রামকানাই দাশ

গ্রামীণ জনপদে জন্ম নিয়ে, মাটির কাছাকাছি থেকে দেশের যে ক’জন শিল্পী জীবদ্দশায় নাম-যশ-খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন সংগীতগুণী রামকানাই দাশ তাদের মধ্যে অন্যতম। শাস্ত্রীয় সংগীত এবং প্রাচীন বাংলা লোকসংগীতের শিল্পী হিসেবে তাঁর খ্যাতি ঈর্ষনীয়। সাধনাবলে তিনি শুধু নিজেই  সংগীতভুবনের অনন্য উচ্চতায় আসীন হননি, তাঁর গায়কিতে বাংলা লোকগানও পেয়েছে ভিন্নমাত্রা। আমরা যাদের কিংবদন্তি বলি, তিনি তাদেরই একজন।

১৯৩৫ সালের ১৫ এপ্রিল সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার পুটকা গ্রামে বাবার মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন রামকানাই দাশ। তাঁর মায়ের নাম দিব্যময়ী দাশ, বাবা রসিকলাল দাশ। পৈত্রিক বাড়ি দিরাই উপজেলার পেরুয়া গ্রামে। পরিবেশগতভাবেই ভাটি অঞ্চলে সংগীত আবহ প্রবাহমান। বছরের ছয় মাস হাওরে জল থৈ থৈ করে। এই সময়টায় গান বাজনা নিয়েই মশগুল থাকে অবসরে থাকা হাওরপাড়ের মানুষ। বিশেষকরে রামকানাই দাশ যে সময়টাতে জন্ম নিয়েছিলেন সেই সময়টায় সংগীতই ছিল কালনীর কূলে বসবাসকারীদের বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ। সেই পরিমণ্ডল এবং সংগীতিক উত্তরাধিকার রামকানাই দাশকে সুরের পথের অনুসারি হতে সহায়তা করেছিল। রামকানাই দাশের পিতা-মাতা উভয়েই গান করতেন। তাঁর দাদা এবং বড়বাবাও ছিলেন সংগীতাঙ্গনের মানুষ। সংগীত ও আমার জীবন বইয়ে রামকানাই দাশ এ প্রসঙ্গে সবিস্তর বর্ণনা দিয়েছেন-

আমার অন্যতম পূর্বপুরুষ রাধাচরণ তালুকদার লেখাপড়ায় কেবল প্রাইমারি স্তর অতিক্রম করলেও তিনি ছিলেন বিদ্যানুরাগী ও গানবাজনায় সুদক্ষ। তাঁর ছেলে রামচরণ রচিত অনেক ঘাটুগান আমার কৈশোরেও এলাকায় প্রচলিত ছিল।

রামচরণের চার ছেলের একজন ছিলেন প্রকাশচন্দ্র তালুকদার। গান বাজনার কারণে প্রকাশচন্দ্র সংসারকর্মে খানিক অমনোযোগী হয়ে তালুকের সম্পত্তির অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে ফেলেন। আমার বাবা রসিকলাল হচ্ছেন এই প্রকাশচন্দ্র তালুকদারেরই একমাত্র সন্তান।

বাবা তাঁর বাবার মতো বিষয়-বিমুখ ছিলেন না; তাঁর বিষয় আসক্তিও ছিল না। তবে তাঁর সঙ্গীতানুরাগ যৌবনের প্রারম্ভেই একটা সংহত স্তরে উন্নীত হয়, যা তাঁকে এক আত্মমগ্ন লোকসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে বিকশিত করে।…বাবা তাৎক্ষণিক গান রচনা করে গাইতে পারতেন। তিনি সৃষ্টির আনন্দে সেসব গান রচনা করতেন।…

আমার মা দিব্যময়ী দাশ একজন পরিপূর্ণ গৃহকর্ত্রী হয়েও খাঁটি সঙ্গীত-রসিক ছিলেন। সকল প্রকার মেয়েলি গান, কীর্তন, ধামাইল, গ্রাম্যগীত প্রভৃতি বিভিন্ন অঙ্গের গানই তিনি গাইতেন। তিনি গান বাঁধতেন অর্থাৎ রচনা করতেন।

সেই আবহ ছোট্টবেলাতেই গানের প্রতি অনুরক্ত করে রামকানাই দাশকে। গলা ভালো থাকায় বাবা-মা তাকে গান শেখাতে শুরু করেন। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন এলে স্বভাবতই ডাক পড়তো রামকানাইয়ের। গান শোনাতে হতো তাঁকে।

রামকানাই দাশের পিতা রসিকলালের একটি গানের দল ছিলো, এলাকায় বেশ জনপ্রিয় ছিলো দলটি। একবার পাশ্ববর্তী রামপুর গ্রামে তাদেরই আত্মীয় রাধাকান্ত সরকারের বাড়িতে বাবার দলের সাথে গান শুনতে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের উৎসাহে সংগীত পরিবেশন করেন রামকানাই। ছোট্ট শিশুর গাওয়া সেই গানে আবিষ্ট হয়েছিলেন স্রোতারা। সেটিই ছিলো কোনো অনুষ্ঠানে গাওয়া রামকানাই দাশের প্রথম গান। এই অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশনই তাঁকে সংগীতের পথে প্রবাহমান রাখতে পরবর্তীতে ভূমিকা রাখে।

রসিকলাল-দিব্যময়ী দাশ দম্পত্তির ছয় সন্তানের মধ্যে রামকানাই ছিলেন তৃতীয়। ছেলেদের মধ্যে প্রথম হওয়ার কারণে শৈশবে অত্যধিক স্নেহ পেয়েছেন তিনি। ছেলের গানের প্রতি ঝোঁক দেখে বাবা তাঁকে একটি ঢোলক কিনে দেন, আর মা কিনে দেন একজোড়া করতাল। কার্তিক মাসে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সন্ধ্যা বেলায় নগর-কীর্তন করে থাকেন। গ্রামে কীর্তন দলের সাথে প্রতি সন্ধ্যায়ই বেরিয়ে পড়তেন রামকানাই, সাথে থাকতো বাবার কিনে দেওয়া ছোট্ট ঢোলক। এর ফলে সাত-আট বছর বয়সেই নানা ধরনের গান আয়ত্ব করেন তিনি। সেই সাথে চলতে থাকে প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ। প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ শেষ হলে ব্রজেন্দ্রগঞ্জ জুনিয়র হাইস্কুলে ছেলেকে ভর্তি করার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন রসিকলাল। কিন্তু স্কুলে ভর্তি হওয়ার পূর্বেই রামকানাই দাশকে বাবার মাসতুতো ভাই রাধাকান্ত সরকারের যাত্রার দলে অভিনয় করতে রামপুরে পাড়ি জমাতে হয়। রামকানাই দাশের জবানীতেই শোনা যাক সেই ঘটনা-

আমি স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, ঠিক তক্ষুণি কাকু মা-বাবাকে ডেকে তার আগমনের উদ্দেশ্য জানালেন। জানালেন যে তিনি আমাকে নিতে এসেছেন। বাবাকে কাকু খুব সমীহ করে ঠাকুরদা ডাকতেন। হিন্দুসমাজে অন্যত্র পিতামহকে ঠাকুরদা বলা হলেও ভাটি গ্রামাঞ্চলে বড় ভাইকে ঠাকুরদা বলে সম্বোধন করা হয়। বাবার জিজ্ঞাসার জবাবে কাকু বললেন-‘ঠাকুরদা, আমি একটা সখের যাত্রাদল করেছি। বাইরে থেকে অনেক লোক এনেছি, কিন্তু যদুপতি পালায় কিশোর সুবাহু চরিত্রের জন্য কাউকে পাচ্ছি না। তাই আমি রামকানাইকে নিতে চাই এ চরিত্রের জন্য।’ প্রস্তাবের আকস্মিকতায় বাবা যেন আকাশ থেকে পড়লেন; বললেন, ‘বলিস কী, আজ তো সে স্কুলে ভর্তি হবে।’…বাবা পড়াশোনার ক্ষতির কথা বলে আপত্তি করলেন। কাকু ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। তিনি বললেন, ‘আমি নিজে পড়াব রামকানাইকে, তার পড়ার যাতে কোনো ক্ষতি না হয় তা দেখার দায়িত্ব আমার।

রাধাকান্ত সরকারের প্রস্তুাব শেষ পর্যন্ত উপেক্ষা করতে পারেন নি রসিকলাল। যাত্রাদলে অভিনয়ের জন্য তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যান রামকানাইকে। আর এরই মধ্যদিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণের পর্ব চিরদিনের মতো শেষ হয়ে যায় তাঁর। রামপুর থেকে পেরুয়া ফিরে এসে এক ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি হন রামকানাই। কারণ ক্ষেত-কৃষির আয় দিয়ে তাদের সকল ভাই-বোনের লেখা-পড়ার খরচ চালানো রসিকলালের পক্ষে তখন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই পরিস্থিতিতে মহাদুশ্চিন্তায় পড়েন তিনি। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর রসিকলাল রামকানাইকে গান-বাজনা এবং কৃষিকাজে মনোনিবেশ করতে বলেন। বাবার কাছ থেকে এই নির্দেশনা পেয়ে খুশিই হন রামকানাই। কারণ প্রথাগত শিক্ষার চাইতে সংগীতের দিকেই তাঁর আগ্রহ ছিলো বেশি। রসিকলাল ছেলেকে তবলা কিনে দেন চর্চার জন্য। তবলা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হন রামকানাই। এতদিন ঢোলক-এ বোল তোলা হাত তবলায় যেনো নতুন ছন্দ খোঁজে পায়। তবলা আর কৃষিকাজ এ-দুই নিয়েই মগ্ন থাকেন রামকানাই। দুরবর্তী হাওরের ডেরাতেও তিনি চালিয়ে গেছেন গান-বাজনা। গ্রামের সকল গানের অনুষ্ঠানে একসময় তাঁর উপস্থিতি অপরিহার্য্য হয়ে দাড়ায়। কবি গানের গায়ক হিসেবেও এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। কিন্তু তখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কারো কাছ থেকে সংগীতে তালিম নেওয়া হয়নি তাঁর। সেই সুযোগ অনেকটা আকস্মিকভাবেই এসে যায়। এলাকায় যাত্রাদল গঠিত হলে তবলাসঙ্গতের জন্য তাঁকে মনোনীত করা হয়। দলের ম্যানেজার চিতু বাবু পার্টির সংগীত পরিচালক কালীমোহন চক্রবর্তীর কাছে নিয়ে যান তাঁকে। তাঁর বাজনা শুনে ওস্তাদজি বলেন, ‘আরও শিখতে হবে।’ রামকানাইকে সেই শিক্ষা প্রদানের দায়িত্ব তিনি নিজেই গ্রহণ করেন। হাতে ডোর বাঁধেন রামকানই। কালীমোহন চক্রবর্তী মনপ্রাণ ঢেলে তাকে শিখাতে লাগলেন তবলা এবং গান। শাস্ত্রসম্মতভাবে তিনিই তাঁর সংগীত শিক্ষার প্রথম গুরু। দিনে পনেরে-ষোলো ঘণ্টা প্র্যাকটিস করতে হতো। তাঁর কাছ থেকেই খেয়াল গানের তালিম নেন রামকানাই। যা পরবর্তী পর্যায়ে তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করে। কালীমোহনের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণের পর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতেও তাঁর সুনাম  ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

যাত্রার দলে প্রথমে অভিনয়, পরবর্তিতে তবলাসঙ্গত-যাত্রাতেই পুরোপুরি আত্মমগ্ন হয়ে পড়েন তিনি। এছাড়া অন্যকোনো পথ খোলা ছিল না তাঁর সামনে। কারণ তখনকার সময়ে যাত্রাগান শুধু ভাটিবাংলা তথা গ্রামীণ জনপদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যমই ছিলো না, যাত্রার দলগুলো ছিলো চেনা-অচেনা সংগীতগুণীদের সম্মিলন ক্ষেত্র। সন্জিদা খাতুনের বক্তব্যে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়-

আশ্চর্য গ্রহিষ্ণুতা সঙ্গীতের সকল ধারার রসপানে সমৃদ্ধ করেছিল রামকানাই দাশকে। তাই স্কুলে ভর্তি না করে ভাইয়ের অনুরোধে তাঁকে পাশের গাঁয়ে যাত্রাদলের বালক চরিত্রে গীতাভিনয় করতে পাঠিয়ে পিতা কোনো ভুল করেননি। যাত্রাদলের বিচিত্র ধরণের শিক্ষা তাঁকে নিয়ত ঋদ্ধ করেছে।…

আপন গণ্ডি ভেঙে ক্রমাগত এগিয়ে চলবার ব্যাকুল তাড়না ছিল এই লোকগায়কের। কৃষিকাজ ছেড়ে কবিগান আর যাত্রাকে পেশা হিসেবে অবলম্বন করে, রাগসঙ্গীতের শিক্ষাগ্রহণে প্রবৃত্ত হলেন যাত্রাদলের ওস্তাদজীর কাছে। লোকসংগীত আর শুদ্ধসঙ্গীতকে আমরা পরস্পর দূরবর্তী বলে ভেবে ভুল করি। মায়ের বিলাপ শুনে যে ব্যক্তি শুদ্ধ রাগের সরগম আর বেদনা চিনে নিয়েছেন, তাঁর কাছে শুদ্ধসঙ্গীত-লোকসঙ্গীতের আত্মিক যোগ প্রতিভাত হয়ে উঠাই স্বাভাবিক। তাই লৌকিক মাটির গান আর আকাশবিহারী শুদ্ধ রাগরাগিণীর পারষ্পরিক আর সর্বাত্মক পরিচয় গ্রহণে নিবেদিত হন রামকানাই।

শেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিলো তাঁর, নিজেকে শাণিত করতে সম্ভব সবরকম প্রচেষ্টাই চালিয়েছেন তিনি। এলংজুরীর শচীন্দ্র মাস্টারের কলের গান এবং ভাটিপারার ফয়জুননুর চৌধুরীর রেডিও তাঁর গান শেখায় সহায়ক হয়েছিল। তবলা শিখতে আগরতলায় ছুটে যেতেও কুন্ঠাবোধ করেন নি। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ওস্তাদ রাসবিহারী চক্রবর্তী (দিরাই), ওস্তাদ সুরেন্দ্র সূত্রধর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), ওস্তাদ আবু দাউদ খান (মুর্শিদাবাদ), ওস্তাদ সগীরুদ্দিন খান (কলকাতা) এবং পণ্ডিত অরুণ ভাদুড়ী (কলকাতা)  প্রমুখের কাছ থেকে তালিম নিয়ে নিজেকে ঋদ্ধ করেন এই সংগীত সাধক। সেই অর্জনকে তিনি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন। নিজের মেধা এবং শিক্ষা-এই দুইয়ের সম্মিলনে তিনি সংগীত ভুবনে স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নেন।

জীবনের প্রয়োজনে একপর্যায়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। আজমিরীগঞ্জে প্রায় ৫ বছর ছাত্র-ছাত্রীদের গান শিখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন এই গুণী শিল্পী। প্রশিক্ষক হলেও জানার আগ্রহ তাঁকে সবসময়ই তাড়িত করতো। তাই এক স্থানে কখনো স্থায়ি হতে পারেন নি তিনি। আজমিরীগঞ্জের শিক্ষকতার পর্ব শেষ করে যোগ দেন বিখ্যাত যাত্রাদল ভাগ্যলক্ষ্মী অপেরায়। এরপর আরও একাধিক যাত্রাদলে সংগীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে ফিরে আসেন বাড়িতে। এসময় তিনি সুনামগঞ্জ আর্টস কাউন্সিলে সংগীত শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এখানেও বেশিদিন থাকা হয়নি। সিলেট বেতারে বাদক, যন্ত্রী এবং কলাকুশলী আবশ্যকের বিজ্ঞাপন শুনে অডিশন দিতে ছুটে আসেন শহরে। অডিশনে তবলা ক্লাসিক্যাল এবং নজরুল সংগীতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৭ সালের ১৭ আগস্ট স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগদান করেন রামকানাই। নতুন কর্মস্থল বেশ উপভোগ করছিলেন তিনি। সিলেটে অবস্থানের ফলে এখানকার শিল্পী এবং সংস্কৃত অঙ্গনের নেতৃস্থানীয়দের সাথেও সখ্যতা গড়ে উঠে তাঁর। গায়ক এবং তবলাসঙ্গত- উভয় ক্ষেত্রেই নিজের পারদর্শীতার সাক্ষর রাখেন রামকানাই। কিন্তু কিছু ঘটনা তাঁর সুস্থ সংগীত চর্চার পথে অন্তরায় হয়ে দাড়ালে ৯ মাসের মাথায় বেতারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন তিনি। বেতারের চাকুরি ছাড়লেও আর গ্রামে ফিরে যাননি। শহরে অবস্থান করে শুরু করেন সংগীত শিক্ষা দান। তাঁর আলয়ে প্রচুর ছাত্র-ছাত্রীর সমাগম ঘটে। জাতীয় পর্যায়ে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা সুনাম অর্জন করলে রামকানাইয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ওপারে পাড়ি জমাতে হয় তাকে। দুঃসহ সেই সময়ে অস্ত্রহাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারলেও তাঁর কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে যুদ্ধজয়ের গান। শরণার্থী শিবিরে ঘুরে ঘুরে জনতার মনোবল সঞ্চারে গেয়েছেন সাহস জাগানিয়া গান। আশার বাণী শুনিয়েছেন তিনি আশাহত মানুষকে।

১৯৮৮ সালে সিলেটে ‘সঙ্গীত পরিষদ’ গঠন করে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন সংগীত শিক্ষাদান। নিজেও গাইতে থাকেন। লোকগান, নজরুল সংগীত, রবীন্দ্র সংগীত এবং খেলায়গানে তাঁর পরিবেশনায় মুদ্ধ হন শ্রোতারা। ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে শুদ্ধ সংগীত প্রসার গোষ্ঠীর শীতকালীন সংগীত সম্মেলনে উচ্চাঙ্গসংগীত পরিবেশন করে তিনি প্রথম সুধীমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপর দেশ-বিদেশের অসংখ্য অনুষ্ঠানে সাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশন করে নিজেকে খেয়াল গানের শ্রেষ্ঠ গায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করেন এই সংগীতগুরু। সংগীতের অন্যান্য শাখাতেও পারঙ্গমতার পরিচয় দেন রামকানাই। জয় করে নেন শ্রোতাদের মন। ওয়াহিদুল হকের ভাষ্যে ফুটে উঠেছে তাঁর শীর্ষে অবস্থান করার আখ্যান-

‘সঙ্গীতের সূক্ষ্মবোধ তার মতো কারো মধ্যে দেখিনি। খেয়াল শৈলীর এই পরমগুরু বোধকরি একমাত্র উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের উস্তাদ যিনি প্রকৃত রবীন্দ্রসঙ্গীত মনস্ক। তিনি শেখানও তা এবং শেখাতে গিয়ে কেঁদে বুক ভাসান। আমাদের দেশীয় গ্রাম্য গানের বিষয়েও তার রুচি, অভিজ্ঞতা এবং অধিকার অতুলীয়।’

সত্যিই তিনি অতূলনীয় ছিলেন। সংগীতের যে শাখাতেই বিচরণ করেছেন, সেখানেই রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর। নিজের অর্জিত শিক্ষাকে তিনি বিলিয়ে দিয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে। তবে তা শুধু দেশের গণ্ডিতেই আবদ্ধ ছিলো না; শুদ্ধ সংগীত চর্চার ক্ষেত্র প্রসারে তিনি তাঁর কর্মপরিধি যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত বি¯তৃত করেছিলেন। সংগীত পরিষদের নিউইয়র্ক শাখায় উচ্চাঙ্গ সংগীতে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিতে ছুটে গেছেন সেখানে। কিন্তু প্রবাসের চাকচিক্য আর ভোগবিলাস তাঁকে নিজের লক্ষ্য থেকে একবিন্দুও টলাতে পারেনি। এমনকি আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ থাকা সত্বেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। একটানা ছয়মাসের বেশি সেখানে কখনো অবস্থান করতে তাঁর ভালো লাগতো না। দেশ মাতৃকাকে ছেড়ে অন্যকোথাও থাকতে পারতেন না বাংলা মায়ের এই গুণী সন্তান। সদূর প্রবাসে অবস্থান করলেও তাঁর মন পড়ে থাকতো ভাটি-বাংলার সুরধনীর কিনারায়।

রামকানাই দাশ সংগীতেই নিবেদিত ছিলেন বুঝতে পারার দিন থেকে শুরু করে বোধ হারানোর দিন

পর্যন্ত। অসংখ্য গুণী শিল্পীর সান্নিধ্য তাঁর চলার পথকে করেছিলো সাবলীল। তাঁর প্রচেষ্টায় যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে সংগীতের বিভিন্ন শাখা তেমনি সংগীতের কল্যাণে তিনিও হয়েছেন সম্মানিত। সংগীতে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯১ সালে অগ্রদূত শিল্পীগোষ্ঠী সম্মাননা, ১৯৯৭ সালে ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন স্মৃতিপদক, ১৯৯৯ সালে ভারতের শিলচরের সংগীতচক্র সম্মাননা, ২০০০ সালে রবীন্দ্র পদক, উর্বশী পদক, শাপলা শিল্পী গোষ্ঠী গুণীজন পদক, ২০০২ সালে স্বপ্নিল প্রডাকশন সম্মাননা, ২০০৩ সালে শুদ্ধ সংগীত প্রসার গোষ্ঠী সম্মাননা, ২০০৫ সালে হাসন রাজা ফোক ফেস্টিব্যাল সম্মাননা, ২০০৭ সালে সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, ২০০৮ সালে ব্রাহ্মসমাজ সম্মাননা, ২০০৯ সালে শিকড় সম্মাননা, ২০১০ সালে নারায়নগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট সম্মাননা, ২০১২ সালে ‘বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ, ২০১৩ সালে মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মানন পদক ও ২০১৪ সালে একুশে পদক লাভ তাঁর জীবনের অন্যতম অর্জন।

তাঁর গাওয়া গান নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে মোট পাঁচটি অ্যালবাম। সেগুলো হচ্ছে, বন্ধুর বাঁশি বাজে (২০০৪), সুরধ্বনির কিনারায় (২০০৫), রাগাঞ্জলি (২০০৬), অসময়ে ধরলাম পাড়ি (২০০৬) এবং পাগলা মাঝি (২০১০) ৭। এই অ্যালবামগুলোতে শুধু তাঁর সুরই আবদ্ধ হয়নি, প্রাচীনকালের গায়কীও সংরক্ষিত হয়ে আছে ক্যাসেটগুলোতে!

গায়ক, সংগীত শিক্ষক, সুরকার এবং লোকগানের এই সংগ্রাহকের লেখা-লেখির প্রতিও প্রবল আগ্রহ ছিলো। ২০০৫ সালের একুশে বইমেলায় তাঁর সংগীত বিষয়ক বই ‘সরল সঙ্গীত শিক্ষা’ প্রথম খণ্ড এবং পরবর্তীতে দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। যা সংগীতাঙ্গনে বিপুল প্রশংসিত হয়েছিল। ২০১১ সালে তাঁর আত্মজীবনী ‘সঙ্গীত ও আমার জীবন’ প্রকাশিত হয়। বইটিতে লেখক হিসেবে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

তৃণমূল থেকে শিখরে ওঠা এই শিল্পী গভীর রবীন্দ্র-অনুরাগী ছিলেন। কবিগুরুর আদর্শে তিনি এতটাই অবিচল ছিলেন, যে কোনো সমস্যায় রবীঠাকুরের দর্শনই ছিলো তাঁর মুক্তির পথ! তাই রামকানাই দাশ হয়ে উঠেছিলেন সুন্দরের পূজারি, মানবতার জয়গানের অনন্য শিল্পী।

মাটির কাছাকাছি থেকেই তিনি দীর্ঘ সাধনা চালিয়েছেন। অতীত এবং বর্তমানের মাঝে সেতু রচনা করে অব্যাহত রেখেছিলেন পথচলা। শুরু করেছিলেন যেখান থেকে শেষটাও তিনি করেছেন সেখানেই! অতীতবিস্মৃতি ঘটেনি তার বেলায়। আমরা তাই প্রত্যক্ষ করি, অন্যরকম এক রামকানাই দাশকে। যিনি উন্মুক্ত আকাশের নীচে বসে ‘বিনে পয়সার পাঠশালা’য় মনের আনন্দে ছিন্নমূল শিশুদেরকে গান শেখান, নদীর তীরে বসে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠেন, কিংবা তাস খেলতে খেলতে খালি গলায় তাঁর গান ধরেন-‘শ্যাম কালিয়া সোনা বন্ধুরে নিরলে পাইলাম না তোমারে।’ 

রামকানাই দাশ ছিলেন ভীষণ আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ। চর্চার মাধ্যমে সময়ে সময়ে শুধু নিজেকেই অতিক্রম করেন নি, অন্যদেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে পৌছতে সক্ষম হয়েছিলেন! প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে তাঁর এই অভিযাত্রায় অসম্ভব বলে কিছু ছিলো না। যেমন গানে, তেমনি বাদ্যযন্ত্রেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তো বটেই নিজের পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকেই তিনি দিয়েছেন সংগীত শিক্ষা। তাঁর শোণিতে সংগীতের যে ধারা প্রবাহমান ছিলো তা সার্বজনীন করার প্রচেষ্টায় তিনি রত ছিলেন আজন্ম। মৃত্যু রক্ত মাংসের রামকানাই দাশকে গ্রাস করলেও সুরের ভুবনে তাঁর বিচরণ থাকবে অনন্তকাল।