বইমেলায় মানসম্পন্ন বইয়ের অভাব?

বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয়না, বলেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। সত্যিই কী বই কিনে দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা নেই?- প্রশ্নটি আপেক্ষিক! ঠিক যে সময়টায় দাঁড়িয়ে প্রখ্যাত এই কথাসাহিত্যিকের কথার উদৃতি দিচ্ছি, তা কতটা যুক্তিযুক্ত সেটি কিন্তু ভাববার বিষয়। তারপরও উদাহরণ হিসেবে আমরা এই কথাটি আরও বহুকাল ব্যবহার করতে চাই এমন বিশ্বাস থেকে ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া’ হবে না!

বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ তৈরি করতেই মুজতবা আলী যে এমনটি বলেছিলেন এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বাঙালির বই প্রীতি দিন দিন বেড়েছে বৈ কমেনি। সময়ের প্রয়োজনে যেমন জন্ম হয়েছে অসংখ্য লেখকের তেমনই সৃষ্টি হয়েছে অগনিত পাঠক। লেখক আর পাঠকের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করতে গড়ে উঠেছে একের পর এক মুদ্রন প্রতিষ্ঠান এবং অসংখ্য প্রকাশনা সংস্থা। সময়ের বিবর্তনে এই ক্ষেত্রটি আজ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে শিল্প হিসেবে। আমরা যদি একটু পিছনে ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, দুইদশক পূর্বেও প্রকাশনা সংস্থা বলতে যেখানে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান ছিলো এখন সেখানে দাপট দেখাচ্ছে শত শত প্রতিষ্ঠান।

এবং দিন দিন এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যার ফলে আঙুলে গুনে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম বলা এখন কঠিন ব্যাপার! প্রতিবছরই বাড়ছে মেলায় অংশগ্রহনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। গতবছর যেখানে অংশ নিয়েছিলো ৪১১ প্রতিষ্ঠান এবার সেখানে স্টল বরাদ্দ পেয়েছে ৪৫৫ টি সংস্থা। সংখ্যা বৃদ্ধির এই চিত্রটি নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক।

অগ্রগাতির এই চিত্রটি প্রকাশনা শিল্পের বর্তমান অবস্থারই পরিচায়ক। গড়ে উঠা এই প্রকাশনা সংস্থাগুলোর কারণেই অমর একুশে গ্রন্থমেলা বিশ্বের ইতিহাসের দীর্ঘ বইমেলায় পরিণত হয়েছে। যা প্রতিবছর বাংলাভাষাভাষীদের জন্য বয়ে আনছে উৎসবের বারতা। মাসব্যাপি এই বইমেলা নানা কারণে বাঙালির চেতনার ফল্গুধারার সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। যা সৃজনের মন্ত্রেও দীক্ষিত করছে আমাদের।

বইমেলা ঠিক কতটা উদ্বুদ্ধ করছে আমাদের তা বই প্রকাশের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে সহজেই অনুমান করা যায়। বই উৎসব উপলক্ষে প্রতিবছর বের হচ্ছে প্রায় চার হাজার বই। এইযে হাজার হাজার বই প্রকাশিত হচ্ছে মেলা উপলক্ষে এর যেমন ভালো দিক আছে, তেমনই মন্দ দিকও কম নয়। ভালোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে মন্দের পাল্লাই ভারী! মন্দ বলতে আমি মানসম্মত বইয়ের কথা বলছি। তাড়াহুড়ো করে বই প্রকাশ করতে গিয়ে বইয়ের মানটাই অনেক ক্ষেত্রে রক্ষা করা যাচ্ছেনা। যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত না হওয়ায় অসংখ্য বই মানহীন বইয়ের কাতারে চলে যাচ্ছে। এই বিষয়টিই আমাদের শঙ্কায় ফেলছে। যা বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রেও ভালো কোনও লক্ষণ নয়। সচেতন লেখক পাঠক প্রত্যেককেই উদ্বিগ্ন করে তুলেছে বিষয়টি।

এসব বই নিয়ে কথাসাহিত্যক হরিশংকর জলদাস এতটাই ক্ষুব্ধ যে এগুলোকে তিনি স্রেফ ‘জঞ্জাল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। উল্টো প্রশ্ন রেখেছেন, ‘এত জঞ্জাল বের করার কি দরকার’? বাংলাসাহিত্যকে ভালোবাসেন বলেই তাঁর এমন খেদোক্তি। হরিশংকর জলদাসের এই বক্তব্যের সাথে হয়তো দ্বিমত পোষণ করবেন না কেউ! কারণ ভাষার মাসে ভাষার প্রতি এই অবহেলা সত্যি সত্যিই বেদনা জাগায়।

মানসস্পন্ন বই বলতে ঠিক যে ধরনের বইয়ের কথা বলা হচ্ছে সেরকম বই বের করা আসলে কঠিন বা দুরূহ কোনও কাজ নয়। স্রেফ অবহেলা আর মানসিকতার কারণেই আসলে থমকে আছে শুদ্ধতার চর্চা। প্রথমত ভুল বানান অর্থাৎ প্রুফ না দেখা এবং দ্বিতীয়ত অসম্পাদিত অর্থাৎ সম্পাদনা না করা। এই দুটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যে বইগুলো বাজারে আসে সেগুলো নিয়ে আসলে তেমন কোনও অভিযোগ নেই। পিতা মাতা যেমন বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিতে চান না, ঠিক তেমনই লেখকও চান না নিম্নমানের বই বাজারে আসুক। অথচ সেটাই হচ্ছে! এবং সেটা লেখক তার নিজের টাকা খরচ করেই বের করছেন। এটা খুবই দুঃখের বিষয়। প্রকাশক টাকা নিচ্ছেন ঠিকই কিন্তু বইয়ের ভালো মন্দের কোন ধার ধারছেন না তিনি।

পরিস্থিতি ঠিক কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে একটি উদাহরণ দিলে কিছুটা হলেও তা অনুমান করা যাবে। এবারের বইমেলায় বই প্রকাশের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা আমার সঙ্গে সহভাগ করতে গিয়ে ফেসবুকের ইনবক্সে একজন লেখিকা যে কথাগুলো জানিয়েছেন তা হুবহু তুলে ধরলাম এখানে।

বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত

লেখিকা দুঃখ করে বলেছেন, ‘ঐ প্রকাশনা সংস্থা ১০ তারিখ আমাকে একটা বই পাঠিয়েছিল মেলায় নামানোর আগে। কিন্তু প্রোডাকশন অত্যন্ত নিম্নমানের হওয়াতে আমি বাতিল করে দিয়েছি…। এখন নতুন করে সবকিছু সম্পন্ন হচ্ছে। প্রচ্ছদসহ বেশ কিছু পরির্বতনের ফলে মেলায় দেরি করে আসছে। … আমার মন প্রচণ্ড খারাপ। এটা খুব অন্যায় হয়েছে। যা আমি মেনে নিতে পারছি না। বইটির ছাপা হবার পেছনে ৬০ হাজার টাকা ইতোমধ্যে খরচ করে ফেলেছিলাম। ওরা বিল করেছে ৬৬ হাজার! ৬ ফর্মা ৫০০ কপি স্পেশাল বাঁধাই বিদেশি গ্রাউন্ড করা পেপার। ভেতরে ১২ পেইন্টিং প্লাস উন্নত কাভার পেপার। বাকি আর সবতো আছেই। সব মিলিয়ে ৮০ পরতো। তবুও মনের মত না হওয়াতে আমি আপসেট। অসংখ্য ভুল। বুক মেকাপ ফ্রন্ট আরো ইত্যাদির কারণে বইটি প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি।’

এ কারনে তার আটটি দিন বিষণ্ণতায় কেটেছে এবং সেটি তিনি ফেইসবুকে লিখে দিনগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রকাশা সংস্থার কাছে!

চিন্তা করুন, একটি কবিতা বইয়ের জন্য ৮০ হাজার টাকা নিচ্ছেন প্রকাশক। তাও আবার মানের দিকে বিন্দু পরিমান খেয়াল করেননি তিনি। তার যেনও কোন দায় নেই! খোঁজ করলে এ রকম অসংখ্য অভিযোগকারী পাওয়া যাবে। আফসোস হয়, এই কবিরা পান থেকে চুন খসলে ফেসবুকের পাতা সরগরম করেন। অথচ নিজেরা যখন ঠকেন কিংবা প্রতারিত হন তখন টু শব্দটিও করেন না! কেন? পাছে অর্থের বিনিময়ে বই করেছেন এটা প্রকাশ হয়ে যাবে এই ভয়ে।

একজন লেখক নিজের টাকায় বই বের করতেই পারেন। এটা দোষের কিছু নয়। যিনি ছাপবেন অর্থ নিয়ে ছাপতে পারেন এতেও আপত্তি নেই। আপত্তি দুটি জায়গায় প্রথমত তিনি যেহেতু ব্যবসা করছেন সেটা একটা নির্দিষ্ট মান বজায় রেখে করুন। কারণ অন্য আর দশটা ব্যবসার মতো এই ব্যবসাটা ঠিক ব্যবসা নয়। দ্বিতীয়ত যিনি টাকার বিনিময়ে বই প্রকাশ করবেন তিনি যেনও নিজেকে প্রকাশক দাবি না করেন। ড. জাফর ইকবালের বক্তব্যকে এক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত মনে করি। তিনি বলেছেন, ‘যদি একজন লেখক নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কোনো একজন প্রকাশককে দিয়ে তার বই বের করেন তাহলে সেই প্রকাশককে ‘প্রকাশক’ বলা যাবে না, তাকে ‘মুদ্রক’ বা এই ধরনের কিছু বলতে হবে। প্রকাশক তিনি, যিনি কোনো একজন লেখক গবেষকের কাজটুকু নিজের দায়িত্বে পাঠকদের সামনে তুলে ধরবেন। সেই কাজটুকু করার জন্য তার যদি অর্থের প্রয়োজন হয় সেই অর্থটুকু প্রকাশকের নিজের জোগাড় করতে হবে।’ ঠিক তাই।

লেখকের টাকা দিয়ে বই বের করে আসলে সত্যিকারের প্রকাশক হওয়া যায়না! প্রকাশক হতে গেলে থাকা চাই যথাযথ সততা ও নিষ্ঠা।

বেশ কয়েক বছর ধরে বইমেলা নিয়ে লিখতে গিয়ে মানহীন বইয়ের কথা বার বার লিখেছি। যাদের সঙ্গে কথা হয়, তাদের প্রত্যেকেই বলেন একই কথা। মেলা শেষ, কথাও শেষ। আবার মেলা, আবার তাড়াহুড়ো, আবার বই প্রকাশে যথেচ্ছাচার।

সকল প্রকাশনা সংস্থা যে এই স্রোতে গা ভাসাচ্ছে সেটা কিন্তু নয়। অনেক প্রকাশনা সংস্থা আছে যাদের এডিটর থেকে শুরু করে রিভিউয়ার, প্রুফ রিডার সবই আছেন। তারা সময় নিয়ে মানসম্মত বই ঠিকই বের করছেন। সেটি নিজেদের টাকায়। লেখকদের নিয়ম মেনে দিচ্ছেন রয়ালটি।

কেউ কেউ মেলাকেন্দ্রিক বইপ্রকাশকে মানহীনতার জন্য দায়ী করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে ঘটছেও তাই। আমরা বইমেলা এলে বই প্রকাশের জন্য ঠিক যেভাবে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি, সারাবছর কিন্তু সেভাবে সময় দিইনা। এইযে উদাসীনতা সেটাও কিন্তু মান নিম্নমুখিতা হওয়ার অন্যতম একটি কারণ। যেভাবেই হউক বইমেলায় বই প্রকাশ করা চাই। যেনতেন হলেও আপত্তি নেই! এইযে মানসিকতা এটাকে কাজে লাগিয়েই বাণিজ্য করছেন এক শ্রেণীর প্রকাশক দাবিদার মুদ্রকেরা। অথচ একজন প্রুফরিডার দিয়ে ভুল সংশোধন করিয়ে, সম্পাদক দিয়ে সম্পাদনা করিয়ে যদি বইটি প্রকাশ করা হতো তাহলে আর যাই হোক মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতো না। তখন বই কিনে মনোবেদনা পেতে হতো না পাঠককে!

নিয়ম আছে মার্চ থেকে প্রকাশিত বইগুলো পরবর্তী বইমেলার নতুন বই হিসেবে গণ্য করা হয়। তাহলে তাড়াহুড়ো কেন? একটু সময় নিয়ে বই করলেতো সেই অভিযোগ থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যায়।

প্রকাশকদেরও এনিয়ে আক্ষেপ আছে। অন্বেষা প্রকাশনের শাহাদাতের হোসেনের বক্তব্যে আমরা তারই আভাস পাই। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমরাও চাই মানসম্পন্ন বই বেশি প্রকাশ করতে। কিন্তু ভালো পাণ্ডুলিপি খুব একটা পাচ্ছি না। আমরা মানসম্পন্ন পাণ্ডুলিপি সঙ্কটে আছি।’ তিনি তার ফেসবুক একাউন্টে সাক্ষাৎকারটি শেয়ার করায় অনেকে কমেন্ট করেছেন। উৎস প্রকাশনের পরিচালক মোস্তফা সেলিম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘পাণ্ডুলিপি তৈরীতে মেধা, শ্রম ও অধ্যবসায় থাকাটা খুবই জরুরি। অথচ চলছে উল্টো। চাইলে যে কেউ বই বের করতে পারে। এটা ফ্যাশনে পরিণত হয়ে গেছে। এর জন্য দায় আমাদের সকলেরই কমবেশি নিতে হবে।’

তার এই কথাটি আমার মনে ধরেছে। আসলে দায়টা আমাদের সবাইকেই নিতে হবে। কারণ আমরা বক্তৃতা বিবৃতিতে যেমনটি বলি কিংবা বাস্তবে যা করি তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। এই ব্যবধান কমাতে হবে। শুধু ফাঁকা বুলি আওরালে চলবেনা।

ওমর খৈয়ামের উক্তি দিয়ে শেষ করতে চাই লেখাটি। তিনি বলেছিলেন, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে/প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে/কিন্তু বই একটি অনন্ত যৌবনা/যদি তা তেমন বই হয়।’ সত্যিই তাই। আজকে যে হারে বই বের হচ্ছে তার মধ্যে ঠিক কতটি বই অনন্ত যৌবনা হবে তা বলা মুশকিল!

সত্যিকার অর্থে বইকে অনন্ত যৌবনা করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই নির্ভুল ও মানসম্মত বই প্রকাশের চর্চা করতে হবে। নইলে অর্থ ও সময় ব্যয় হবে ঠিকই কালোত্তীর্ণ কিছু হবেনা। একজন লেখক হিসেবে প্রত্যেক লেখকের প্রতি অনুরোধ আসুন চেষ্টা করি নির্ভুল, মানসম্পন্ন গ্রন্থ রচনার। তাহলে যেমন সমৃদ্ধ হবে বাংলা সাহিত্য, তেমনই লেখক হিসেবে আসবে তৃপ্তি।

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮