রাত্রি যাপনের কোন ব্যবস্থা নেই। তবে সরকারী ব্যবস্থাপনায় ৩ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্পের রেস্ট হাউজে অবস্থান করা যায়। আর গ্রীষ্মকালে শহরের সাহেব বাড়ি খেয়াঘাট অতিক্রম করে ওপার থেকে মোটর সাইকেলযোগে ২ ঘন্টায় শ্রীপুর বাজার-ডাম্পের বাজার যেতে হয়। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২শ টাকা। সেখান থেকে নৌকা ভাড়া নিয়ে হাওর টাঙ্গুয়ায় পৌছে যাওয়া যায়। ব্যয় হবে ৩শ-৪শ টাকা।