জগৎজ্যোতি ও তাঁর শেষ যুদ্ধ

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে যাদের নাম লেখা থাকবে তাদেরই একজন জগৎজ্যোতি দাস। হাসিমুখে স্বাধীনতার বেদীমূলে নিজের জীবন উৎসর্গ করে যারা আমাদেরকে পরাধীতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছেন-তাঁদের মধ্যে তিনি বীরত্বে শীর্ষ স্থানীয়। আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামের এক অখ্যাত নিু মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ওঠে এসে জগৎজ্যোতি মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে প্রতিনিধিত্ব করেছেন তা অনেকটা বিস্ময়কর ব্যাপার। ১৯৭১ সালের ১৬ নভেম্বর জ্যোতি হবিগঞ্জের বদলপুরে পাক আর্মির সাথে সন্মূখসমরে শহীদ হন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জগৎজ্যোতির নেতৃত্বাধীন দাস পার্টি ভাটি অঞ্চলে পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের কাছে ছিল আতংকের নাম। অনেকটা নিজস্ব পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনাকারী এই দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধার কাছে অসম্ভব বলে কিছু ছিলনা। হাসি মুখে বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে পারতেন তিনি। দাস পার্টির আক্রমনের তীব্রতায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আজমিরীগঞ্জ-শেরপুর রুটে নৌ-যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পাক সরকার। দাস পার্টির সদস্যরা নৌপথে এতটাই আক্রমণাত্মক ছিলেন যে তারা কখনো কখনো দিনে আট নয়টি কার্গো-কনভয়ও ডুবিয়েছেন বা ধ্বংস করেছেন। এছাড়াও একের পর এক ভাটির জনপদকে হানাদার মুক্ত করে জগৎজ্যোতি যুদ্ধের ময়দানে হয়ে ওঠেছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তির নায়ক। যে যুদ্ধে তিনি শহীদ হয়েছেন সেদিনও তাঁর নির্ভুল নিশানায় প্রাণ হারায় ১২জন পাকসেনা। এরপরই তাঁকে সর্বোচ্চ মরনোত্তর খেতাব প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা এই মুক্তিযোদ্ধাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে দূরে ঠেলে রেখেছে। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত সম্মাননা আজো যুক্ত হয়নি তাঁর নামের পাশে।

জগৎজ্যোতি ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম, জীতেন্দ্রচন্দ্র দাস। মাতা হরিমতি দাস। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে জগৎজ্যোতি ছিলেন সবার ছোট।

জগৎজ্যোতি স্থানীয় আজমিরীগঞ্জ ‘এমালগেমেটেড বীরচরণ হাইস্কুল’ (এএবিসি) থেকে ১৯৬৮ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেড়িয়ে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা চালান। কিন্তু অর্থনৈতিক দৈন্যতার কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই চাকুরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রথমে মাত্র পঁচাত্তর টাকা মাসিক বেতনে স্থানীয় জলসুখা ‘কৃষ্ণ-গোবিন্দ পাবলিক হাইস্কুলে’ শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এই স্কুলে জ্যোতি শিক্ষকতা করেন পুরো একবছর। এসময় তিনি ’৭০-এর অসহযোগ আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেন। শিক্ষকতা পেশা থেকে উপার্জিত অর্থ নিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের আশায় তিনি সুনামগঞ্জে পাড়ি জমান এবং সুনামগঞ্জ কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। সুনামগঞ্জ কলেজে অধ্যয়নকালীন সময়ে জ্যোতি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭১ সালে দেশের পরিস্থিতি দিনে দিনে ভয়াবহ আকার ধারণ করলে অন্যান্য স্থানের মত মুক্তি সংগ্রামের ঢেউ এসে ভাটি অঞ্চলেও আঘাত হানে। হাওর বেষ্টিত জনপদের মানুষও নতুন একটি স্বাধীন ভূ-খণ্ডের দাবীতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। সুনামগঞ্জ শহরের উত্তাল প্রতিবাদ-প্রতিরোধে জগৎজ্যোতিও অংশগ্রহন করেন।

সুনামগঞ্জ শহর পাকবাহিনীর দখলে চলে যাওয়ার পর স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ ও মুক্তিযোদ্ধারা বালাট চলে যান। সেখান থেকে প্রথম ১১৪ জনের যে দলটিকে ভারতের শিলং-এর গভীর অরণ্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য প্রেরণ করা হয় সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন জগৎজ্যোতি। ইকো-১ ট্রেনিং ক্যাম্পে ডিউটি সার্জেন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

ট্রেনিং পর্ব শেষে প্রশিক্ষণ নেওয়া এই দলটিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। তিন দলের মধ্যে একটি দল ডাউকী দিয়ে, অন্যটিকে চেলা দিয়ে এবং জ্যোতির নেতৃত্বাধীন দলটি বালাট দিয়ে টেকেরঘাট এসে পৌঁছে। এর আগে মেজর বাট ও ক্যাপ্টেন বার্মা দেশের অভ্যন্তরে সফল অপারেশন কীভাবে পরিচালনা করা যায় সে ব্যাপারে জ্যোতির সাথে পরামর্শ করেন। পরামর্শ অনুযায়ী চৌকশ একদল মুক্তিযোদ্ধা বাছাই করেন জ্যোতি। তাঁর পছন্দ করা এই দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ৪২। জ্যোতির নেতৃত্বাধীন এই দলটিই পরবর্তীতে ‘দাসপার্টি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে হবিগঞ্জ জেলা ছিল টেকেরঘাট সাব সেক্টরের অধীনে। টেকেরঘাট সাব সেক্টরের কার্যক্রম ছিল বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। মূলতঃ সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী বরশরা (বড়ছড়া) ক্যাম্প থেকেই এই সেক্টরের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হতো। টেকেরঘাট সাব সেক্টরের কার্যক্রম চালুর পর এই সেক্টরটি একটি অনন্য বৈশিষ্ট অর্জন করে। তা হচ্ছে- এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সীমান্তের ওপারে না যাওয়া। টেকেরঘাট সেক্টরের অধীনস্থ এলাকাসমূহের মধ্যে যে যে এলাকায় অভিযান পরিচালনা করার ছক তৈরি করা হয়েছিল তার মধ্যে দিরাই, শাল্ল¬া, ছাতক, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা (আংশিক) প্রভৃতি এলাকাসমূহ উল্লে¬খযোগ্য। এই জনপদগুলো ‘ভাটি অঞ্চল’ হিসেবে খ্যাত। ’৭১ সালে এই অঞ্চলে চলাচলের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌপথ। এছাড়া যাতায়াতের অন্য কোনো মাধ্যম ছিল না। যুদ্ধকালীন সময়ে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ হয়ে মৌলভীবাজার জেলার শেরপুর পর্যন্ত একটি নৌপথ চালু ছিল। অপরদিকে জামালগঞ্জ হয়ে সুনামগঞ্জ-ছাতক পর্যন্ত লঞ্চ চলাচল করতো। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই সড়ক পথে অগ্রসরমান হানাদারবাহিনীর রসদবাহী যানবাহনগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল। এই পরিস্থিতির হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য বিকল্প পন্থা হিসেবে খানসেনারা জলপথকে বেছে নেয়। পানিপথে পাকদের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও খাবার সামগ্রী সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জে অবস্থানরত সৈন্যদের কাছে দ্রুত পৌছে দিত এ কারণে ভাটি অঞ্চলে যাতায়াত করাও দুরহ হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের। বিকল্প পন্থা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্তের ওপারে অবস্থান করে দেশের অভ্যন্তরে পাকদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাঙ্গার পরিকল্পনা করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু এ ধরনের যুদ্ধে হানাদারদের দখলে থাকা এলাকাসমূহ মুক্ত করা প্রথম প্রথম অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ভিন্ন পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনার। এই প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখেই ইকো-১ ট্রেনিং সেন্টারে জ্যোতির নেতৃত্বাধীন দলটিকে সম্পূর্ণ গেরিলা পদ্ধতিতে কঠোর নিয়ম-শৃংখলার মধ্যে ট্রেনিং দেওয়া হয়।

প্রশিক্ষণ শেষে জগৎজ্যোতি এই দলটি দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পরই নৌপথে হানাদারদের বাধা প্রদানের বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়। নির্দেশ পাওয়ার পরই জগৎজ্যেতি হায়েনাদের ঠেকাতে একের পর আক্রমন চালাতে থাকেন। দাস পার্টির তীব্র আক্রমনের ফলে ঢাকা- শেরপুর রুট দিয়ে কিছুদিনের জন্য পাকদের নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তান সরকার রেডিওতে ঘোষণা করে, এই রুট দিয়ে চলচলকারী ব্যক্তিদের জানমালের দায়-দায়িত্ব সরকার নেবে না। জগৎজ্যোতির রণকৌশল ও সাহসিকতার কারণে নদীপথের অভিযানগুলো সফল হতে থাকে।

কুশিয়ারা নদীতে একটি কার্গো ডুবিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে দাসপার্টি নৌপথের অভিযাত্রা শুরু হয়। দিনে দিনে জ্যোতির নেতৃত্বে পানি পথের যুদ্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। জ্যোতির আওতাধীন নৌপথে অসংখ্য নৌযান ধ্বংস করা হয়। দাসপার্টি শুধু পাক হানাদারদের নৌযান ধ্বংসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাদের আক্রমণের ফলে নদী তীরবর্তী গ্রামসমূহ হানাদার ও তাদের দোসরদের আক্রমণের মাত্রা কমে আসে। সেই সাথে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রও চলে আসে দাসপার্টির হাতে। এই অস্ত্র জমা দেয়া হয়েছিল টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে। আর তখন জগৎজ্যোতি হয়ে ওঠেছিলেন যুদ্ধ মাঠের কীংবদন্তী। ১৩ টি সফল অভিযান পরিচালনা করে দাস পার্টির সদস্যরা।

জগৎজ্যোতির একের পর এক সাফল্যের কারনে তাঁকে যেকোনো মূল্যে পরাস্ত করার ফন্দি আটে হানাদার ও তাদের দূসররা। ১৯৭১ সালের  ১৬ নভেম্বর হবিগঞ্জের শাহজিরবাজারে অবস্থিত বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে পাকিদের পাতানো ফাদে আটকা পড়েন জগৎজ্যোতি। ঐদিন দাসার্টিকে ফাঁদে ফেলবার জন্য সেখানে পাকদের তিনটি টিম প্রস্তুত ছিল। দাসপার্টির কোনো সদস্যই তা টের পাননি। ঘড়ির কাটায় যখন সকাল পৌনে ৮টা, ঠিক সে সময় জ্যোতিদের নৌকার বহরটি হবিগঞ্জের ভেড়ামোহনা নদীতে পৌঁছায়। বদলপুর ইউপি অফিসের সামনে পৌঁছার পর মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে পান ৪/৫ জন রাজাকার ব্যবসায়ীদের নৌকা আটক করে চাঁদা আদায় করছে। ক্ষুব্ধ জ্যোতি রাজাকারদের ধরে আনার জন্য গোপেশ চন্দ্র দাশ (শহীদ), মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস, মতিউর রহমান, আইয়ূব আলী, আব্দুল মজিদ, নিতানন্দ, বিজয় দাস, ইদ্রিস আলী, আবু সুফিয়ান, সুবল চন্দ্র চৌধুরী প্রমুখকে নিয়ে তাদের পেছনে ধাওয়া করেন। সেখানে মূল নদীর সাথে একটি শাখা নদীর সংযোগ ছিল। এটি কিছুদূর এগুবার পর হাওরের সাথে মিলিত হয়েছে। ঐ শাখা নদীতে রাজাকারদের পূর্ব থেকে নৌকা রাখা ছিল। তারা সেখান থেকে নৌকা নিয়ে পালাতে চাইলে তাদের উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধারা ব্রাশ ফায়ার করলে ৩ জন রাজাকার মারা যায়। সেখান থেকে ২ জন রাজাকার লাফিয়ে পড়ে পাশ্ববর্তী গ্রামে গিয়ে অবস্থান নিলে তাদের উদ্দেশ্যে একটি মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হয়। নিক্ষিপ্ত এই মর্টার শেলটি একটি গাভির উপর বিস্ফোরিত হয়। প্রচণ্ড শব্দে মর্টার শেলের বিস্ফোরণ ঘটায় পূর্ব থেকে ওঁৎ পেতে থাকা পাকিস্তানী হানাদার ও রাজাকাররা দাসপার্টির অবস্থান সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যায়। মর্টার শেলটি যখন নিক্ষেপ করা হয় তখন খইয়াগুপি বিলের মাঝামাঝি স্থানে চলে আসে মুক্তিযোদ্ধারা। পিটুয়াকান্দি, পিরোজপুর, খইয়াগুপিতে অবস্থান নেওয়া হানাদার ও রাজাকারেরা এসময় তিন দিক থেকে ব্ল¬ক সৃষ্টি করে।

জ্যোতি বিলে যাবার আগে নদীতে রেখে যাওয়া দলকে বলে গিয়েছিলেন, সমস্যা হলে তারা যেন তাদেরকে ব্যাকআপ দেয়। কিন্তু হানাদাররা ব্ল¬ক সৃষ্টি করার কারণে অবস্থানস্থল থেকে বেশি দূর এগোতে পারেননি জ্যোতির সহযোদ্ধারা। তবে তারা ব্যাকআপ দিতে থাকেন। গ্রামগুলো পাশাপাশি হওয়ার কারণে তিনদিকের আক্রমণে পড়ে যায় দাসপার্টির সদস্যরা। পেছন দিক থেকে ব্যাকআপ পাওয়া গেলেও দেখা দেয় বিপত্তি। যতটা দূরত্বে থেকে তাদেরকে রক্ষা করার কথা তার চেয়ে অনেক পেছনে থেকে দাসপার্টির সদস্যরা হানাদারদের উদ্দেশ্যে গুলি করতে থাকেন। সামনের দিক থেকে হানাদারেরা জ্যোতিদের উদ্দেশ্যে গুলি নিক্ষেপ করতে থাকে। একপর্যায়ে অনেকটা ক্রসফায়ারের মধ্যে পড়ে যায় বিলের মধ্যে অবস্থান নেওয়া জগৎজ্যোতিসহ দাসপার্টির সদস্যরা। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রবর্তী দলকে হানাদারদের একটি দল এদিকে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত রাখে। যে রাস্তা দিয়ে তাদের পক্ষে বিলের মধ্যে আসা সম্ভব তারা সেখানে ব্ল¬ক সৃষ্টি করে রাখে। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রবর্তী দলও মূলদল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শত্রুপক্ষের ৪০/৫০ জনের একটি দল বিলের মধ্যে থাকা দাসপার্টির সদস্যদের সাথে গুলি বিনিময় অব্যাহত রেখে এগুতে থাকে। এককথায় অতিঅল্প মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে জগৎজ্যোতি শত্রু ব্যূহের মধ্যে হঠাৎ করে পড়ে যান। তাঁর কাছে রসদ সরবরাহ করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে।

অস্ত্রের মজুদ কমে যাওয়ায় বেকায়দায় পড়ে যায় দাসপার্টি। অন্যদিকে আক্রমণের তীব্রতায় ব্যাকআপ পার্টিও পিছু হটে। শেষ পর্যন্ত জগৎজ্যোতির সাথে শুধুমাত্র ১২জন যোদ্ধা থেকে যান বিলের মাঝে। যুদ্ধ চলতে থাকে। একপর্যায়ে একশ গজের মধ্যে চলে আসে হানাদাররা। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে হতবিহবল হয়ে পড়েন জ্যোতি। সহযোদ্ধা ইলিয়াস জগৎজ্যোতিকে জিজ্ঞেস করেন কি করব দাদা? উত্তর দেন জ্যোতি, ‘তর যা ইচ্ছা তুই তা কর।’ পরক্ষণেই বলেন, ‘পিছু হটলে কেউ রেহাই পাবে না। তারা আমাদেরকে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। যুদ্ধ করতে হবে। অন্যথায় পুরো দলই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’ সবাইকে বাঁচানোর জন্য তাঁর সঙ্গে থাকতে জ্যোতি ইলিয়াসকে নির্দেশ দেন। ইলিয়াস প্রশ্ন করেন, ওদেরকে কি পিছু হটতে বলব? জ্যোতি উত্তর দেন, ‘তর খুশি’। ইলিয়াস বুঝতে পারেন, সবাইকে রক্ষার জন্য এখানেই অবস্থান করবেন জ্যোতি। আর তাঁর সাথে তাকেও সেখানে অবস্থান করতে হবে। যুদ্ধ চলতে থাকে। বিকেল তিনটার দিকে দু’টি বিমান উড়ে যায় দাসপার্টির মাথার উপর দিয়ে। এর একটু পরই একটি গুলি এসে লাগে মুক্তিযোদ্ধা আইয়ূব আলীর শরীরে। গুলিবিদ্ধ আইয়ূব আলী ছটফট করতে থাকেন। তাকে নিয়ে হালকা ব্রাশ দিয়ে পিছু হটে আরও দু’জন মুক্তিযোদ্ধা। এসময় আরও একজন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হন। পাচজঁনের কোঠায় এসে পৌঁছায় দলের সদস্য সংখ্যা। কে কোথায় কীভাবে আছে কেউ জানেন না। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ইলিয়াসের বাম পাজরে এসে একটি গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে লাফিয়ে উঠেন ইলিয়াস। জ্যোতি তাকে জড়িয়ে ধরেন। বলেন, ‘কি বাচবেতো’? নিজের মাথার লাল গামছা খুলে জ্যোতি ভালো করে রক্ত পড়া বন্ধের জন্য ক্ষত স্থানে শক্ত করে বেঁেধ দেন। ইলিয়াস এসময় সহযোদ্ধাদের নির্দেশ দেন, তোমরা যেভাবে পার আত্মরক্ষা কর। আমরা তোমাদেরকে ব্যাকআপ দিচ্ছি।

একে একে সবাই চলে যান। এমনকি শেষ পর্যন্ত গুলি সরবরাহকারীও নিরাপত্তার জন্য ছুটাছুটি করতে থাকেন। যুদ্ধস্থলে কেবল ইলিয়াস আর জ্যোতি। চারদিকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি আর গুলি। তখনো ইলিয়াসের শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। উদ্বিগ্ন জ্যোতি। আশেপাশে কেউ নেই। সুযোগ নেই গুলি করে পিছু হটারও। ইলিয়াস জিজ্ঞেস করেন, কি করবো দাদা?  নিরুত্তর জগৎজ্যোতি। পুনরায় নিচুস্বরে যোদ্ধা ইলিয়াস বলেন, ‘চলো আমরা আত্মরক্ষা করি?’ তেজোদীপ্ত হয়ে জ্যোতি বলেন, ‘পালাবো না, সব কটাকে শেষ করে তবে যাব।’ তিনজন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হলেও ১২ জন পাক সেনাকে একাই পরপারে পাঠিয়ে দেন জ্যোতি। গুলি সরবরাহকারী না থাকায় বিপত্তি দেখা দেয়। জ্যোতি সিদ্ধান্ত নেন একজনের গুলি ফুরিয়ে গেলে অন্যজন তাকে লোড করতে সাহায্য করবে। পালাক্রমে চলতে থাকে গুলি লোড করা ও টার্গেট অনুযায়ী ফায়ার করার কাজ। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। জ্যোতির নির্ভুল নিশানার কারণে সামনের দিকে আর এগুতে পারে না হায়েনারা। বিলের পানিতে কি ঘটছে পাকরাও নিশ্চিত হতে পারে না।

পুবের আকাশের সূর্য পশ্চিম দিকে নিবু নিবু হয়ে হেলে পড়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণের গুলিও নেই। এই পরিস্থিতিতে ইলিয়াস জ্যোতিকে বলেন, ‘দাদা যে পরিমান গোলাবারুদ আছে তাতে বড়জোর সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াই করা যাবে। এর বেশি হবে না।’ দু’জনে সিদ্ধান্ত নেন সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার, এরপর সুযোগ বুঝে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে ফের আক্রমণের। আরও কিছু সময় কেটে যায়। বিকেল পৌনে ৫ টা নাগাদ একটি বুলেট বিদ্ধ হয় জ্যোতির শরীরে। সুঠাম দেহের প্রাণবন্ত জ্যোতি শেষবারের মতো চিৎকার দিয়ে উঠেন- ‘আমি যাইগ্যা!’।

ইলিয়াস পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখেন তাঁর প্রিয় কমান্ডার ও প্রাণপ্রিয়যোদ্ধা জ্যোতির তেজোময় দেহ পানিতে ডুবে যাচ্ছে। দ্রুত বেদনাহত চিত্তে এগিয়ে যান তিনি। বীরের ডুবন্ত দেহকে যখন শেষ রক্তিম আভায় তুলে ধরেন ইলিয়াস ততক্ষণে জ্যোতি প্রাণহীন। মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস তাঁর কমান্ডারকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে কোমর পানিতে কাঁদার মধ্যে নিথর দেহ ডুবিয়ে দেন সুযোগ পেলে পুনরায় এসে লাশ নেবার প্রত্যাশায়। নিজের একহাতে এসএমজি ও শহীদ জ্যোতির এলএমজিটি কাঁধে নিয়ে নিরাপদ দুরত্বে চলে আসেন ইলিয়াস। সেখান থেকে ফিরে এসে সহযোদ্ধাদের অবগত করেন করুণ কাহিনী। বদলপুর যুদ্ধে পার্টি জগৎজ্যোতি ও গোপেন্দ্র দাস শহীদ হন। আহত হন ৭জন মুক্তিযোদ্ধা।

বীরসেনানী ইলিয়াস যথার্থ শ্রদ্ধায় তার কমান্ডারের লাশ কাদার মধ্যে লুকিয়ে রাখলেও যুদ্ধ বন্ধের পর রাজাকারদের অব্যাহত অনুসন্ধানে কাদা থেকে উঠে শহীদ জ্যোতির লাশ ভাসতে থাকে বিলের রক্তাক্ত জলে। জগৎজ্যোতি সত্যিই মারা গেছেন কিনা তা নিশ্চিত হতে তাঁর লাশ হানাদাররা হন্য হয়ে খুঁজতে থাকে। একসময় হানাদাররা পেয়ে যায় তাঁর নিথর দেহ। স্থানীয় রাজাকাররা জগৎজ্যোতির লাশ সনাক্ত করে। এরপর পাক সেনারা রাজাকারদেরকে জগৎজ্যোতির লাশ বিলের পাড়ে তুলে আনার নির্দেশ দেয়। তাৎক্ষনিক খানসেনারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এ সংবাদ জানায়। ঐদিন রাতে স্থানীয় ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় জগৎজ্যোতির লাশ। চিরনিদ্রায় শায়িত জ্যোতিকে দেখেও নিজেদের ক্রোধ সংবরণ করতে পারে না হানাদাররা। প্রতিশোধ নিতে তাঁর নির্জিব দেহের ওপর চালায় পৈশাচিক পন্থায় নির্যাতন। পরদিন তাঁর লাশ নৌপথে আজমিরীগঞ্জের উদ্দেশ্যে নিয়ে রওয়ানা হয় রাজাকাররা। বিভিন্ন ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে জ্যোতির প্রাণহীন দেহ দেখিয়ে নিজেদের উন্মত্ততা জাহির করে। জনসমক্ষে তারা থুথু ফেলে জ্যোতির স্পন্দনহীন শরীরে। এই নরপশুরদল ঘৃণা প্রকাশের যত পন্থা আছে তার সবই করে একটি প্রাণহীন দেহের ওপরে।

জীতেন্দ্র দাসের বাড়ির ঘাটে এদিন দুপুরে নৌকা ভেড়ায় তারা। রাজাকাররা প্রতিশোধ নিতে আগুন ধরিয়ে দেয় জ্যোতিদের নড়বড়ে ঘরে। আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে; গ্রাস করে জগৎজ্যোতির জন্মভিটে। নদীর ঘাটে যাবার পর তীরে জ্যোতির ঘুমন্ত দেহ দেখে নির্বাক হয়ে যান পিতা-মাতা। তাদেরকে ওখানে রেখেই রাজাকাররা জ্যোতির লাশ নৌকায় তুলে।

রাজাকাররা আজমিরীগঞ্জ বাজারে নিয়ে যায় জ্যোতির নিথর দেহ। মুক্তিযোদ্ধার পরিণতি দেখানোর জন্য জ্যোতির নিশ্চল দেহকে রাজাকারদল বেঁধে রাখে একটি ইলেকট্রিকের খুঁটির সাথে। এরপর তাঁর দেহের ওপর চালাতে থাকে নির্যাতন। ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচাতে থাকে জ্যোতির শরীর। ক্ষতবিক্ষত করেও তাদের সাধ মিটে না। সেখানে লাশ রাখা হয় আরও একদিন। এরপর জগৎজ্যোতির লাশ পাকদের এ দেশীয় দোসররা ভাসিয়ে দেয় ভেড়ামোহনা নদীর জলে। ভাসতে ভাসতে নদীর বুকে একসময় হারিয়ে যায় জ্যোতির দেহ। জ্যোতির নির্জিব দেহের শেষ ঠিকানা কোথায় তা কেউ বলতে পারে না। নদীর স্্েরাতধারা বয়ে চলে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ নিয়ে। এখনও বয়ে চলেছে নদীটি। কিন্তু কেউ জানে না জ্যোতি নদীর কোথায় ঘুমিয়ে আছেন!

জ্যোতির আত্মত্যাগের মূল্যায়ন করতে গিয়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল শহীদ জগৎজ্যোতিকে সর্বোচ্চ মরণোত্তর খেতাবে ভূষিত করা হবে। এই ঘোষণাটি ছিল মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে খেতাব প্রদানের প্রথম ঘোষণা। সরকারের এই ঘোষণাটি ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। যা শুনে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। সাধুবাদ জানিয়েছিলেন সরকারকে।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে- সেই আত্মবলিদানকারী মুক্তিযোদ্ধার প্রতি পরবর্তী সরকার শুধু বৈরীতাই করেনি- তাঁকে প্রদান করা হয়নি সেই গৌরবোজ্জ্বল খেতাবও। তবে জগৎজ্যোতিকে ’৭২ সালে প্রবর্তিত ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। কিন্তু পুরস্কার বাস্তবে প্রদান করা হয় দু’যুগ পর।

জ্যোতিকে পদক প্রদান না করার বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি মুক্তিযোদ্ধারা। তারা আজও জানেন না কেন জগৎজ্যোতিকে ঘোষিত খেতাবে ভূষিত করা হলো না। বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক লেখায় এ প্রসঙ্গটি ওঠে এসেছে। এখনও তা অব্যাহত আছে। এ নিয়ে একটি অভিযোগ রয়েছে নিয়মিত বাহিনীর বাইরের মুক্তিযোদ্ধাদের। তাদের অভিযোগ ‘বীরশ্রেষ্ঠ’-খেতাবটি সরাসরি সশস্ত্র বাহিনীর বাইরে কোন মুক্তিযোদ্ধাকে দেওয়া হয়নি ইচ্ছে করেই। সে কারনে ঘোষণা সত্ত্বেও জ্যোতিকে সে পদক দেওয়া হয়নি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে। অনেক মুক্তিযোদ্ধাই এ জন্য ক্ষুব্ধ। কেবলমাত্র ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাব ছাড়া অন্য সকল খেতাবই দেওয়া হয়েছে নিয়মিত বাহিনীর বাইরের মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযুদ্ধ সবকিছুর ঊর্ধ্বে। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে সংকীর্ণতার অবকাশ নেই। তাই অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক জগৎজ্যোতিকে প্রথম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সর্বোচ্চ পদক প্রদানের ঘোষণা এখনও বাস্তবায়ন করা যেতে পারে বলে অনেকের ধারণা। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা বার বার জন্মগ্রহণ করে না।