শ্রদ্ধাঞ্জলি, প্রেরণার উৎসমূলে

‘অর্পিত সম্পত্তি প্রতিরোধ আন্দোলন সিলেট’র ব্যানারে নগরীর রাজপথ তখন সরগরম। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন কর্মসূচী পালিত হচ্ছিল। তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবুল হোসেন কর্তৃক ‘সিংহ বাড়ি’র লীজ প্রদানের ঘটনায় তখন এক প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ায় সিলেটের সুধীমহল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটিকে অনাগরিক সম্পত্তি আখ্যা দিয়ে লীজ প্রদান করা হলে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়।

এসময় আন্দোলনকে গতিশীল করতে গঠন করা হয় ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ আন্দোলন কমিটি’। এই কমিটির আহবায়ক করা হয় সিটি মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে, সদস্য সচিব নির্বাচন করা হয় জাসদের জেলা সম্পাদক লোকমান আহমদকে। মোট ১০১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি সিলেটের রাজপথকে প্রকম্পিত করে তুলে।

অধ্যাপক হাবিবুর রহমান

সিলেটের অর্পিত সম্পত্তি নামের কালো আইনের ব্র্যাকেটবন্দি সম্পত্তি নিয়ে টানাহেঁচড়া, সিংহ বাড়ির লীজ প্রদানে জেলা প্রশাসকের ভূমিকা ও তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সবাই যখন সোচ্চার তখন সিলেটের কলম সৈনিকেরাও পিছিয়ে ছিলেন না। আন্দোলন কর্মসূচীর প্রতিটি সংবাদই গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছে স্থানীয় ও জাতীয় পত্র-পত্রিকায়। আর এই আন্দোলনকারীদের বটবৃক্ষের মত ছায়া দিয়েছিলেন হাবিবুর রহমান স্যার। তার সঠিক দিক নির্দেশনায় দিনে দিনে আন্দোলন কর্মসূচী তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। এ সময় আমি বেশ কয়েকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দৈনিক যুগভেরী ও আজকের কাগজ-এ লিখি। যা সে সময় বেশ আলোচিত হয়। আজকের কাগজ-এ এরকমই একটি প্রতিবেদন পড়ে খুব খুশি হন হাবিবুর রহমান স্যার। যেদিন প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় সেদিন অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ কমিটির পূর্ব নির্ধারিত সভা ছিল চৌহাট্টাস্থ সিংহ বাড়িতে। সভায় আমার রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে স্যার আমাকে অভিনন্দিত করার উদ্যোগ নেন। আমি বিষয়টি জানতাম না। লোকমান ভাইকে দিয়ে স্যার আমার মোবাইলে ফোন করান। আমি তখন জিন্দাবাজারস্থ রাজাম্যানশনে আজকের কাগজ’র অফিসে ছিলাম। ফোন রিসিভ করতেই লোকমান ভাই আমাকে বলেন- আমি যেন তাড়াতাড়ি সিংহ বাড়িতে চলে আসি, হাবিবুর রহমান স্যারসহ অন্যান্যদের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি লোকমান ভাইকে প্রশ্ন করে এর কারণ জানতে চাই। তিনি মিটিংয়ের কথা উল্লেখ করে দ্রুত সেখানে পৌছার জন্য বলেন। আমি হঠাৎ তলবের কি কারণ থাকতে পারে এনিয়ে ভাবনার অথৈ সাগরে ডুবে যাই।

রিকশায় করে মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যাই সিংহ বাড়িতে। সিংহ বাড়ির ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই হাবিবুর রহমান স্যার আমাকে তাঁর পাশে নিয়ে বসান। ঠিক সে সময়ই লোকমান ভাই আমাকে অভিনন্দিত করার কথা উল্লেখ করেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আগে পড়ার অভিজ্ঞতা না থাকায় একটু লজ্জা পেয়ে যাই। স্যার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তুমি তোমার নামের সাথে সুবিচার করেছ। আজকের কাগজ ও দৈনিক যুগভেরীতে যে রিপোর্টটি তুমি লিখেছ তা সত্যিই অপূর্ব হয়েছে। আমি আশির্বাদ করি তুমি আরও বড় হও। লেখনির পথে তোমার অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক।’ সর্বজন শ্রদ্ধেয় স্যারের এমন প্রশংসায় আমার হৃদয়ে আত্মতৃপ্তির অনুরণ খেলে যায়। আমি সে সময় কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে সবচেয়ে সুখী কলম সৈনিকের আসনে অধিষ্ঠিত করি। এরপর মিটিং শুরু ও শেষ হয়। তবে সেদিনের স্মৃতি আমার হৃদয়ে আজও সমুজ্জল। মাঝে মাঝেই সে কথা আমার হৃদয়ের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে। স্যারের স্নেহমাখা স্পর্শ আমাকে যে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলো তা সত্যিই অতুলনীয়।

হয়তো আমাকে অনুপ্রানিত করার জন্যই স্যার ডেকে এনেছিলেন। আদর করে পাশে বসিয়েছিলেন। তার এই ঔদার্য্য আজকের সমাজ ব্যবস্থায় শুধু অনুপস্থিতই নয় অপ্রত্যাশিতও।

অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ আন্দোলন সিলেটের সাথে যারা ছিলেন-আছেন তারা স্যারের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা, সাহস ও মনোবল পেয়েছিলেন। তাদেরকে অনেকটা আগলে রেখেছিলেন তিনি। শেষ বয়সে এসেও রাজপথে এই আন্দোলনের জন্য তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা। প্রতিটি সভায় সভাপতিত্ব করেছেন, শুধু তাই নয় ঠিক সময়মত হাজির হতেন সভাস্থলে, ঘঁড়ির কাটার সাথে। অনেক সময় দেখা গেছে- আয়োজকদের সবাই অনুষ্ঠানস্থলে না এলেও তিনি ঠিকই সেখানে হাজির হয়েছেন। সময়ানুবর্তিতার প্রতি কতটুকু সচেতন হলে এভাবে নিজেকে গড়ে তোলা যায় তা স্যারকে না দেখলে জানা হতো না। উদারতা, দৃষ্টিভঙ্গি আকৃষ্ঠ করা এবং কাছে টেনে নেয়ার তার যে অপরিসীম ক্ষমতা ছিল উল্লেখিত ঘটনা থেকে তা সহজেই অনুমেয় হয়।

হাবিবুর রহমান স্যার মূল্যায়ন করতে পারতেন, ছোট বড় কোন ভেদাভেদ তার কাছে ছিল না, তিনি মানুষকে মেধাও কর্ম দিয়ে মূল্যায়ন করতেন। ছিলেন কঠোর অধ্যবসায়ী, তার আচরণ ছিল পরিশিলিত। স্যারের ব্যবহারে কেউ কষ্ট পেয়েছেন এমন উদাহরণ দেয়া যাবে না। তবে অনেক অনভিপ্রেত আচরণে স্যারকে কষ্ট পেতে হয়েছিল।

সিংহ বাড়ি আন্দোলনের সময় স্যারের সাথে উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক। স্যার এ ঘটনায় মনে মনে খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন। তবে কাউকে মুখ ফুটে কিছু বলেন নি। তবে এর জবাব ভালোভাবেই তৎকালীন ডিসিকে দিয়েছিল সিলেটবাসী।

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তিনি ছিলেন আপোষহীন। সভা-সমাবেশে চেতনাকে জাগ্রত করার অভিপ্রায়ে তার বক্তব্য ছিল শাণিত। প্রগতির চেতনায় উজ্জীবিত এ সেনানীর বক্তব্য শুনে আমরা অনুপ্রাণিত হতাম।

যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রশ্নে হাবিবুর রহমান স্যার ছিলেন সোচ্চার। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন ’৭১ এ যারা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল, যারা রক্তে রঞ্জিত করেছিল সবুজ বাংলা, তাদের বিচার দেশের মাটিতেই হবে। বর্তমান সরকার জাতিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। স্যার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার তোড়জোর দেখে গেলে খুশি হতেন।

আরও কিছু বিষয় আলোচনা করা দরকার বলে আমি মনে করি। স্যার যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন সেই উচ্চতা নিয়ে তাঁর মধ্যে আমরা কোনোদিন দম্ভ দেখিনি। বরং দেখেছি-বিনয়, ভদ্রতা। মানুষকে আপন করার তাগিদ, ভালবেসে তার মধ্যে চেতনা জাগ্রত করার প্রয়াস।

স্যারকে যখন শাবির রেজিষ্টার হিসেবে প্রথমে নিয়োগদানের প্রস্তাব করা হয় তখন তিনি কতিপয় শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে অন্যতম ছিল- শাবিতে সমাজ কর্ম বিভাগ চালু করা। তার প্রত্যাশা অনুযায়ী শাবিতে শুধু সমাজ কর্ম বিভাগই চালু হয়নি, মোট ৮ টি বিভাগ নিয়ে পুরো সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদই প্রতিষ্টা পায়।

সমাজ কর্ম বিভাগের অধ্যাপক এই জ্ঞানতাপসের নিজের বিভাগের প্রতিও ছিল অগাধ ভালবাসা। শাবি উপাচার্যের পদ থেকে তিনি সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে নিজ বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন। সমসাময়িককালে এমন উদারতার পরিচয় দিয়েছেন এমন প্রতিভাধর পাওয়া যাবে না। শুধু তাই নয়, উপাচার্য থাকাকালীন সময়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত বিভাগের প্রথম ক্লাসে এসে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে তিনি পরিচিত হতেন। আমাদের দেশে ক’জন উপাচার্য এমন হতে পেরেছেন তা ইতিহাসই বলতে পারবে। তবে আমার জানামতে-এরকম উদাহরণ খুব একটা নেই।

স্যার সর্বদাই সময়ানুবর্তিতায় সচেষ্ট ছিলেন। সময়ের প্রতি তিনি কখনও উদাসীন ছিলেন না। কিন্তু স্যারকে এই সময়ের কাছেই পরাজিত হতে হয়েছে। মৃত্যুর সময়কে তিনি উপেক্ষা করতে পারেন নি। ২০০৬ সালের ২৭ জুলাই তাকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয় প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে। অনেকেই হয়তো স্যারকে ভুলে গেছেন। আবার অনেকের মানসপটে হয়তো চিরকালের মতো তিনি আসীন আছেন। তবে ইতিহাসের পাতা থেকে স্যারের নাম কখনও মুছে যাবেনা। তা লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে।

পরিশিষ্ট : এ লেখাটি যখন শেষ করি ঠিক তখনই জানতে পারি শাবিতে অধ্যাপক হাবিবুর রহমানের নামে একটি কর্নারের উদ্বোধন করা হয়েছে। শাবির সমাজকর্ম বিভাগের উদ্যোগে বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরীতে এ কর্নারের উদ্বোধন করেছেন ভিসি প্রফেসর ড. সালেহ্ উদ্দিন। প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর ও শাবির সমাজকর্ম বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর হাবিবুর রহমানের ব্যাবহৃত বুক সেলফ ও বই নিয়ে এ কর্নারের যাত্রা শুরু হয়েছে। এর আগের তাঁর দুই মৃত্যুবার্ষিকীতে শাবিতে এই প্রয়াতের স্মরণে কোন অনুষ্ঠানই হয়নি! বুঝা গেল তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীকে সামনে রেখে শাবি কতৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপাচার্যের স্মৃতি অমলীন রাখতে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে। আমরা যুগভেরীতে অনেকটা দুঃখ করেই প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে লিখেছিলাম-‘শাবি ভুলে গেছে তার শ্রেষ্ঠ উপাচার্যকে।’ ক্ষোভ থেকে লেখা এই প্রতিবেদনটি নীতি নির্ধারকের মধ্যে কেউ পড়লে পড়ে থাকতে পারেন। শাবি কতৃপক্ষ প্রমাণ করেছেন-শাবি ভুলে যায়নি এই জ্ঞানতাপসকে।