
পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে যে ক’জন সংঙ্গীতজ্ঞ আমাদের সঙ্গিত জগতের প্রায় প্রতিটি শাখায় বিচরণ করে বাংলা গানের সুর ও ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন প্রাণেশ দাস।
‘সোহাগ চাঁদ বদনী ধ্বনী নাচতো দেখি, বালা নাচাতো দেখি’ অথবা ‘তোমরা দেখো গো আসিয়া কমলায় নৃত্য করইন থমকিয়া থমকিয়া’-জনপ্রিয় এ গান দুটির সফল সুর সংযোজন তাঁরই অমর কৃর্তী। এদুটি গান শুনেন নি এমন বাঙালি সঙ্গিতানুরাগি হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এই গানগুলোর সুরশ্রষ্ঠা প্রানেশ দাস যেন আজ হারিয়ে যেতে বসেছেন বিস্মৃতির অতলে।
প্রানেশ দাস ১৯১৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিলেট শহরের মীজাজাঙ্গালস্থ ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা প্রসন্ন দাস ছিলেন স্কুল শিক্ষক। মাতা নিতম্বিনী দাস ছিলেন গৃহিনী। একমাত্র পুত্র হলেও পিতা-মাতার প্রেরণায়ই সঙ্গিতসাধনার পথে অগ্রসর হতে থাকেন তিনি।
প্রানেশ দাস যে সময়টাতে জন্মগ্রহন করেন সেই সময়টাতে ভারতবর্ষ পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি ছিল। তবে, উপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার নাগপাশ প্রানেশ দাসের সঙ্গিত প্রতিভাকে বৃত্তাবদ্ধ করে রাখতে পারেনি। তিনি মুক্ত বিহঙ্গের মতোই বিচরণ করেন সঙ্গিতের অসীম আকাশে। বিস্ময় জাগানিয়া প্রতিভার অধিকারী প্রানেশ দাস সুর তরঙ্গে দূলায়িত করতে থাকেন সঙ্গিত জগৎকে। তাঁর প্রাণস্পর্শী গানের কথা ও সুর সহজেই ছড়িয়ে পড়ে সাধারণের মাঝে। মানুষের মনে ঠাই করে নেয় তা।
মাত্র ৮ বছর বয়সে সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয় তাঁর। ওস্তাদ সঙ্গীতাচার্য কুমুদরঞ্জন গোস্বামীর কাছ থেকে তালিম নিয়ে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত থেকে শুরু করে আধুনিক গান- সঙ্গীতের প্রায় প্রতিটি শাখায় বিচরণ করেন তিনি। প্রানেশ দাস একাধারে ছিলেন সুরকার, গীতিকার এবং শিল্পী। যন্ত্রসঙ্গীতেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। প্রায় সকল বাদ্যযন্ত্রই তিনি বাজাতে পারতেন অবলীলায়। অসাধারণ প্রতিভাধর এই ব্যক্তিত্বকে উপমহাদেশে বাঙালি সংস্কৃতির এক অগ্রপথিকও বলা যায়। প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তাঁকে ‘সুরসাগর’ উপাধিতে ভূষিত করে। সঙ্গীতে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পন করার কারণে সিলেটের রসময় মোমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্বেও এন্ট্রাস পরীক্ষা দেওয়া হয়নি তাঁর। লেখা পড়া ছেড়ে তিনি সঙ্গিতের টানে পাড়ি জমান কলকাতায়। মাত্র ২২ বছর বয়সে কলকাতা বেতারের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে পথচলা শুরু হয় তাঁর। তবে, ঢাকা বেতার কেন্দ্র চালু হবার পর তিনি চলে আসেন ঢাকায়।
প্রানেশ দাসের সঙ্গীত সাধনার সময় ততটা দীর্ঘ নয়। প্রায় তিন দশক সময়ে তিনি নিজেকে অধিষ্ঠিত করেন এক অনন্য উচ্চতায়। প্রানেশ দাসের সুরকরা যেসব গান স্বাধিনতা পূর্ব সময়ে সঙ্গিতপিপাসুদের তৃষ্ণা মিটিয়েছিলো তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ‘বন্ধু তোমার পিড়িতের এতো জ্বালা’; ‘বন্ধু অবলার প্রাণ’; ‘তুমি গান গাও আমি ঘুমিয়ে পড়ি’; ‘বধূয়া এলো না ফিরে রাতি বহে যায়’; কিংবা ‘শোনো গো মাওই বউয়ের কী নমুনা’।
বাংলাদেশ বেতারের সিলেট কেন্দ্র যে গান বাজিয়ে উদ্বোধন করা হয়, সেই ‘তুমি রহমতের নদীয়া, তুমি রহমতের নদীয়া/ দয়া করে মোরে হযরত শাহজালাল আওলিয়া’-গানের সুরকারও তিনি।
তার সুরারোপ করা গানে ও পরিচালনায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, রাখী চক্রবর্তী, প্রভাতী সেন, নির্মলেন্দু চৌধুরী, সুজয় শ্যাম, আরতিধরসহ এ দেশের প্রখ্যাত শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন।
প্রানেশ দাস সহস্রাধিক গান রচণা করেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য তার গানগগুলো গ্রন্থাবদ্ধ হয়নি। জীবদ্দশায় মাত্র একটি বই বের করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ও সুরারোপিত বিশটি গানের স্বরলিপিসহ ‘গোধূলির বাঁশী’। এই গ্রন্থের শেষ মলাটে কথাশিল্পী তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত প্রকাশিত হয়। তিনি লিখেছেন ‘…তার গান এবং স্বরলিপির বই গোধূলির বাঁশী পড়লাম। বাংলাদেশ গীতি সমৃদ্ধ দেশ। অতীতকালের পদাবলী পর্যায়ের কথা থাক…বর্তমান যুগে বাংলার গানের রাজ্য বসন্তের পুষ্পিত বনভূমির সঙ্গে তুলনীয়। সেই পুষ্পিত বনভূমে প্রাণেশ বাবুর গানগুলি অনধিকার প্রবেশ করেনি; আপন অধিকারেই আপন স্থান করে নিয়েছে। …’
তৎকালীন সময়ে বোদ্ধা মহলেও তাঁর গানের বই ব্যাপক প্রশংসিত হয়। সাপ্তাহিক দেশ ও আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘গোধূলির বাঁশী’র উচ্চসিত প্রশংসা করে নিবন্ধ ছাপা হয়। বই প্রসঙ্গে সুরসাগর হিমাংশু কুমার দত্ত লিখেন, ‘…আমি শ্রীযুক্ত প্রাণেশ দাস মহাশয়ের কণ্ঠে তাঁরই রচিত কতগুলি গান শুনে বিশেষ তৃপ্তি লাভ করেছি একাধারে কথা, সুর ও গায়কীর সমন্বয় দেখলে সবিষ্ময় আনন্দ লাভ হয়।’
১৯৪২ সালে আসামের ডিপিআই গ্রন্থটিকে পুরস্কার প্রদান ও লাইব্রেরীর জন্যে অনুমোদন দেয়। ১৯৪৩ সালে বালিকা বিদ্যালয়সমূহের সঙ্গীত ক্লাসে গ্রন্থটি পাঠ্য হিসেবে অনুসরণের জন্যেও অনুমোদিত হয়।
দক্ষ সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবেও সকলের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন প্রাণেস দাস। তিনি দীর্ঘদিন সিলেট সরকারী বালিকা বিদ্যালয় ও শিশু বিদ্যালয়ে সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। ১৯৪১ সালে কলকাতার বিখ্যাত থিয়েটার ‘স্টার থিয়েটারের’ সঙ্গীত পরিচালক পদে তিনি অধিষ্ঠিত হন। ১৯৫২ সালে সিলেটে মিউজিক্যাল স্কুল ‘গীতালি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬২ সালে সিলেট একাডেমী অব ফাইন আর্টসের ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। বিশ্ব ভারতীয় লোকশিক্ষা সংসদের সিলেট সঙ্গীত বিভাগের অধ্যক্ষের দায়িত্বও তিনি পালন করেন দক্ষতার সাথে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সিলেট বেতার কেন্দ্রের প্রধান সঙ্গীত পরিচালকের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাছাড়াও চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রেরও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি।
প্রানেশ দাসের অগাদ দেশপ্রেম ছিলো। দেশকে তিনি মায়ের মতোই ভালবাসতেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর আকাশবাণী কলকাতা থেকে অমন্ত্রন ছিলো সেখানে যোগদানের। কিন্তু তাদের আহ্বানে তিনি সারা দেননি। এদেশে অবস্থান করে তিনি সঙ্গিতের প্রবাহকে স্বাভাবিক রাখতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালান। সে সময় যে ক’জন সঙ্গীত সাধকের শ্রম সাধনায় ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে এই অঞ্চলের গান বিকশিত হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি। প্রানেশ দাস অসংখ্য সঙ্গিত প্রতিভা বিকাশেও ভূমিকা রেখেছেন। বহু শিল্পীর জীবন গড়ায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য্য।
যে সময়টাতে অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে, গীত ও সুরের দ্যুতি ছড়িয়ে নিজেকে আরও উচ্চতায় এবং দেশের সঙ্গিতকে ঋদ্ধ করার কথা ঠিক সেই সময়টায় মৃত্যুর হিমশীতল পরশ তাঁকে আচ্ছাদিত করে। মাত্র ৫২ বছর বয়সে ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মস্তিস্কে রক্তক্ষরণজনিত রোগে অকাল প্রয়ান ঘটে এই গুণী সঙ্গীতজ্ঞের। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, তিন পুত্র ও পাঁচ কন্যা রেখে যান। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রয়াত প্রণব দাস ছিলেন বিখ্যাত সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। দ্বিতীয় পুত্র প্রয়াত অঞ্জন দাসও ছিলেন বেতারের সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। কনিষ্ঠ পুত্র পান্না দাস বর্তমানে বাংলাদেশ বেতার ঢাকা কেন্দ্রের সঙ্গীত প্রযোজক ও সুরকার হিসেবে কর্মরত। এছাড়া তিনিও সঙ্গীত পরিচালক খ্যাতি অর্জন করেছেন।
প্রানেশ দাসের ছেলেদের প্রত্যেকেই যেখানে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন সঙ্গিতাঙ্গনে, সেখানে তার উপেক্ষিত থাকাটা সত্যিই বিস্ময়ের!