
কবি সাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার একটা বিড়ম্বনা আছে। তাদের অনেকেই সোজাসাপ্টা উত্তর দেন না নির্দিষ্ট প্রশ্নের। ভাবাবেগ এবং পাণ্ডিত্য মিশ্রিত উত্তর দেন যা প্রশ্নকর্তার জানার আগ্রহের জন্য যথেষ্ট নয়। নির্দিষ্ট উত্তর আদায় করতে ফের এ পথে বাক্যবিনিময় করলে সহজাত প্রবৃত্তি অনুযায়ী উত্তরদাতার বিরাগভাজন হওয়ার উপক্রম সৃষ্টি হয়। এটা এক টাইপের ঝামেলা। তবে সব কবি সাহিত্যিক ঝামেলা করেন না। অনেকই আছেন যারা ভনিতা করেন না। সপ্রণোদিত হয়ে বলেন- হৃদয়ের কথা, প্রাত্যহিকতার কথা। ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতিও রোমন্থন করেন অবলীলায়। তাদের একজন মোহাম্মদ রফিক। দেশের প্রথম সারির কবি হলেও নিজের মধ্যে কোন অহমিকা নেই তাঁর। সাদামাটা চলাফেরা করতেই পছন্দ করেন তিনি। আড়ম্বরতার বালাই নেই। তার সাথে সম্প্রতি আলাপচারিতা হয় সিলেটে। বিভিন্ন প্রসঙ্গ উঠে আসে কথপোকথনে। পাঠকদের জন্য তা ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হলো।
নবীনদের প্রসঙ্গ
প্রথমতো লেখালেখি নিয়ে বাণী দেওয়া ঠিক না। আমি কারো বাণী শুনিনি, কাউকে বাণী দিতেও চাই না। আমি যেভাবে লিখি, অন্যজন সেভাবে লিখবে সেটা ঠিক না। প্রত্যেককে নিজের দিকে তাকিয়ে একাগ্রচিত্তে তন্ময়তার সাথে লেখা উচিত।
বাইরে খুঁড়ে অন্য কাজ হয়। কবিতা লিখতে গেলে বাইরে খুঁড়ার জায়গা নেই। মনের মধ্যে খুঁড়াখুড়ি করে লিখতে হয়।
কবিতা এখন জাগরিত করে না?
সত্যিই কি তাই? সব সময়যে জাগরিত করে সেটা ঠিক না, কখনও কখনও করে, বিশেষ সময় এবং পরিবেশে। উদাহরণ হিসেবে আমরা পঞ্চাশ ও ষাটের দশক এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়টাকে উল্লে¬খ করতে পারি। শুধু কি তাই; প্রকৃতিও জাগরিত করে, জাগরিত হওয়ায়।
এখন সেই অবস্থাটাও পাল্টে গেছে। তবে বর্তমানে যে কবিতা আলোড়িত করে না সর্বাংশে সেটা ঠিক নয়। অনেক ক্ষেত্রেই গভীরে আলোড়িত করে। প্রথম দিকে তা টের পাওয়া যায় না, ধীরে ধীরে পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা কী জাগরিত করে না? কষ্টের দুঃখের বেদনায় মুহূর্তে তাঁর কবিতা পড়ে আমরা জাগরিত হই।
নিজের প্রসঙ্গে
আমি কবি কি না জানি না, লিখতে খুব পছন্দ করি। কবিতা আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। যখনই লিখতে বসি তখনই দেখি তা কবিতার মতো হয়ে যায়। সব ধরনের লেখা পড়তে ভালো লাগে। উপন্যাস ছোট-গল্প সব কিছুই আমাকে আকৃষ্ট করে। গল্প ও প্রবন্ধও লিখি। তবে করব বলে কিছুই করি না।
শৈশব থেকে মানুষ কখনও বের হতে পারে না। যখন বের হয় তখন তাকে মৃত্যুর ভেতর দিয়ে বের হতে হয়। শৈশবের তাড়নাই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। কোন জিনিসকে হারিয়ে ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় রত থাকেন কবিরা। বিশেষ করে কবিতায় ফিরে দেখার বিষয়টি বার বার ফিরে আসে। কবিতার সাথে কোন কিছু হারিয়ে ফেলার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টাকেই কবিরা তুলে ধরার চেষ্টা করেন কবিতায়।
আমার জন্ম ১৯৪৬ সালে। হঠাৎ করেই চলে আসে ১৯৪৭। ছেঁড়া-ভাঙা বাড়ি, উচ্ছন্নে যাওয়া মানুষের রান্না ঘর, ধ্বংসাবশেষের ভেতর দিয়ে আমার বেড়ে উঠা। সেটা ছিল মন্বন্তরের বছর। তার আঁচ না পেলেও ৪৭-এর বেদনা আমাকে ছাড়েনি। একাত্তরে ভেবেছিলাম এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাব। আমরা পেয়েছি কী? এবং বার বার অভিশাপ আমাদেরকে তাড়া করে ফিরছে। মনে হয় ইতিহাসবিচ্ছিন্ন, জনবিচ্ছিন্ন লোক সমাজে পরিণত হচ্ছি আমরা।
আগামীর প্রত্যাশা
মানুষ তার অতীতকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করবে। মাটি চাপা পড়ে যাওয়া ইতিহাসকে খুঁড়ে খুঁড়ে বের করতে হবে। প্রকৃত ইতিহাসের ভেতরই রয়েছে বাঙালি সত্তার উন্মোচন।
বিষয়টি খুব কঠিন কাজ। প্রায় সব সূত্র হারিয়ে গেছে। এজন্য সমস্ত বাঙালিকে আত্মস্থ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে, অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপটে।
কবিতা নিয়ে
কবিতা নিয়ে কথা বলা কঠিন। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে আমি না চাইলেও আমার কবিতার বিষয় উঠে আসবে। তবে আমি মনে করি এতদিন যে কাব্য চর্চা করেছি, হচ্ছে- তা ব্যক্তি মানুষের আত্মপ্রকাশের শখ। ব্যক্তি মানুষটি মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত- তার চোখ দিয়েই প্রকৃতি মানুষ সবকিছু দেখার চেষ্টা করে কবিতায়।
এর বাইরেও বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে। এরা নিপীড়িত নির্যাতিত বঞ্চিত। তাদের চোখ দিয়ে পৃথিবীকে দেখার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের কবিতায় প্রকৃতি হচ্ছে মানুষের আশ্রয়। আমরা যখন ক্লান্ত বা বেদনাবিদ্ধ হই তখন প্রকৃতির কাছেই আশ্রয় নেই। যাদের বসবাসের জায়গা আছে, পেটে ভাত আছে তাদের কাছে প্রকৃতি আশীর্বাদ।
তবে দক্ষিণ বাঙলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাতাস শুরু হলে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। চাঁদ দেখলে তাদের মনে সংশয় সৃষ্টি হয় ঘরে সাপ ঢোকার। প্রকৃতির অভিশাপের সাথে যাদের জীবন জড়িত কবিকে সেই জায়গায় খোঁজ নিতে হবে। তাকে চেষ্টা চালাতে হবে নতুন কিছু সৃষ্টির। মাইকেলের কবিতা প্রথম প্রথম আজকের মত মানুষ গ্রহণ করেনি। কারন তারা তখন এধরনের কবিতায় অভ্যস্ত ছিলনা। নতুন কিছু আসলে পাঠকের পক্ষে তা গ্রহণ করা কঠিন। মানুষের সামনে আসার জন্য সময় লাগে। প্রকৃত কবিকে সময় দিতেই হয়। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ এমনকি শেক্সপিয়ারকেও সময় দিতে হয়েছে। তাছাড়াও কাব্য ভাষা বদলেরও প্রয়োজন। তার জন্য জনরুচি তৈরী হওয়াটাও মুখ্য।
তবে এজন্য কোন একজনকে সাধনার ক্ষেত্র তৈরী করতে হবে। চিরাচরিত জায়গা ছেড়ে অন্যত্র সাঁতরাবার চেষ্টা করতে হবে। কাঙ্খিত সেই দিনের দেখা পাওয়া দীর্ঘ হতে পারে আবার নাও হতে পারে।
প্রসঙ্গ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
আজঅবদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেন দ্রুত হয় সেটাই কাম্য। মুক্তিযুদ্ধের পর পরই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে না পারাটা আমাদের ব্যর্থতা। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই আমরা যে বিভাজন সৃষ্টি করেছি তা থেকে বের হতে আমাদেরকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। আমরা যে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেছিলাম¬-তা এখনও পাইনি।
সাপ্তাহিক ২০০০ এ প্রকাশিত