আনোয়ার হোসেন: আলোকচিত্রের বাউল

‘৩০ মার্চ ১৯৭১। পাক হানাদারদের নিধনযজ্ঞে রক্তাক্ত ঢাকা শহর। বুড়িগঙ্গার স্রোতধারায়ও মিশে আছে রক্ত। নগরীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা মৃতদেহের ছবি ও সেই সময়টাকে ধারন করার জন্য ক্যামেরা নিয়ে শাখারী বাজারে যাই। মৃত মানুষের শরীরের ওপ্ররে কাকের বিচরনের কয়েকটি দৃশ্য তুলি। জমাট বাধা রক্ত দেখে মনটা ক্যামন করে উঠে; আরেকটু এগিয়ে যাই। শাখারী বাজার মোড়ে একটি টেবিলের নীচে পড়ে থাকা কয়েকটি লাশের ছবি তোলার জন্য প্রস্তুত হওয়ার মুহুর্তে টের পাই কে যেনো পেছন থেকে আমার দুটি হাত শক্ত করে ধরে ফেলেছে। হাত দুটি ছাড়িয়ে নিতে যাওয়ার মুহুর্তে আরও দুটি হাতের অস্তিত্ব উপলব্ধি করি। পেছন ফিরে তাকাতেই আমাকে ঝাপটে ধরে দুজন। বুঝতে বাকী থাকেনা ওরা হানাদারদের পদলেহনকারী। কথা শুনে বুঝতে পারি এরা বিহারী স্পাই। আটকের উদ্দেশ্য, ক্যামেরাসমেত আমাকে পাক আর্মির হাতে তুলে দেওয়া। কিন্তু আমার হাতের ক্যামেরা ও ঘড়ির প্রতি এদের একজনের লোলপ দৃষ্টি পড়ে। সে এগুলো লুট করতে চায়। অন্যজনের ইচ্ছে ক্যমেরাসহ আমাকে পাক আর্মির হাতে তুলে দেওয়া। এনিয়ে তাদের দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। তারা কথা বলছিলো বিহারী ভাষায়। থোরা সুচনে!-কথাটা আমার কানে আজও ভাসে। এই পরিস্থিতিতে একজন আমাকে টেনে ডানদিকের একটি বিল্ডিংয়ের পাশে নিয়ে যায়। তখনও তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। তারা একমত হতে পারছিলো না, কি করবে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক নিঃশ্বাসে ঝাকুনি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিই। এরপর প্রানপন দৌড় শুরু করি। তারাও পিছু নেয়। কয়েশ’গজ এসে পিছু ছাড়ে। ততক্ষনে আমি নিরাপদ দুরত্বে পাড়ি জমাই। স্বাভাবিক হওয়ার পর উপলব্ধি করি আমার হাতের ক্যামেরাটি নেই।’- বলছিলেন আনোয়ার হোসেন। কথাগুলো গল্পের মতো শুনালেও ’৭১-এ এমন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো প্রখ্যাত এই আলোকচিত্রীকে। দালালরা পাক সেনা অবদি তাকে নিয়ে যেতে পারলে হয়তো করুণ পরিনতি বরণ করতে হতো তাকে। তারপরও ছবি তোলা থেকে বিরত থাকেন নি। জীবনের গতিপথে অবিচল থাকেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিদের চালানো ধ্বংসযজ্ঞের অনেক চিত্র ধারণ করেন দুঃসাহসিকতার সাথে। ধড়া পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু-এমন পরিস্থিতিতেও পেশাদারিত্বে তিনি ছিলেন অবিচল। দেশাত্ববোধ ছিলো তাঁর অস্থি-মজ্জায়। প্রখ্যাত এই শিল্পী সম্প্রতি আলোকচিত্রে নন্দন তত্বের উপর একটি কর্মশালায় অংশ নিতে সিলেট এসেছিলেন। সেই সুবাদে আনোয়ার হোসেনের সাথে সাক্ষাৎ হয়।  তাঁর ছবি তোলা, ভালোলাগা, আলোকচিত্র নিয়ে চিন্তা-ভাবনাসহ প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে খেলামেলা কথা বলেন তিনি। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।

২০০০: ছবি তুলতে গিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। এছাড়া কি অন্য কোনো ঘটনা আছে যা আপনাকে আলোড়িত করে?
আনোয়ার হোসেন: আবহমান বাংলার রূপ বৈচিত্রের অসংখ্য ছবি তুলেছি। বিশেষ করে নৌকা ও নদীর ছবি তুলেছি অফুরান। তবে ইছামতি নদীর ছবি তুলতে গিয়ে যে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিলাম তা আজও ভুলতে পারিনি। অনেকদিন আগের আগের কথা। আমাদের গ্রামের বাড়ির বাড়ির পাশ দিয়ে ইছামতি নদী বয়ে গেছে। একদিন বিকেলে সূর্য অস্ত যাওয়ার প্রাক্কালে আমি ক্যামেরা নিয়ে নদীর ঘাটে উপস্থিত হই। ইচ্ছে ছবি তোলা। এমন সময় কয়েকজন তরুনী কলসী কাকে নিয়ে নদীর ঘাটে জল নিতে আসে। তারা পানিতে ঢেউ তুলে, কলসীতে জল ভরে। আমি কল্পনা করি, যদি দুচারটি পাখি উড়ে যেতো তাহলে ওপারে কাশবনসহ একটি ছবি ওঠাতে পারলে তা হতো অসাধারন। কোনো পাখি উড়েনি। ছবি তুলতে শুরু করি। আমি যখন ছবি তুলছিলাম তখন নদীর ঘাটে গোসল করছিলেন একজন বৃদ্ধ। গোসল সেড়ে তিনি আমার দিকে এগিয়ে আসেন। তখনকার ক্যামেরায় ছবি তুলতে শব্দ হতো। তিনি আমাকে বলেন-‘তুমি যে ৭/৮টা ছবি তুলেছ, একটাও হয়নি।’ আমি চমকে উঠি। মনে মনে ভাবি একি বলছেন তিনি। নিজেই এর ব্যাখ্যা দেন। নদী থেকে তখন সেচযন্ত্র দিয়ে পানি তুলছিলো কয়েকজন শ্রমিক। গোধুলী বেলায় নদী থেকে তুলে ওপরে ফেলা পানিকে দেখতে অনেকটাই গলা সোনার (স্বর্ন) মতো লাগছিলো। তিনি বলেন, ‘তুমি তা ক্যামেরা বন্দি পারনি।’ আমি বললাম, আপনি নিশ্চিত হলেন কি করে। উত্তর দেন, ‘পানি পড়ার সাথে তোমার ক্যামারার একটা শব্দও মিলেনি।’ আমি হতবাক হয়ে যাই। যতবারই নৌকা বা নদীর কাছাকাছি হই, ততবারই মনে পড়ে কথাটি। 

২০০০: কোন ধরনের ছবি তুলতে ভালো লাগে?
আনোয়ার হোসেন: মানুষের ছবি তুলতে ভালো লাগে। খালি চোখে জীবনের সুখ দুঃখের যে চিত্র উঠে আসে, তাকে ক্যামেরা বন্দি করার মাঝেই সুখ খুজে পাই। চিরন্তন কে চিরন্তন রাখার প্রয়াস চালাই ছবির ক্যানভাসে।

২০০০: একাত্তরের অগ্নিগর্ভ সময়ে তোলা ছবির সংখ্যা কত?
আনোয়ার হোসেন: শতাধিক হবে। বেশ কিছু ছবি হারিয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মিছিলের ছবি তুলেছি। আন্দোলনরত জনতার ছবিও তুলেছি। পাকিদের ধ্বংসযজ্ঞ এবং স্বাধীনতার বেদীমূলে আত্মোৎর্গকারীদেরকে ছবিও ক্যামেরাবন্দি করেছি। একাত্তরকে ক্যামেরা দিয়ে যতটুকু ধারন করা যায় সেই প্রচেষ্টা আমি চালিয়েছি নিরন্তর।

ছবি তুলে সেগুলোকে বুয়েটের ফ্যকালিটির ডাক রুমে রেখে দিতাম সিলগালা করে। পাকিস্তানীদের হাতে পড়লে যাতে এগুলোর মধ্যে ক্যামেরার রিল আছে তা বুঝতে না পাড়ে। সাংক্ষেতিক কিছু অক্ষরে এখানে ছবি আছে তাও লিখে রাখতাম। মৃত্যুর আশংকা থেকে এমনটি করেছি। কখন কি হয় এ নিয়ে সব সময়ই শংকিত থাকতে হতো। সে সময় কিছু ছবির নেগেটিভ ভারতে পাঠাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেগুলো যার কাছে পাঠাতে চেয়েছিলাম তার হাতে পৌছায় নি। যে কারনে মহামূল্যবান সেই রিলগুলো হারিয়ে গেছে। এই নেগেটিভগুলো হারানোর কষ্ট আমি আজও ভুলতে পারিনি।     

২০০০:এই পথ বেছে নিলেন কেন?
আনোয়ার হোসেন: ছোট বেলায় আমি ভালো ছবি আকতাম। শৈশব থেকেই পেইন্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। ….সালে মেট্রিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে স্ট্যান্ড করি। বাবা মোহাম্মদ হোসেন ছিলেন স্টার ফিল্মস ডিস্টিবিউটারের ম্যানেজার। পারিবারিকভাবে আর্থিক সচ্ছলতা তেমন একটা ভালো ছিলো না। বাবা চেয়েছিলেন আমি ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হই। এ কারনে আর্ট কলেজে ভর্তি হতে পারিনি। যার ফলে ভেতর বেদনা থেকে যায়। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর স্কলারশিপের ৩০ টাকা দিয়ে এক বন্ধুর কাছ থেকে একটি পুরনো বক্স ক্যামেরা ক্রয় করি। প্রথমদিনেই এই ক্যামেরার প্রেমে পড়ে যাই। এদিন ৮টি ছবি তুলি। প্রথমদিনের তোলা একটি ছবি পরবর্তী পর্যায়ে ইষ্ট পাকিস্তানের জাতীয় পুরস্কার লাভ করে।

বাবা-মায়ের স্বপ্নের প্রতিফলন ঘটাতে গিয়ে বুয়েটে ভর্তি হই। আমি তখন বুয়েটের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ছবি আঁকতে না পাড়ার বেদনা তখনও আমাকে তাড়িত করে। অনুভব করি ছবি আকতে না পারার বেদনা ছবি তোলায় রূপান্তরিত হয়েছে। সুযোগের অপেক্ষায় থাকি। একসময় সেই সুযোগ পেয়ে যাই। ভারতের পোনা ফিল্ম ইন্ড্রাষ্টিতে স্কলারশিপ লাভ করে নিজেকে শানিত করে তুলি।

২০০০: কর্মজীবন সম্পর্কে বলুন।
আনোয়ার হোসেন: চলচ্চিত্র গ্রাহক হিসেবে আমার যাত্রা শুরু সূর্যদিঘল বাড়ি-চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এরপর এমিলের গোয়েন্দাবাহিনীতে কাজ করি। মোট ১৫ টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং ৩০ টি প্রামান্য চিত্র ধারন করেছি ক্যামেরায়। তবে নিজ দেশে কাজ করে যেটা উপলব্ধি করেছি সেটা হচ্ছে পেশা হিসেবে চলচ্চিত্র গ্রাহক স্বীকৃতি পেলেও পেশাদারিত্ব আসেনি। কৌশলে এই পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ঠকানো হচ্ছে। যা খুবই দুঃখজনক। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এমন পরিস্থিতি চোখে পড়েনা। আমাদের ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রিতে ঠকানোর প্রবনতা প্রবল।  

২০০০: অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কার কাছ থেকে ?
আনোয়ার হোসেন: চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহক সাধন রায়ের অবদান কোনোদিনও ভুলতে পারবোনা। তাঁর সহযোগিতা না পেলে মুক্তিযুদ্ধের ছবিসহ অনেক ছবিই আমার তুলা হতো না। তিনি আমাকে সব ধরনের সহায়তা করেছেন। মনে পড়ে যখন আমার ভালো কোনো ক্যামেরা ছিলো না তখন তিনি তৎকালীন সময়ের একটি দামী ইয়াসিকা ক্যমেরা আমাকে ধার দিয়েছিলেন ছবি তোলার জন্য। আমাকে ভীষন স্নেহ করতেন তিনি। প্রতি শুক্রবার আমি তাঁর বাসায় যেতাম।

তিনি আলোচিত ‘রিভার’ ছবির সহকারী চিত্রগ্রাহক ছিলেন। ছিলেন ভারতীয়। কিন্তু রিভার করতে এসে আর ফিরে যান নি। তার সহযোগিতা না পেলে আমি তৎকালীন সময়ে এতো ছবি তুলতে পারতাম না।

চলচ্চিত্রের চিত্র গ্রহনের জন্য যে ফিল্ম ব্যবহার করা হতো তা ছিলো প্রায় ৪শ ফিটের। চিত্রগ্রহনের পর অনেক সময় ৩০/৩৫ ফিট ফিল্ম অতিরিক্ত ফিল্ম উদ্বৃত্ত থেকে যেতো। এগুলো তিনি আমাকে দিয়ে দিতেন। সেগুলো দিয়ে আমি ছবি তুলতাম।

২০০০: কি ভালোলাগে?
আনোয়ার হোসেন: অবসরে গান শুনি। বাশির সুর আমাকে মুহিত করে। গান অথবা বাশি না শুনে ঘুমাতে পারি না। তিব্বতের আধ্যাত্মিক স্রোতগান আমার ভালো লাগে। আর নিলুফার ইয়াসমিনের ওরা চাহিতে জানেনা দয়াময় গানটি বার বার শুনি ভালো লাগা থেকে ।

২০০০: আলোকচিত্রে কি কোন পরিবর্তন এসেছে?
আনোয়ার হোসেন: আলোকচিত্রের ভাষা বদলে গেছে। বাংলাদেশের ভাষাও অনুরূপভাবে বদলেছে। ট্রেডিশনাল সোসাইটিতে অতি আধুনিকতার সংমিশ্রন ঘটেছে। চিরন্তন সংস্কৃতির সাথে অত্যাধুনিক যুগের সহাবস্থানের প্রভাব আলোকচিত্রেও বিদ্যমান।  

২০০০: প্রবাসে চলে গেলেন কেন?
আনোয়ার হোসেন: স্ত্রী, দাদি, বাবা ও বোনের মৃত্যু আমার জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলে। আমার কাছে এটা ছিলো অভিশপ্ত সময়। দেশে থাকলে হয়তো মারাই যেতাম। এই পরিস্থিতিতে ফ্রান্সে চলে যাই। সেখানে বর্তমানে সপরিবারে বসবাস করছি। আমার বড় ছেলে আকাশ (১৬) ও ছোট ছেলে মেঘদূত (৯) সেখানে লেখাপড়া করছে। স্ত্রী তাদের ভরন-পোষন দায়িত্ব কাধে তুলে নেওয়ায় নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করছি।

২০০০: দেশের তরুন আলোকচিত্রীদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন ।
আনোয়ার হোসেন: ওদের মধ্যে বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সেই সম্ভাবনাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে। লক্ষ্য স্থির রেখে তাদেররকে এগিয়ে যেতে হবে। ছবি তুলতে হবে প্রানের টানে, অনুভুতির টানে। কোন ছবি ভালো বিক্রি হবে, সুনাম হবে কোন ছবি তুললে, পুরস্কার পাওয়া যাবে কোন ছবির বদৌলতে-এমন ধ্যান ধারণা পোষন করলে চলবে না। এতে স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে যায়। তাই প্রথমেই প্রাপ্তির পথে পা বাড়ানো ঠিক হবেনা। লোভ-লালসা পরিহার করে এগিয়ে যেতে পারলে ভালো আলোকচিত্রী হওয়া সম্ভব। তরুনেরাই আলোকচিত্রের জগতে নতুন পৃথিবী তৈরী করবে, এমন বিশ্বাস আমার রয়েছে।

২০০০: আলোকচিত্রে আদর্শ মনে করেন কাদের ?
আনোয়ার হোসেন: বাংলাদেশে নাইবুদ্দিন আহমদ ও আমানুল হক। অমেরিকার ইউজিং স্মিথ, ফ্রান্সের ওরি কার্তিয়ে ব্রেসো, ব্রাজিলের সেবাস্তিয় মেলাগাদো, ভারতের রঘু রায়।
অনুপ্রেরণা পেয়েছি আলোকচিত্রী গোলাম কাশেম ড্যাডি ও চট্টগ্রামের মৃনাল সরকারের কাছ থেকে।

২০০০: শেষ জীবনে কি করতে চান?
আনোয়ার হোসেন: দেশে শান্তি নিকেতনের আদলে একটি আলোকচিত্র শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চাই। সেখানে চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহক তৈরীর বিষয়টিও অন্তভুক্ত থাকবে। প্রকৃতির মাঝে আলোকচিত্র এবং চলচ্চিত্র শিল্পের কলেজ। ইট পাথরের ইমারতের মাঝে শিল্পচর্চা হয়না। শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে হয়। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য যথোপযুক্ত স্থান গাজিপুর এলাকা, অথবা আমার গ্রাম দোহার থানা, চট্টগ্রামের পাহাড়ী কিংবা সিলেটের আশেপাশে চা-বাগান এলাকা। তবে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান করতে গেলে কোটি টাকার প্রয়োজন। আমার কাছে কানাকড়িও নেই।

তিনি তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন। পাশাপাশি তিনি এও বলেছেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা কওে যদি কেউ তাকে যোগদান করতে বলে তাতে তিনি আপত্তি করবেন না। প্রয়োজনে বিনা বেতনে কাজ করতেও তিনি আগ্রহী। তবে তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। 

তিনি জানান, দেশের চারটি ইউনিভার্সিটিতে ফটোগ্রাফির ক্লাস নেওয়ার জন্য আমাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আমি এতে সম্মত হয়নি। ইটপাথরের ইমারতের মাঝে আর যাই হয় আমার ভালো লাগেনা। বদ্ধ কামরায় আর যাই হয় সত্যিকারের শিল্প হয় না। অন্ধকার ঘর, অডিটরিয়ামে ডিজিটাল প্রজেক্টর দিয়ে প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়া যায় না, আন্তরিক কথা-বার্তা বলা যায় না।

পাচ বছর ধরে আমি মনের মাঝে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন লালন করছি। কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যে টাকার প্রয়োজন সেটা আমার নেই। অনেকেই প্রতিশ্রুত দিয়েছেন, পরবর্তীতে তারা সেটা ভুলে গেছেন। আসলে টাকাটা বড় জটিল জিনিস। আর শিল্প-সাহিত্যে টাকা বিনিয়োগকারীর সংখ্যাও কম। কারন পুজিপতির দৃষ্টিতে এতে লাভের চেয়ে লোকশান বেশি।

একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে চিত্রগ্রহনের উপর ডিগ্রি অর্জনের জন্য ভর্তি হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিজনের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা নেওয়া হয়। পচিশজন ছাত্রের টাকায় একটি চলচ্চিত্রের কলেজ করা যায়। আমি আশাবাদি একদিন না একদিন সেই কাঙ্খিত দিন আসবেই।

২০০০: কোনো অতৃপ্তি বা অনুশোচনা আছে জীবনে?
আনোয়ার হোসেন: আলোকচিত্রে আমার কোনো অতৃপ্তি নেই। অনেকের মতো এটা করতে পারিনি ওটা করতে পারিনি বলে আমার কোনো অনুশোচনা হয়না। উল্টো যে বিষয়টি ইদানিংকালে আমাকে ব্যথাতুর করে তা হচ্ছে-জীবনের সুন্দর সময়গুলো কাজের পেছনে ব্যয় করেছি। আমার পরিবারকে আমার মাকে সময় দিতে পারিনি। তাদের আরও অধিক সময় দেওয়ার প্রয়োজন ছিলো। মাঝে মাঝে মনে হয়, সূর্য দিঘল বাড়ি ও এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী-পরবর্তী কাজের পেছনে যে শ্রম দিয়েছি, সেই সময়গুলো আমি অপচয় করেছি। বিদেশে কাজ করলে শ্রমের মূল্য পেতাম। দেশে পাইনি। আমাদের দেশে ঠকানোর প্রবনতাটা প্রবল।

২০০০: নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন ।
আনোয়ার হোসেন: আমি বাউল। পনের বছর ধরে ভবঘুরে। আজ এখানে, কাল ওখানে। এভাবেই কেটে যাচ্ছে দিন। ব্যাংকে কোনো টাকা নেই। নিজের এককাটা জমিও নেই, যেখানে আমাকে কবর দেওয়া যেতে পারে। আমার যা কিছু সবই বন্ধু-বান্ধবের দেওয়া ভালোবাসার উপহার। এ নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ বা আপসোসও নেই।

এক নজরে আনোয়ার হোসেন
বাংলাদেশের আলোচিত্র জগতের এক উজ্জল নক্ষত্রের নাম আনোয়ার হোসেন। ১৯৬৭ সাল থেকে আলোকচিত্রের অভিযাত্রী এই স্থির চিত্র শিল্পী এখন সপরিবারে বসবাস করছেন ফ্রান্সে। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে তার ভালোবাসার কমতি নেই। সুযোগ পেলেই ছুটে আসেন দেশের মাটি ও মানুষের কাছে। নিজের ভালো লাগা, সুখ-দুঃখ সবই আবর্তিত হয় দেশকে ঘিরে।  চলেন একেবারে সাদা সিদে। কথা বলেন সোজা সাপ্টা। অকপটে বলেন সত্য কথা।
আনোয়ার হোসেন ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ফটোগ্রাফী শুরু করেন ১৯৬৭ সালে। প্রথম ছবি প্রকাশিত হয় এ সালেই। এ পর্যন্ত আলোকচিত্রে প্রতিভার সাক্ষর হিসেবে তিনি ৬০টি আন্তর্জাতিক এ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছেন। ১৯৭৮ সালে সিনেমা ফটোগ্রাফীতে জাতীয় ও সিনে সাংবাদিকতা পদক লাভ করেন তিনি।
১৯৮০ সালে সাইপ্রাসে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ ফটোগ্রাফী প্রদর্শনীতে একক বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৭ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ ইন্সিটিউটের ইমেজ সেমিনারের প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তৃতা দেন। ১৯৯৯ ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচিত্র প্রদর্শনীতে প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ভারত, নেদারল্যান্ড, বোস্টন, নিউইয়র্ক, ফ্রান্স, আমেরিকা, ইতালি, প্যারিসহ বিখ্যাত শহর ও দেশে তাঁর চিত্রপ্রদর্শনী হয়েছে।
আনোয়ার হোসেন ল্যান্ড এন্ড পিপল এন্ড লাইফ এন্ড কালচার (মাটি, মানুষ, জীবন ও সংস্কৃতি) ও জার্নি থ্রো বাংলাদেশ (বাংলাদেশ ভ্রমণ) ঢাকা পেট্টিয়েট এন্ড ওইমেন (ঢাকাপ্রেমী ও নারী) প্রভৃতি আলোকচিত্র গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। কাজ করেছেন জাতি সংঘ, ইউনিসেফ ও ইউএসএইড-এর জন্য।
আনোয়ার হোসেনের আলোকচিত্রের উল্লেখযোগ্য অংশ প্যারিসের ইউরিপিয়ান মিউজিয়াম অব ফটোগ্রাফি ও ঢাকা শিল্পকলা একাডেমীতে সংরক্ষিত রয়েছে। ১৯৯৩ সাল থেকে আনোয়ার হোসেন স্বপরিবারে ফ্রান্সে বসবাস করছেন।

সাপ্তাহিক ২০০০ প্রকাশিত