
‘তোমরা আমাকে বিদায় দাও। আমি চলে যেতে চাই। আর আটকে রেখ না। এবার যেতে দাও।’ আমি বললাম, এত সহজে আপনাকে আমরা ছাড়ব না। অন্তত শতবর্ষ আমাদের সাথেই থাকতে হবে। একটু আবেগ-আপ্লুত হয়ে বললেন-‘এখন বেঁচে থাকা মানেই কষ্টের, যন্ত্রণার; কষ্ট ভাল লাগে না।’ প্রশ্ন করলেন-‘আমি বোধহয় পূর্ব জন্মে কোনো অপরাধ করেছিলাম, তাই ঈশ্বর আমাকে কষ্টের সাগরে হাবুডুবু খাওয়াচ্ছেন, এখন নিয়ে গেলেইতো পারেন।’
২৮ মে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা। আমি ও দীপংকর দা অসুস্থ দিদিমাকে দেখতে যাই। নগরীর সেন্ট্রাল হাসপাতালের ১০২ নম্বর রুমে তিনি চিকিৎসাধীন। হাসপাতালে ভর্তির পর সুস্থতার দিকেই অগ্রসর হচ্ছিলেন। ডাক্তার জানিয়েছিলেন, তিনি শঙ্কামুক্ত। কিন্তু দুঃশ্চিন্তার একটি কারণ তখনও সবাইকে উদ্বিগ্ন করে রেখেছিল; তাঁর ফুঁসফুসের মধ্যে পানি জমে যাওয়ার কারণে মনের মধ্যে কালো মেঘ জমে ছিল সবার। তবে দুদিনের চিকিৎসায় বৃহস্পতিবার অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। সবার সাথে অনায়াসেই কথা বলছিলেন তিনি। সেদিন একটি বারের জন্যও স্মৃতি প্রতারণা করেনি তাঁর সাথে। আমাকে ও দীপংকর দা’কে দেখেই বললেন-‘দেখতে এসেছো! আর কষ্ট দিতে চাই না; এবার বিদায়ের পালা।’ মৃত্যুর হিমশীতল পরশের দিকে এগিয়ে যাওয়া মহিয়সীর এমন কথা শুনে বুকটা কেমন করে আঁতকে ওঠে। ছলছল করে কেবিনে উপস্থিত সবার চোখ। হাসপাতালের বেডে শিয়রের দিকে দুটি বালিশ লম্বা করে রেখে তাতে হেলান দিয়ে পা সটান করে বসেছিলেন তিনি। বার্ধক্য-যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। সেই কষ্টকে আর কেউ অনুধাবন করুক-এ বাসনা তাঁর ছিল না।
হাসপাতালের বেডে তাকে যেভাবে বসিয়ে রাখা হয়েছিল তাতে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না তিনি। আমি পাশে গিয়ে বসি। জানতে চাই বসতে কি অসুবিধা হচ্ছে? মাথা নেড়ে সায় দেন। একটি বালিশ পেছন থেকে সরিয়ে নিই। এরপর অনেকটা পাঁজাকোলা করে পেছনের দিকে সরিয়ে নিয়ে আসি তাঁর শরীর, জিজ্ঞেস করি এখন কেমন লাগছে? তাঁর সেই এক কথা-‘বিদায় দাও। এবার যাবার পালা।’ আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলি, এভাবে আটকে রাখব; যেতে দেব না। মুচকি হাসেন দিদিমা। বলেন, অনেক পেয়েছি গান্ধীজির কাছ থেকে, নেহেরুর কাছ থেকে, নেতাজির কাছ থেকে, সমাজের কাছ থেকে। এখন আর চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই’। মনোবল দৃঢ় করতে বলি-ছাত্রাবাসে কবে যাচ্ছেন?’ উত্তর দেন-‘বোধহয় কাল।’ এরপর অসুস্থ মানুষটাকে কথা বলে আর কষ্ট দিতে ইচ্ছে হয়নি। সেখানে আরও কিছুক্ষণ অবস্থান করে বিদায় নিয়ে চলে আসি।
৩০ মে শনিবার। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ফোন পাই প্রথম আলোর সিলেট প্রতিনিধি সুমনের। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সে জানায়-‘দিদিমা নেই।’ বুকটা ধড়াস করে ওঠে। কিছু সময়ের জন্য নির্বাক হয়ে যাই। দীপংকরদাকে ফোন দেই। দুঃসংবাদটা তখনও তিনি জানেন নি। আগের দিন যে মানুষটার সাথে আমরা সাবলীলভাবে কথা বলে এসেছি ঠিক তার একদিন পর তাঁর চলে যাওয়াকে মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। দীপংকরদাকে হাসপাতালে আসার কথা বলে সহকর্মী ইকবাল মুন্সিকে নিয়ে ছুটে যাই সেন্ট্রাল হাসপাতালে।

চারপাশে ভিড়। চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন দিদিমা। শোকে আছন্ন গোটা হাসপাতাল। তাঁকে এক নজর দেখার জন্য ছুটে আসছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে মানুষের সংখ্যাও বাড়তে লাগল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো হাসপাতাল থেকে দিদিমাকে ছাত্রাবাসে নিয়ে যাওয়া হবে, সেখান থেকে স্থানীয় একটি হাসপাতালের মার্চুয়ারিতে রাখা হবে তাঁর মৃতদেহ। পরদিন সকালে গীতা মন্দিরে, সেখান থেকে শহীদ মিনারে এবং সেখানেই শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন শেষে শোকর্যালি, রামকৃষ্ণ মিশন, ছাত্রাবাস; সবশেষে চালিবন্দর শ্মশানঘাটে নিয়ে যাওয়া হবে তার শবদেহ। শ্মশানঘাটে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর পর সম্পন্ন হবে তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠান।
সে অনুযায়ী সব কিছু সম্পন্ন হয়েছে। সিলেটবাসী গভীর শ্রদ্ধা ভালোবাসা আর চোখের জলে বিদায় জানিয়েছে তাদের সকল আন্দোলন সংগ্রামের এই সহযাত্রীকে। কেঁদেছে সবাই। প্রকৃতিও কান্না ধরে রাখতে পারেনি সেদিন!
দিদিমার শেষ যাত্রা যখন শ্মশানোর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন আর কান্না আটকে রাখতে পারিনি। অঝোরে ঝরতে শুরু করে আমার অশ্রু। এত প্রিয়, এত আপন মানুষটাকে চির বিদায় জানতে ভালো লাগছিল না। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বার বার মনে হচ্ছিল সেইসব স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা। আদর করে নাড়– হাতে তুলে দিতেন দিদিমা। কোনো অনুষ্ঠান হলেই ডাক পড়ত ছাত্রাবাসে। কখনো দীপংকরদা আবার কখনোবা সুমন। তবে সুমনের সাথেই অধিকবার গিয়েছি ছাত্রাবাসে।
দিদিমার সাথে পরিচয়ের দিনক্ষণ আজ আর মনে নেই। আমি যখন সিলেটে এসে যুগভেরীতে যোগদান করি এর দিন কয়েক পর থেকেই তার সাথে পরিচয়। পূর্ব থেকে তাঁর নামের সাথে পরিচিত থাকা ও পরবর্তীতে ছাত্রাবাসে একাধিক পরিচিতের অবস্থান থাকায় সেখানে যাওয়া। আর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার মধ্য দিয়ে ঘনিষ্ঠতা। সেই থেকে নিজের পরিবারের একজনের মতোই দেখতেন তিনি।
‘শাইল কলা’ খেতে ভালোবাসতেন দিদিমা। মাঝে মধ্যে শাইল কলা নিয়ে যেতাম। তবে যতবারই ছাত্রাবাসে গিয়েছি কোনো কিছু না খেয়ে আসতে পারিনি। নিজ হাতে খাবার তৈরি করে অভ্যাগতদের খাওয়াতে পছন্দ করতেন তিনি। তাঁর হাতে সবচে বেশি খেয়েছি নাড়–। মধ্যাহ্নভোজনও করেছি অসংখ্যবার। আজকের সময়ে হারিয়ে যেতে বসা অনেক খাবারের স্বাদ আস্বাদন করেছি তার কল্যাণে।
যাতায়াত বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয় সম্পর্ক। মায়ার অমোঘ বাঁধনে আবদ্ধ হই। তাই মাঝে মধ্যেই তাঁর সাথে দেখা করার জন্য প্রাণের টানে যেতে হতো ছাত্রাবাসে। গত মাসে দুবার যাই ছাত্রাবাসে। প্রথমবার তিনি পা পিছলে মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণে এবং দ্বিতীয়বার আমার লেখা বইটি দিতে। প্রথমবার গিয়ে দেখি দিদিমার মাথায় ব্যান্ডেজ করা। মহিলা পরিষদের খুশি চৌধুরী সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন। দিদিমাকে বলি, ‘রাগ করলেন কেন?’ চমকে ওঠেন তিনি। উত্তর দেন, ‘কই না তো।’ আমি বলি না রাগলে এভাবে পড়ে যাবেন কেন। হাসেন তিনি। সেদিন অনেকক্ষণ গালগল্প করে ফিরে আসি। এরপর গত ২৫ এপ্রিল আমার লেখা বইটি দিতে যাই। কিন্তু সেদিন তার কক্ষে এত বেশি পরিচিতজন ছিলেন যে বই না দিয়ে কুশল বিনিময় করে চলে আসি। ভেবেছিলাম আরেকদিন গিয়ে দিয়ে আসব। আমার জানা ছিলনা, আর কোনদিনও সে সুযোগ আসবে না; নিজের লেখা বইটি প্রিয় মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হবে না আমার।
মানুষকে সহজেই আপন করে নিতে পারতেন তিনি। মানবধর্মের সেবাব্রতের অগ্রপথিক সুহাসিনীদির কাছে জাত-পাত বলে কিছু ছিল না। গান্ধীর অহিংস নীতিতে তিনি অবিচল ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। সাম্প্রদায়িকতাকে তিনি ঘৃণা করতেন। সিলেট সিটি মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের একটি বক্তব্য থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, আসলেই তিনি কতটা সার্বজনীন ছিলেন। সুহাসিনী দাসকে শেষ বিদায় জানানোর প্রাক্কালে আবেগাপ্লুত মেয়র অশ্রুসিক্ত নয়নে বলছিলেন-‘আমি আমার মাকে হারিয়েও মায়ের অভাব বোধ করিনি। তিনি আমাকে মায়ের অভাব অনুধাবন করতে দেননি। আজ আমি মাতৃহীনা।’
যেদিন দিদিমা না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন, এর পরদিন ছাত্রাবাসে যাবার ইচ্ছে ছিল তাঁর। ছাত্রাবাসের সংস্কার কাজের ছাদ ঢালাইয়ের উদ্বোধন করার কথা ছিল সিটি মেয়রের। দিদিমা হাসপাতালের বেডে বসেই ছাত্রাবাসের সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছিলেন-‘এবার কামরানকে খিচুড়ি খাওয়াব’। পরদিন তিনি ঠিকই ছাত্রাবাসে গেলেন। তবে তার বোধ শক্তি ছিল না। তিনি ছিলেন চির ঘুমে অচেতন। তার চারপাশ লোকে লোকারণ্য ছিল, কিন্তু একবারও তিনি তাদের দিকে চোখ মেলে তাকাননি।
শবযাত্রার প্রাক্কালে এসব কথাই মনের মাঝে ভিড় করছিল। ঘুমিয়ে আছেন তিনি। আমরা সবাই জেগে। তাকে বিদায় জানাতে অগণিত লোক সমবেত হয়েছেন শ্মশানঘাটে। সিটি মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ জেবুন্নেসা হক, প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, বিভিন্ন শ্রেণী পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এত কোলাহলেও তার ঘুম ভাঙেনি। চিতার কাঠে পুড়ে ছাই হয় তাঁর নশ্বর দেহ। সেদিন সন্ধ্যার আঁধারের সাথে আলোহীন হয়ে যান সিলেটের অনন্য উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। চারদিকে ধূপ-ধূনা আর তাঁকে নিয়ে বেদনার প্রলাপ; হা-হুতাশ, চোখের জল, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর কষ্টের স্রোতধারা।
সজীব দেহের সুহাসিনীদি হারিয়ে গেছেন; কিন্তু মানুষকে ভালোবাসার যে ঊষ্ণ স্ফুলিঙ্গ তিনি রেখে গেছেন, অগণিত মানুষের মাঝে তাঁর স্নেহের সেই দীপশিখা প্রজ্বলিত থাকবে যুগ যুগ ধরে।