মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের নাম শুনেন নি দেশে এমন ভ্রমনার্থী হয়তো পাওয়া যাবেনা। তবে, এই জলপ্রপাতের সাথে সাম্প্রতিক সময়ে আরো দুটি নাম যুক্ত হয়েছে। এর একটি পরীকুণ্ড অন্যটি হামহাম। মাধবকুণ্ডের সাথে এ দুটি নামের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বলার কারন-মৌলভীবাজার জেলায় এখন আর একটি জলপ্রপাত নয়, চা বাগানবেষ্টিত এই জেলায় জলপ্রপাতের সংখ্যা বর্তমানে তিনটি। যার ফলে মৌলভীবাজারকে ইচ্ছে করলে যে কেউ অনায়াসেই জলপ্রপাতের জেলা বলতে পারেন।
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের ব্যাপক পরিচিতি থাকলেও পরীকুণ্ড এবং হামহাম-এ দুটি নামের সাথে এখনও পুরোপুরি পরিচিত হতে পারেন নি পর্যটকরা। পরিচিত হওয়ার কথাও নয়। কারন, পরীকুণ্ড বেশকিছুদিন আগে আবিস্কৃত হলেও হামহাম-এর অস্তি¡ত্ব পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক সময়ে। তবে, কম সময়ের মধ্যেই পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছে এ দুটি জলপ্রপাত।

পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত হামহাম
রোমাঞ্চকর নয়নাভিরাম জলপ্রপাত হামহাম। কমলগঞ্জ উপজেলার কুরমা বনাঞ্চলের ভারতীয় সীমান্তবর্তী গহীন অরণ্যে এই জলপ্রপাতটির অবস্থান। সাম্প্রতিক সময়ে হামহাম জলপ্রপাতটির সংবাদ বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় প্রচার হলে পর্যটকদের আগমন শুরু হয়। এই জলপ্রপাতে যাবার কোন রাস্তা না থাকলেও পর্যটকরা দূর্গম পাহাড় অতিক্রম করে প্রত্যক্ষ করছেন হামহামের সৌন্দর্য্য।
কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কি.মি. পূর্ব-দক্ষিণে রাজকান্দি বন রেঞ্জের কুরমা বনবিট এলাকার প্রায় ১০ কিঃমিঃ অভ্যন্তরে দৃষ্টিনন্দন হামহাম জলপ্রপাতের অবস্থান। সেখানে সরাসরি যানবাহন নিয়ে পৌঁছার ব্যবস্থা নেই। কমলগঞ্জ-কুরমা চেকপোষ্ট পর্যন্ত প্রায় ২৫ কি. পাকা রাস্তায় স্থানীয় বাস, জীপ, মাইক্রোবাসযোগে যেতে পারলেও বাকী ১০ কি. মি. পায়ে হেঁটে যেতে হয়। কুরমা চেকপোষ্ট থেকে চাম্পারায় চা বাগান পর্যন্ত মাটির রাস্তা। সেখান থেকে প্রায় ৫ কি.মি. দূরে সীমান্ত এলাকায় ত্রিপুরা আদিবাসীদের পল্লী বন বিভাগের কুরমা বিটের অরণ্যঘেরা দুর্ঘম পাহাড়ী এলাকা তৈলংবাড়ী কলাবন বস্তিতে। সেখান থেকে আরও প্রায় ১০ কি.মি. পথ পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে প্রত্যাশিত সেই হামহাম জলপ্রপাতের।
তৈলংবাড়ী কিংবা কলাবন বস্তির আদিবাসীদের সাহায্য নিয়ে প্রায় ১০ কিমি. দুর্ঘম পাহাড়ের ভিতর হামহাম জলপ্রপাতে যাওয়া যাবে। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পথে ট্রেকিং করা খুবই কঠিন এবং কষ্টের। মাঝেমধ্যে সিমেন্টের ঢালাই করার মতো দেখতে বড় বড় পাথরের খণ্ড খুবই পিছলে, ডানে-বামে তাকালেই ভয় লাগবে মনে মনে। তাই ট্রেকিং করার সময় সবাইকে একটি করে বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে পাহাড়ী এই পথে খুবই সাবধানে হাঁটতে হবে। এই লাটি হচেছ একমাত্র অবলম্বন। কলাবন পাড়া থেকে হাঁটার সময় কলাগাছগুলো দেখলে মনে হবে কে যেন সুন্দর, সুশৃংখল, সারিবদ্ধভাবে লাগিয়ে রেখেছে। জারুল, চিকরাশি কদমের সারিবদ্ধ চারাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে হাজারো প্রজাপতি ডানা মিলিয়ে উড়ে যাচ্ছে বহুদূরে। ডুমুর গাছের শাখা আর বেত বাগানে দেখা মিলবে অগনিত চশমা বানরের। চারদিকে গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর আর ডলু, মুলি, মিরতিঙ্গা, কালি ইত্যাদি অদ্ভুত নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ বাগানের রাজত্ব আপনাকে দেবে বাড়তি আনন্দ। পাথুরে পাহাড়ের ঝিরি পথে হেঁটে যেতে যেতে সুমধুর পাখির কলরব আপনার মনকে ভাললাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেবে। দূর থেকে শোনা যাবে বিপন্ন বনমানুষ, উল্লুক, গিবনসের ডাক।
কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর দু’চোখের সামনে ভেষে উঠবে পাহাড় থেকে ধোঁয়ার মতো ঘন কুয়াশা ভেসে উঠার অপূর্ব দৃশ্য। মনে হবে নয়নাভিরাম পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছানো যায় হামহাম জলপ্রপাতের খুব কাছাকাছি। দূর থেকে শুনতে পাবেন হামহাম জলপ্রপাতের শব্দ। আপনার মন হয়ে উঠবে চঞ্চল। ঢালু ও পিচ্ছিল পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরে ওঠা কষ্ট হলেও সহজ, কিন্তু নিচে নেমে আসা খুবই বিপদজ্জনক ও কঠিন। কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গল শহর থেকে যানবাহন ভাড়া করে ভোর ছয়টার মধ্যেই হামহামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলে পড়ন্ত বিকেলে ফিরে আসতে পারবেন অনায়াসে। অন্যথায় বেকায়দায় পড়তে হবে।

মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত সত্যিই মনোমুগ্ধকর। এই জলপ্রপাতের সৌন্দর্য্য যতই উপভোগ করা যায়, মন যেন ভরে না। বড়লেখা থানার মাধবকুণ্ডের সুউচ্চ পাহাড় শৃঙ্গ থেকে শুভ্র জলরাশি অবিরাম গড়িয়ে পড়ছে। আর এই জলপ্রপাতের স্ফটিক জলরাশি দেখতে পুরো বছরই পর্যটকদের আনাগুনা পরিলক্ষিত হয় মাধবকুণ্ডে।
এ জলপ্রপাতের সুচনা কখন হয়েছিল তার সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও ভূ-তাত্বিকদের ধারনা প্রায় হাজার বছর আগে হিন্দু ধর্মাবলম্বী সন্যাসী মাধবেশ্বর এখানে আস্তানা করেন। পাহাড় বেষ্টিত নির্জন স্থানে সন্যাসী ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। মাধবেশ্বরের আস্তানা ঘেষে বয়েছে ঝরনা ধারা। পাথারিয়া পাহাড়েরর প্রায় ২‘শ ৫০ ফুট উচু থেকে কল কল শব্দে ঝর্ণা ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। সন্যাসী তার প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতেন ঝরনার শীতল জল দিয়ে। সেই থেকে প্রাকৃতিক জলধারাটির নাম মাধবকুণ্ড হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
মাধবকুণ্ড অতীত থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থ স্থান হিসাবে পরিচিত। মাধবেশ্বরের আশির্বাদ নিতে হাজার হাজার মানুষ আসেন প্রতি বছরের চৈত্র মাসে। এ সময় মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে পুণ্যার্জন ও বারুনী øান করে পাপ মুক্তির কামনা করেন। মাধবের মন্দির ছাড়াও রয়েছে শিব মন্দির। বিশালাকার শিবলিঙ্গেরও পুজা হয়ে থাকে। চৈত্রমাসের ওই সময়ে বড় ধরনের মেলা বসে।
জলপ্রপাতের অবিরাম স্রোতধারা প্রবাহিত হওয়ায় পাহাড়ের শরীর পুরোটাই যেন কঠিন পাথরে পরিনত হয়েছে। জলরাশি নির্গত কুণ্ডের ডানদিকে রয়েছে বিশাল গুহা। আদিম যুগের মানুষ গুহায় বসবাস করলেও আধুনিক যুগের মানুষ গুহার সাথে তেমন পরিচিত নয়। তবে মাধবকুণ্ডে এলে গুহার ভেতর প্রবেশ করে নতুন আমেজ পাওয়া যায়। পাহাড়েরর গভীরে তৈরি গুহাকে আধুনিক কারুকচিত পাথরের একচালা মনে হয়ে থাকে। গুহাটির সৃষ্টি প্রাকৃতিক ভাবে হয়েছে বলে অনেকে ধারনা করলেও মুলত এটি ছিল সন্যাসী মাধবেশ্বরের ধ্যান মগ্নের গোপন আস্তানা। এটি কিভাবে, করা তৈরি করেছিল তার সঠিক তথ্য আজও রহস্যাবৃত। বড়লেখা উপজেলার কাঁঠালতলী থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দুরে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে মাধবকুণ্ডে আসার সুবিধারও উন্নতি হয়েছে। সড়ক ও রেলপথ উভয় পথেই আসা যায় মাধবকুণ্ডে।

পরীকুণ্ড জলপ্রপাত
‘মাধবকুণ্ড’ জলপ্রপাত পাশেই রয়েছে আরেকটি জলপ্রপাত। স্থানীয়রা এই জলপ্রপাতটিকে ‘পরীকুণ্ড’ নামে চেনেন। ‘মাধবকুণ্ড’ থেকে ‘পরীকুণ্ড’ বেশ নির্জন। বিভিন্ন জাতের গাছপালায় ছেয়ে আছে এর চারপাশ। প্রায় দেড় শ ফুট উঁচু থেকে পাথরের খাড়া পাহাড় বেয়ে শোঁ শোঁ গতিতে জলধারা নিচে আছড়ে পড়ছে। নিচে বিছানো ছোট-বড় পাথর গড়িয়ে স্রোতধারা একটি বড় ছড়ায় মিশে গেছে। বড় একটি পাথরে বসে আনমনে খুব কাছ থেকেই জলপ্রপাতের নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করা যেতে পারে। ইচ্ছা করলে স্বচ্ছ পানির ছড়ায় ভালোমতো গোসলটাও সেরে নেওয়া যায়।
মাধবকুণ্ড জলপ্রাপাতের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলে হাতের বাঁ পাশে টিলার ওপর পাওয়া যাবে শিবমন্দির। এর ঠিক বিপরীতে রাস্তার সঙ্গে নির্মিত পাকা সিঁড়ি দিয়ে নেমে মাধবকুণ্ডের মূল ছড়া। আর ওই ছড়াটির সোজাসুজি পাথর বিছানো ছড়া দিয়ে ১০-১৫ মিনিট হাঁটলেই পৌছে যাওয়া যাবে ‘পরীকুণ্ডে’।