যুগসন্ধিক্ষণে গণমাধ্যম!

কোন মাধ্যমটি অধিক শক্তিশালী, গণমাধ্যম নাকি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম-এ কথাটি জুরে-সুরেই এখন উচ্চারিত হয়। সংবাদমাধ্যমের বিকল্প হিসেবে ফেসবুক, টুইটারসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগাযোগের মাধ্যম এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে এতকাল ধরে দাপট দেখিয়ে আসা সংবাদপত্রের জনপ্রিয়তাও আজ হুমকির মুখে পড়েছে! দিন দিন এসব মাধ্যমের প্রতি মানুষের আসক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় চিরাচরিত প্রচার মাধ্যমের জন্য এগুলো আজ শঙ্কেটর কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো মূলধারার সংবাদপত্রের জন্য রীতিমত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া নয় সোশাল মিডিয়াকে মোকাবেলা করাই এখন পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু কেন এই ছন্দপতন? কেনইবা এর প্রভাব পড়ছে প্রিন্ট মিডিয়ার সার্কুলেশনের উপর, কেন কমছে টিভির দর্শক? একেবারে সহজেই দেওয়া যাবে এর উত্তর। ডিজিলাটাইজেশন অর্থাৎ প্রযুক্তির উৎকর্ষতা। বিজ্ঞানের আশির্বাদ হিসেবে আমাদের হাতে হাতে যে সেলফোনগুলো রয়েছে তার অধিকাংশতেই আছে ইন্টারনেট সংযোগ। এই সংযুক্তির কারনে সামাজিকযোগাযোগের মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত রয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। যার ফলে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ওয়াটস অ্যাপ এখন হাতের মুঠোয়। ইচ্ছে খুশিমত যখন তখন যেমন এসব যোগাযোগমাধ্যম ব্রাউজ করা যায় তেমনই প্রত্যক্ষ করা যায় এই মাধ্যমগুলোতে আসা তথ্য, ছবি, কিংবা ভিডিও। আর এই সহজলভ্যতাই এসব মাধ্যমের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করে রেখেছ। পত্রিকায় খবর পড়তে গেলে যেমন পরদিন সকালের অপেক্ষা করতে হয়, তেমনই টিভি চ্যানেলে সংবাদ দেখতে হলে সেটের সামনে বসতে হয় নির্ধারিত সময়ে; কিন্তু প্রযুক্তনির্ভর এসব মাধ্যমগুলো চব্বিশ ঘন্টাই সচল থাকে। যার ফলে যখন—তখন এগুলো যেমন দেখা যায় তেমনই এর বদৌলতে তাৎক্ষনিক অনেক খবর জেনে নেওয়া যায়।

প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াকে শক্তিশালী করতে বা সময়ের সাথে চলতেও ভূমিকা রাখছে সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমগুলো। মুহুর্তের মধ্েয সংবাদকে সর্বমহলে ছড়িয়ে দিতে ফেসবুক টুইটারসহ অন্যান্য মাধ্যমে শেয়ার করা এখন নৈমত্তিক ব্যাপার। এর মাধ্যমে সহজেই যেমন পরিচিত এবং ঘনিষ্টজনদের মধ্েয ছড়িয়ে দেওয়া যায় নিজের ভাবাবেগ, তেমনই এর সুবাদে সেটা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। যান্ত্রিকতার এই সময় পত্রিকা কিনে পড়ার যেমন সুযোগ হয়না অনেকের তেমনই ইচ্ছে থাকা সত্বেও নির্দিষ্টতার বাইরে যেতে পারেন না কেউ কেউ। তাছাড়া একজন মানুষ একটি বা একাধিক গণমাধ্যমের বেশি বাসায় রাখেন না, রাখতে চানও না। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে হরেক রকম সংবাদ এবং সবাদমাধ্যম প্রতিনিয়তই নজরে আসে আমাদের। একথা বললে মোটেই অত্যুক্তি হবেনা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো এখন বিকল্প গণমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এর যেমন ভালো দিক আছে, তেমনই আছে মন্দ দিক। অর্থাৎ কুফল। সমাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেক সময়ই ভুয়া সংবাদ চলে আসে এবং সেটা যাচাই বাছাই না করেই অনেকে গ্রহন করে ফেলেন। গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের যে চেষ্টা চলে সেক্ষেত্রে সফল হয়ে যায় ষড়যন্ত্রকারীরা! যা অনেক সময় আমাদের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য হুমকীর কারন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক এরকম কয়েকটি ঘটনার সাক্ষি হয়েছি আমরা। যা আমাদের সামাজিক বন্ধনকেও করেছে ক্ষতিগ্রস্থ। তৈরি করেছে বিশ্বাস—অবিশ্বাসের বাতাবরণ।

গণমাধ্যমের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের দাপট বৃদ্ধির কারন অন্যখানে। একটি দৈনিক পত্রিকার সার্কুলেশন যতই থাকুক না কেন সেটি মুহুর্তেই পৃথিবীব্যাপি পৌছতে পারেনা! ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটা ছবি বা ভিডিও যতটা দ্রুত হাতে হাতে পৌছে যায় ততটা দ্রুত পৌছতে পারেনা প্রিন্ট কিংবা ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমগুলো। এই একটিমাত্র কারনে মূলধারার সংবাদপত্রের সাথে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর পার্থক্য। একজন সংবাদকর্মী ঘটনার খবর অবগত হয়ে সেখানে ছুটে যান। কিন্তু ঘটনার আশে পাশে থাকা ব্যক্তিটি যখন তার মত করে তাৎক্ষনিক সেটাকে লিখে ছবি কিংবা ভিডিওসমেত পোস্ট করেন এবং আপডেট দিতে থাকেন তখন দিনান্তে মানুষের জানার আগ্রহ পূর্ন হয়ে যায়। কেউ কেউতো লাইভ দিয়ে দেন। এসব কারনে বলা যেতে পারে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো অনেকটা গণমাধ্যমের ভূমিকা পালন করছে এখন। আর এটাই মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের বিপরীতে চলে যাচ্ছে এবং তার শক্তিকে করছে খর্ব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের শক্তি ঠিক কতোটা তার প্রমান পাওয়া গেছে আমেরিকার সর্বশেষ নির্বাচনে। ফেক নিউজই ট্রাম্পের বিজয়ে ভূমিকা রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

লাভের দিক থেকেও এই মাধ্যমগুলোর সাফল্য আকাশছোঁয়া। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্কজুকারবাগের ধর্নাঢ্য ব্যক্তিদের তালিকায় ৩ নাম্বারে থাকা সেই সাক্ষ্যই বহন করছে। এই টাকার বড় একটা অংশ আসছে প্রচারণা এবং বিজ্ঞাপন থেকে। পরিসংখ্যান বলছে, মোট বিজ্ঞাপনের বড় একটা অংশ এখন ইন্টারনেটভিত্তিক প্রচারমাধ্যমের দখলে চলে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে এতকালের মূল ধারার প্রচার মাধ্যমে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কোনও কোনও গণমাধ্যম প্রিন্ট সংস্করন বন্ধ করে চালু করেছে অনলাইন সংস্করণ। স্বভাবতভাবেই প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, তাহলে কি ফুরিয়ে এসেছে প্রিন্ট গণমাধ্যমের দিন? 

বিকল্প গণমাধ্যমের এই দাপট অব্যাহত থাকলে, একসময় ফেসবুক নিউজ প্রচার শুরু করলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। দক্ষিন এশিয়ায় লা-লীগা সরাসরি সম্প্রচারের এই উদ্েযাগ সেই প্রক্রিয়া বা প্রচেষ্টার যে অংশ সেটা বলা যায় নির্দিধায়। আজ পাল্লা দিলেও কালকের দিনটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা নেটকেন্দ্রিক প্রচার মাধ্যমের যুগ এটা বলা বোধহয় অমূলক হবেনা। অর্থাৎ ডিজিটাল মিডিয়ার দাপটের সামনে এখন দাঁড়িয়ে আমরা। এটাকে যুগসন্ধিক্ষণও বলা যেতে পারে! আমাদের ঘাড়ের উপর তীব্র নিঃশ্বাস ফেলছে বিকল্প মাধ্যমগুলো। ভিজুয়ালের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। আমরা নেটে টিভি দেখতে শুরু করেছি। যে কারনে ডিসকানেকশনটি এখন অনেকের কাছেই অপ্রয়োজনীয়। প্রিন্ট সংস্করণেরও একই অবস্থা। মোবাইলে পত্রিকাগুলোর অনলাইন ভার্সন চালু থাকায় সেগুলো মেটাচ্ছে মানুষের জানার ক্ষুধা। যার ফলে আবেদন হারাচ্ছে প্রিন্ট সংস্করন। ইংল্যান্ড আমেরিকা কিংবা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে অধিকাংশ যেমন পত্রিকা কেউ কিনে পড়েনা তেমনই হয়তো বাংলাদেশেও একসময় বিনামূল্েয বিক্রি করতে হবে দৈনিক পত্রিকা। সেইদিন বোধহয় খুব বেশি দূরে নয়! আর এটা হবে শুধুমাত্র ইন্টারনেটভিত্তক প্রচারমাধ্যমের কারনে। তাই শক্তির বিচারে সোশ্যাল মিডিয়াকে এগিয়ে রাখলে অত্যুক্তি হবে না মোটেই!

দৈনিক মানবকন্ঠে প্রকাশিত