
প্রকৃতিকণ্যা হিসাবে জাফলং সারাদেশে এক নামে পরিচিত। শুধু এ নামেই নয়, জাফলংয়ের রয়েছে আরও অনেক নাম। কেউবা বিউটি স্পট, কেউবা সৌন্দর্যের রাণী, কেউ কেউ মেঘপাহাড়ের দেশও বলে থাকেন জাফলংকে। আর এসব অভিধা জাফলংয়ের নামের সাথে যুক্ত হয়েছে মানুষের ভালোবাসার জন্যে। কেনইবা হবে না, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি জাফলংকে প্রকৃতি সাজিয়েছে দু’হাত ভরে। ভ্রমনপিপাসু মানুষের চাহিদা মেটানোর সব উপকরনই রয়েছে জাফলংয়ে।
দেশের অন্যতম প্রধান এই পর্যটন স্পটকে প্রকৃতির নিপুন শিল্পকর্মের অনন্য স্থান বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে পাহাড়ের দাড়িয়ে থাকা, সফেদ মেঘেদের ভেলা, সীমান্তের ওপারে প্রবাহিত ঝর্ণাধারা, পিয়াইন ও ধলাই নদীর তীরে স্তরে স্তরে সাজানো পাথরের স্তুপ, নদীর স্বচ্ছ হিমেল জল, উঁচু পাহাড়ে গহিন অরণ্য ও সুনসান নিরবতার কারণে পর্যটকদের সহজেই কাছে টেনে নেয় জাফলং।
ঋতুবৈচিত্যের সাথে জাফলংও তার রূপ বদলায়, সৌন্দর্য্যে আসে বৈচিত্র্যতা। তবে, একেক ঋতুতে জাফলংয়ের সৌন্দর্য্য একেক রকম। বর্ষায় জাফলংয়ের রূপ লাবণ্য যেন ভিন্নমাত্রায় ফুটে উঠে। ধূলি ধূসরিত পরিবেশ হয়ে উঠে স্বচ্ছ। খাসিয়া পাহাড়ের সবুজাভ চূড়ায় শুভ্র মেঘেদের বিচরণ এবং যখন-তখন অঝোরধারায় বৃষ্টিতে পাহাড়ি পথ হয়ে ওঠে বিপদসংকুল। শিহরণ জাগে মনে। সেই সঙ্গে কয়েক হাজার ফুট উপর থেকে নেমে আসা সফেদ ঝর্ণাধারার দৃশ্য যে কারোরই নয়ন জুড়ায়। আবার শীতে অন্যরূপে হাজির হয় জাফলং। চারিদেকে তখন সবুজের সমারোহ, পাহাড় চূড়ায় গহীন অরণ্য। পিয়াইন নদীর স্ফটিক জলে নৌ-ভ্রমন, অবগাহনের আনন্দই আলাদা।
ধলাই ও পিয়াইনের স্বচ্ছ জলে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় নানা জাতের ছোট ছোট মাছ। দুই নদীর জলে ডুব দিয়ে হাজার হাজার শ্রমিকের পাথর উত্তোলনের দৃশ্যও মনোমুগ্ধকর। নদীর জলে শ্রমিকদের এই ‘ডুবোখেলা’ চলে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সীমান্তের ওপারে ডাউকি নদীর উপরে ঝুলন্ত সেতু জাফলংয়ের সৌন্দর্যকে আরও আকর্ষনীয় করে তুলেছে।
শুধুমাত্র পাহাড় আর নদীতে সীমাবদ্ধ নয় জাফলংয়ের সৌন্দর্য্য। দেশের অন্যতম এই পর্যটন স্পটের সৌন্দর্য্যে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে সেখানকার আদিবাসীদের জীবনধারা। পিকনিক স্পটের একেবারে সন্নিকটেই খাসিয়াপুঞ্জির অবস্থান। নদী পার হয়ে পৌছতে হয় পুঞ্জিতে। ৩-৪ ফুট উঁচুতে বিশেষভাবে তৈরি খাসিয়াদের ঘর দেখতে দারুন লাগে। খাসিয়াদের প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে পানের বাগান। মাতৃতান্ত্রিক খাসিয়া সম্প্রদায়ের পুরুষরা গাছ বেয়ে পান পাতা সংগ্রহ করে থাকেন বিশেষ এক ধরনের ঝুড়িতে করে। সেই পান বাড়ির উঠোনে বসে নারী সদস্যরা ভাঁজ করেন শিল্পের ছোঁয়ায়। খাচাভর্তি করা সেই পান পুরুষ সদস্যরা বিক্রি করেন। পান পাতা সংগ্রহ ও খাঁচা ভর্তি করার দৃশ্য পর্যটকদের আবিষ্ট করে সহজেই। খাসিয়া পল্লীতে রয়েছে, কমলার বাগান। শীতকালে কাঁচা-পাকা কমলার ভারে গাছগুলো নুয়ে থাকে। কমলার ঘ্রান মোহিত করে ভ্রমনার্থীদের। সংগ্রামপুঞ্জির রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে দেখতে পাবেন দেশের প্রথম সমতল চা বাগান। দুটি পাতা একটি কুড়ি তোলার দৃশ্যও অবলোকন করতে পারবেন, বিকেলের আগে সেখানে পৌছতে পারলে।

ভারতবর্ষের অধিকাংশ এলাকা যখন মোগল সাম্রাজ্যভূক্ত ছিল তখনও জৈন্তিয়াপুর রাজ্যের ছিল সতন্ত্র অবস্থান। প্রাচীনকাল থেকেই জৈন্তিয়ায় মানববসতি ছিল। ১৫০০-১৮৩৫ সাল পর্যন্ত ২৩ জন খাসিয়া রাজা জৈন্তিয়া শাসন করেন। প্রথমে পর্বত থেকে রাজ্য পরিচালনা করা হলেও পরবর্তীতে জৈন্তার নিজপাট নামক স্থান থেকে এই রাজ্য শাসন করা হতো। ১৯৫৪ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির পর খাসিয়া জৈন্তা রাজ্যের অবসান ঘটে। যার ফলে বেশ কয়েক বছর জাফলংয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পতিত অবস্থায় পড়ে থাকে। ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে নৌপথে জাফলং আসতে শুরু করেন। প্রচুর পরিমানের পাথর এই নদী থেকে সহজেই উত্তোলন করতে পারায়, এখানে গড়ে উঠে নতুন জনবসতি। আশির দশকে সিলেটের সাথে জাফলংয়ের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষ জানতে পারে জাফলংয়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের কথা। শুরু হয় পর্যটকদের আনাগুনা। সময়ের বিবর্তনে এখন দেশসেরা পর্যটন স্পটগুলোর একটিতে পরিনত হয়েছে জাফলং। শুধুমাত্র দেশী পর্যটকরাই নয়, বিদেশী পর্যটকদের কাছেও রয়েছে জাফলংয়ের বিশেষ কদর।
যাতায়াত : দেশের যে কোনো স্থান থেকে সিলেট চলে আসুন। রেল, সড়ক ও আকাশ এই তিন পথেই আসতে পারবেন সিলেটে। শহর সিলেট থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে গোয়াইনঘাট উপজেলায় জাফলং এর অবস্থান। নগরী থেকে বাস, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা বা লেগুনায় যাওয়া যায় জাফলংয়ে। জাফলং যেতে জনপ্রতি বাস ভাড়া পড়বে ৮০ টাকা। যাতায়াতের জন্য মাইক্রোবাসের ভাড়া করলে ব্যয় হবে ৩০০০-৩৫০০ টাকা। সিএনজি অটোরিকশায় খরচ হবে ১০০০-১২০০ টাকা। সিলেট শহরের যেকোনো অটোরিকশা বা মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে যাওয়া যাবে জাফলংয়ে। আর জাফলংমুখি বাস ছাড়ে নগরীর শিবগঞ্জ থেকে। প্রতি একঘন্টা পরপর পাওয়া যাবে বাস।
থাকা-খাওয়া : জেলা পরিষদের বাংলো ছাড়া জাফলংয়ে থাকার তেমন ভালো ব্যবস্থা নেই। জেলা পরিষদের বাংলোতে থাকতে হলে আগে থেকেই অনুমতি নিতে হবে। তবে, দেড় ঘন্টা সময়ের দুরত্বে হওয়ায় জাফলং ভ্রমনকারীরা সিলেট শহরের হোটেলগুলোতে অবস্থান করে যাতায়াত করে থাকেন। এটাই সবচেয়ে উত্তম। আগে জাফলয়ে ভালো মানের খাওয়ার হোটেল না থাকলেও বর্তমানে বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে পানাহারের জন্য। তাই নাস্তা কিংবা দুপুরের খাবারের জন্য দুশ্চিন্তা নেই এখন আর।