জিয়া উদ্দিনের যুদ্ধ শেষ হয়নি এখনো!

একাত্তরে মানবতার সেবায় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ। পাকিদের হাতে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতে গিয়ে সিলেট সদর হাসপাতালে হায়নাদের গুলিতে ঝাঝড়া হয়েছে তাঁর বুক। সংকটাপন্ন রোগিদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন তিনি উৎসর্গ করেছেন স্বাধীনতার বেদীমূলে। হাসিমুখে আলিঙ্গন করেছেন মৃত্যুকে। অন্যদিকে, দেশমাতৃকাকে পাকিদের হাত থেকে রক্ষা করতে তাঁরই সন্তান জিয়া উদ্দিন হাতে তুলে নেন অস্ত্র। যুদ্ধ করেন জীবন বাজি রেখে। লড়াই শেষে সিলেটে ফিরে তিনি জানতে পারেন, স্বাধীনতার বেদীমূলে উৎসর্গিত হয়েছে প্রাণপ্রিয় পিতার প্রাণ। সঙ্গী হারা হয়েছেন কল্যানব্রতী মা হোসনে আরা আহমেদ। সেদিনই জিয়া আমৃত্যু পিতার মতো মানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকার শপথ নেন। সেই থেকে আজঅবদি মানবকল্যাণ থেকে একদিনের জন্যও দূরে সরেননি! যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান হিসেবে দেশের কন্যাণে, মানুষের কল্যাণে নিবেদিত রয়েছেন তিনি।

১৯৫২ সালে সিলেটে জন্ম নেয়া জিয়া উদ্দিন আহমেদ মা বাবার হাত ধরে শৈশবেই যুক্ত হন মানবসেবায়। দরিদ্রদের সহায়তায় পিতা ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ পরিচালিত প্রতিটি মেডিক্যাল ক্যাম্পের সঙ্গেই যুক্ত থাকতেন। আর নারী শিক্ষার প্রসারে মাকে দিয়েছেন যোগ্য সন্তানের মতোই সঙ্গ। একদিকে সেবামূলক কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্তি অন্যদিকে চালিয়ে যেতে থাকেন লেখাপড়া। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মার্চ মাসেই বন্ধু কর্নেল এম এ সালামের সঙ্গে ঝাপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। ৩ নং সেক্টরে মেজর হেলাল মোরশেদের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি সফল অপারেশনে অংশ নেন তিনি। যুদ্ধ শেষে সিলেটে ফিরে পিতার মৃত্যু সংবাদ শুনে মুষড়ে পড়েন। বেদনায় নীল হয়ে যায় তাঁর শরীর! পারিবারিক অগ্রযাত্রায় ঘটে ছন্দপতন। এই পরিস্থিতিতে দৃঢ়চেতা মা হোসনে আরা আহমদের প্রচেষ্টায় লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন। কঠিন একটি সময় পারি দিয়ে ১৯৭৬ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করেন এমবিবিএস। এরপর ১৯৮০ সালে উচ্চশিক্ষার্থে পারি জমান আমেরিকায়। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন পরিস্থিতি, কিন্তু হৃদয়ে স্বদেশকে লালন করে সমৃদ্ধির পথে শুরু হয় তাঁর পথচলা। আমেরিকায় বসবাসরত বাঙালিদের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি দেশের মানুষের কল্যানে কাজ করে যেতে থাকেন। সময় পরিক্রমায় তাই আজ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাঙালিদের অন্যমত আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছেন তিনি। তাঁর কাছে সাহায্য সাহযোগিতা চেয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছে কেউ, এমন নজির নেই। আমেরিকায় বাঙালিদের প্রতিনিধিত্বশীল প্রায় সকল সংগঠনের সঙ্গেই যুক্ত রয়েছেন একাত্তরের এই বীর সেনানী। কোনও সংগঠনের উপদেষ্টা, কোনটার চেয়ারম্যান, কোনটির সভাপতি আবার কোনটির চীফ পেট্রোন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালির সংস্কৃতি বিকাশে ভূমিকা রাখায় তুলনা করার মতো তাঁর ধারে কাছেও নেই কেউ। মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিউইয়র্ক বইমেলা আয়োজনে যেমন তাঁর অনন্য ভূমিকা রয়েছে তেমনই, তাঁর উদ্যোগে বেশ কয়েকটি সংগঠনে বিভেদ ভুলে একত্রিত হয়েছে বাঙালিরা। এরকম একটি ঐক্যের প্রতিফলন ঘটেছে বিশ্ব সিলেট সম্মেলনে। আমেরিকায় এই সম্মেলনের সফল আয়োজন করে তিনি যে নজির স্থাপন করেছেন তা এক কথায় অনন্য। শেকড়ের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কারনেই তাঁর হাত ধরে এসেছে এমন সাফল্য। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদসহ অসংখ্য বিশ্ববরণ্য সিলেটীর অংশগ্রহনে অনুষ্ঠানটি হয়েছে ঋদ্ধ।

কিডনি, মেডিসিন, হাইপার টেনশন, ক্রিটিকাল কেয়ারসহ মোট পাঁচটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতিমান তিনি। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের চিকিৎসা সেবার উন্নয়নেও প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন জিয়া উদ্দিন। আমেরিকার ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটির এই প্রফেসর ইতোমধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুমুদিনি হাসপাতাল, সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কিডনি ফাউন্ডেশন-সহ বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে নানা ধরণের চিকিৎসা উপকরণ প্রদানে পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সেইসঙ্গে চিকিৎসা ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা সাধনে বিদেশী ডাক্তারদের দিয়ে দেশে বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছেন তিনি। তারই প্রচেষ্ঠায় সিলেটে বাস্তবায়ন হতে চলেছে কিডনি হাসপাতাল। খুব শীগগীর শুরু হতে যাচ্ছে এই হাসতালের কার্যক্রম। কিডনি হাসপাতালে অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হবে রোগীদের। এই হাসপাতালের আয়ের পুরো অর্থই ব্যায় হবে হাসপাতালের উন্নয়নে, রোগীদের সাহায্যে।

অন্যদিকে ব্যতিক্রমী একটি উদ্যোগ গ্রহন করে প্রবাসীদের শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। শ্রীপুরে তারই উদোগে গড়ে উঠেছে দেশের কল্যানে নিয়োজিত রয়েছেন এমন প্রবাসীদের জন্য একটি গ্রাম। এনআরবি ভিলেজ নামে প্রতিষ্ঠা করা এই গ্রামে কেবল সেইসব প্রবাসীরাই থাকতে পারবেন যারা দেশের মানুষের কল্যানে নিবেদিত রয়েছেন।  

এছাড়াও শহীদ শামসুদ্দিন আহমেদ ট্রাস্ট এবং হোসনে আরা আহমেদ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রতিবছর দরিদ্র, অসহায় এবং মেধাবীদের কল্যানে যে অর্থ ব্যায় করে চলেছেন তিনি, তা তাঁর অসাধারনত্বেরই বহিপ্রকাশ। এ পর্যন্ত এই দুটি সংস্থার মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন হাজারো মানুষ। শহীদ শামসুদ্দিন ট্রাষ্টের পক্ষ থেকে প্রতিমাসে ১৫ টি দরিদ্র পরিবারকে সহায়তা এবং হোসনে আরা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রতিবছর ১১ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়ে থাকে। সিলেট সরকারী মহিলা কলেজে প্রতিবছর আনুষ্ঠারিকভাবে এই বৃত্তি বিতরণ করা হয়। তবে এই উদ্যোগটিও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ব্যতিক্রমী পন্থায়। সিলেটের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা ১১ ব্যাক্তির নামে চালু করা হয়েছে এই বৃত্তি। এর মাধ্যমে ঐ ১১ জন গুনীকে নতুন প্রজন্মের কাছেও তুলে ধরে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তবে, সব কিছুকে ছাপিয়ে শহীদ শামসুদ্দিন ট্রাষ্টের একটি উদ্যোগ ইতিহাসের পাতায় অমলীন থাকবে চিরকাল একথা বলা নিঃসন্দেহে। সিলেট নগরীর চোহাট্টা এলাকায় শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মান করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে লালনের যে প্রয়াস সেটি তাঁকে চিরভাস্মর করে রাখবে কালের ক্যানভাসে। তাঁর জনকল্যানমূলক এসব কর্মকা-ে জীবন সঙ্গীনি হিসেবে ডা. ফাতেমা আহমদের যেমন অনন্য ভূমিকা রয়েছে তেমনি অবদান আছে ঘনিষ্ট বন্ধু বীরপ্রতিক কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুস সালামের। তাদের নিয়েই তিনি প্রবহমান রেখেছেন জনসেবা।      একাত্তরে দেশ নির্মানে যেমন ভূমিকা রেখেছেন জিয়া উদ্দিন, আজ তেমনই সমৃদ্ধ দেশ গঠনেও ভূমিকা রেখে চলেছেন তিনি। তাঁর মতে, কোনও সরকারের একার পক্ষে কখনোই একটি স্বনির্ভর, সমৃদ্ধ দেশ গঠন সম্ভব নয়। এ কারনে প্রয়োজন নাগরিকদের ভূমিকা রাখা। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায়ই স্বপ্নের স্বদেশ বিনির্মান সম্ভব। তিনি বলেন, স্বাধীনতা অর্জন করেই মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধ শেষ হয়না। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয় আমৃত্যু। সেই যুদ্ধই চালিয়ে যাচ্ছি আমি।