বিদিতলাল দাস

বিদিতলাল দাসের জন্ম সিলেটে। তিনি যখন ৯ বছরের শিশু, তখন সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভাগ হয় ভারতবর্ষ। কিন্তু দাস পরিবারের সদস্যরা সাম্প্রদায়িকতাকে উপেক্ষা করে থেকে গেলেন জন্মমাটিতে। দেশকে ভালোবাসার অমোঘ মন্ত্রে তখনই দীক্ষিত হন বিদিত লাল দাস। বেড়ে উঠার সময়ে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সাংস্কৃতিক বৈরীতা; অনুভব করলেন পরাধীনতার বৃত্তে বন্দি থাকার যাতনা। সেই পরিস্থিতিই তাঁর শিল্প সত্বাকে জাগ্রত করে। অন্ধকার দূর করার মাধ্যম হিসেবে তিনি বেছে নেন সঙ্গিতকে। ব্রাতী হন নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিশ্ব পরিমন্ডলে পরিচিত করার। এগিয়ে যেতে থাকেন আপন প্রত্যয়ে।

সুরমা নদীকে খুব বেশি ভালোবাসতেন বিদিতলাল দাস। সুরমার তরঙ্গের মতোই যেনো দূলায়িত তাঁর সুরের ভূবন। প্রিয় এই নদীর বুকে ভেসে ভেসে অসংখ্য গান তিনি সুর করেছেন। গীতিকারদের শব্দচাতুর্যের পংক্তিগুলোকে দিয়েছেন জীবন। নদীর জলের ঢেউয়ের মতোই তাঁর সুর ঢেউ তুলে সঙ্গিত প্রেমিদের মনে। অসংখ্য গানে তাঁর করা সাবলীল সুর সংযোজন লোকগানকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। দেশীয় লোকসঙ্গিতকে জনপ্রিয় করতে এবং আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসতে যাদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে তাদেরই একজন তিনি। সুরমা নদীর প্রতি সুররে ভুবনের মুকুটহীন এই সম্রাটের ভালোবাসার নিদর্শন তাঁর সুর সম্ভারের সংকলন ‘সুরমাপারের গান’। অর্ধশতাধিক গান এতে সংকলিত হয়েছে। ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ তাঁর সুর সংযোজনার অমর কীর্তি। সুর ও সঙ্গিতের ভুবনকে গত ৮ অক্টোবর বিদায় জানিয়েছেন এই সঙ্গিত গুরু। ১৯৩৮ সালের ১৫ জুন ভূমিষ্ট হন বিদিতলাল দাস। তাঁর পিতা প্রয়াত বিনোদলাল দাস, মাতা-প্রভারাণী দাস। তিন ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরীর ‘লোকে বলে বলে রে’ শিরোনামে হাসন রাজার গান শুনে লোক সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। সংগীতে হাতেখড়ি সুরসাগর সুরসাগর প্রাণেশ দাসের কাছে।১ এরপর শিলং-এ ওস্তাদ পরেশ চক্রবর্তীর কাছে সঙ্গীতের তালিম নেন। তাঁর সর্বশেষ সংগীতগুরু ওস্তাদ ফুলমোহাম্মদ খান। সঙ্গীতাঙ্গনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া প্রসঙ্গে বিদিত লাল দাসের ভাষ্য-

‘আমাদের রক্তে সংগীত। আমার বাবা অরগান বাজাতেন, মা বাজাতেন সেতার। এভাবেই আমাদের রক্তে সংগীত ঢুকে যায়। ৭ বছর বয়স থেকে আমার সংগীত চর্চার শুরু। আমি সুর সাগর প্রাণেশ দাসের কাছে সংগীতের হাতে খড়ি নিই। কিন্তু বেশিদিন আমি তার কাছে থাকতে পারিনি। ছোটবেলা আমরা দুভাই এত দুষ্ট ছিলাম যে দুষ্টুমি দেখে বাবা ১৯৪৬ সালে আমাদের শিলং নিয়ে যান। ভর্তি হই ইংলিশ স্কুলে। ছাত্র অবস্থায় আমি গান-বাজনা করার খুব একটা সুযোগ পাইনি। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ওস্তাদ পরেশ চক্রবর্তীর কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখতে শুরু করলাম। এভাবে সংগীত চর্চা করতে করতে আমি গৌহাটি রেডিওতে ভজন ঠুমরি গাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাই। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওস্তাদ ফুল মুহম্মদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। একসঙ্গে দুজন আমরা গৌহাটি রেডিওতে প্রোগ্রাম করতে  যেতাম। তখন কলেজে উঠে গেছি। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি। একদিন খবর এলো, বাবার রেক্টামে ক্যানসার। বাবাকে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য যেতে হবে। এখানে ব্যবসা দেখার মতো কেউ নেই। সে জন্য লেখাপড়া ফেলে সিলেট চলে আসতে হলো বাবার ব্যবসা দেখার জন্য। তখন (ওস্তাদ) ফুল মুহম্মদের সঙ্গে আমার কথা হলো। তিনি বললেন, আমি সিলেট চলে এলে তিনিও চলে আসবেন। ১৯৫৮ সালে আমরা দুজন একসঙ্গে চলে আসি। ফুল মুহম্মদের সঙ্গে চলে আসার পরে আমার বাড়ির রাস্তার ঠিক ওপারেই তিনি ছিলেন। এই সময় তিনি আমাকে গান শেখাতে থাকেন। তার মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আমি তার কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিয়েছি।’২

হাসন রাজার গানে অনুপ্রানিত হয়ে সঙ্গীতের ভূবনে অভিযাত্রা শুরু করা এই শিল্পীর সঙ্গীত চর্চাও শুরু হয় হাসনের গান দিয়েই। যে সময়টাতে হাসন রাজার গান পাওয়া দূরহ ছিল সেই সময়টাতে তিনি তার গান সংগ্রহ করে নিজে গেয়েছেন, অন্যকে দিয়েও গাইয়েছেন। হাসন রাজার গানকে জনপ্রিয় করতে দেশের  যে ক’জন শিল্পী অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন বিদিত লাল দাস তাদের মধ্যে অন্যতম। সেই সময়ের প্রেক্ষাপট বর্ননা করেছেন বিদিত লাল দাস-

‘সাত টাকা ফি দিয়ে মুসলিম সাহিত্য সংসদে ভর্তি হয়ে গেলাম। মরহুম নুরুল হক আমাকে একটি খাতা বের করে দিলেন। ১০-১২টি গান, হাতে লেখা। এই গানগুলো আমি নিয়ে আসতাম আর সুর করতাম। সুর করে আমি আমাদের দেশের বিশিষ্ট শিল্পী আরতি ধরকে শিখিয়ে দিতাম। আরতি ধর এগুলো গেয়ে ঢাকাতে প্রোগ্রাম করতেন। তখনো আমি রেডিওতে গান করার সুযোগ পাইনি। এর কিছুদিন পর আমাদের রেডিওর সাবেক ডিরেক্টর মনোয়ার আব্বাস আমাকে বললেন, ঢাকাতে  লোকসংগীতের একটি প্রতিযোগিতা হবে তুমি আমার সঙ্গে যাবে? বললাম- যাব। সেখানে ওস্তাদ আয়াৎ আলী, ওস্তাদ আবুল কালাম আজাদ বিচারক ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে আমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেছিলেন রথিনের বাবা হরলাল রায়, দিনাজপুরের আফতাবউদ্দিন আহমেদ, এরা। এ প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম হয়ে যাই। সেটা ১৯৬১ সালের ঘটনা। তখন বিচারকরা আমাকে বললেন, কাল সকালে  রেডিওতে যেতে। রেডিওতে যাওয়ার পর আমাকে একটা ফরম বের করে দিলেন। এই তো ঢাকা  রেডিওতে আমার প্রোগ্রাম করা শুরু হয়ে গেল।’৩

সেইযে শুরু এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বিদিতলাল দাসকে। মায়াবি সুরের আবেশ আর কন্ঠ যাদুতে তিনি জয় করতে থাকেন সংগীত প্রেমিদের হৃদয়। নিজেকেই অতিক্রম করতে থাকেন তিনি। সময়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে লোকসংগীতকে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় করার অভিপ্রায়ে গঠন করেন একটি সংগীত দল। সেই দল চিরায়ত লোকসংগীতের অগ্রযাত্রায় অনন্য ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস আয়োজিত লোকগীতি উৎসবে তাঁর দল নিয়ে তিনি অংশগ্রহণ করেন। সেই উৎসবে তাঁর পরিবেশিত গান শুনে পল্লীকবি জসীমউদ্দিন দর্শকের সারি থেকে উঠে এসে বিদিতলাল দাসের গলায় মালা পরিয়ে দেন। দল নিয়ে বঙ্গভবনে বঙ্গবন্ধুর সামনেও সংগীত পরিবেশন করেন বিদিত লাল দাস। রাণী এলিজাবেথ’র স্বামী এডিনবার্ক ডিউকের বাংলাদেশ আগমন উপলক্ষেও তিনি এবং তাঁর দল সংগীত পরিবেশন করেন। লোকসংগীতের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে গঠন করা বিদিতলাল দাস ‘বিদিতলাল দাস ও সঙ্গীরা’ নামের  সংগীত দলটি সেই সময় বাংলাদেশ ও ভারতে বিভিন্ন সময় সংগীত পরিবেশন করে সংগীতপিপাসুদের অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়। তাঁর দলের অংশগ্রহন করা উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানগুলো হচ্ছে-প্রথম সার্ক সম্মেলনে সঙ্গীত পরিবেশন, কলকাতার লোকভারতী আয়োজিত অনুষ্ঠান (১৯৮৮), কাছাড়ে অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে সংগীত পরিবেশন (১৯৮৯) প্রভৃতি। এই দলের সদস্যদের মধ্যে অন্যতমরা হচ্ছেন, সুবীর নন্দী, হিমাংশু গোস্বামী, একে আনাম, আরতী ধর, হিমাংশু বিশ্বাস, ফজল মাহমুদ, দুলাল ভৌমিক, জামালউদ্দিন হাসান বান্না। বিদিতলাল প্রসঙ্গে সেই দলের সদস্য সুবির নন্দীর ভাষ্য –

‘মরমি সাধক কবিদের গানে সুরারোপ করে এবং অন্য সুরকারের গান নিজে গেয়ে তিনি যেমন বাংলাদেশের সংগীত আকাশে জনপ্রিয় হয়েছেন ঠিক তেমনি অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে নিজ হাতে শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত। আমাকেও তিনি নিজ হাতে লোকগীতির কবিও সমও টেকনিক এবং উপস্থাপনা শিখিয়েছেন। তাঁর কাছে এ বিষয়ে আমি চিরজীবন ঋণী। লোকগানে তিনিই আমার সংগীতগুরু।’৪

বিদিত লাল দাস বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে চীন, সুইডেন, নরওয়ে, হংকং, ডেনমার্ক এবং ইংল্যান্ড সফর করেন। একজন সংগীত শিল্পী হিসেবে যেভাবে মঞ্চ কাঁপিয়েছেন ঠিক সেভাবেই তিনি শত শত গানে সুর করে সাধক কবিদের সৃষ্টিকে পড়িয়েছেন অমরত্বের তিলক। তাঁর সুরা করা গানগুলো সব বয়সের মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয়। তাঁর সুর করা অসংখ্য জনপ্রিয় গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৬ টি গানের প্রথম পংক্তি এখানে উল্লেখ করা হলো-

১. সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী
২. মরিলে কান্দিস না আমার দায় রে যাদুধন
৩. সিলেট প্রথম আজান ধ্বনি বাবায় দিয়াছে
৪. কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো
৫. বিনোদিনী গো তোর বৃন্দাবন কারে দিয়ে যাবি
৬. আমি কেমন করে পত্র লিখিরে বন্ধু
৭. প্রাণ কান্দে মন কান্দেরে
৮. ভ্রমর কইয়ো গিয়া
৯. প্রেমের মর জলে ডোবেনা
১০. হাসন রাজা বলে ও আল্লা
১১. আমি যাইমু গো যাইমু আল্লারি সঙ্গে
১২. সোনা দিদি
১৩. মরণ কথা স্মরণ হইলো না তোর
১৪. তুমি রহমতের নদীয়া
১৫. প্রেমের মর জলে ডুবে না
১৬. শেষ বিয়ার সানাই

বিদিত লাল দাসের সুর করা কবি গিয়াস উদ্দিনের লেখা ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ গানটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কথা সাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ূন আহমদের বদৌলতে আকাশছোয়া জনপ্রিয়তা অর্জন করে। হুমায়ূন আহমেদ অসম্ভব ভালোবাসতেন গানটিকে। জীবদ্দশায় গানটি প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমদ বলেছিলেন, ‘সময় আসবে। আমি মারা যাব। আমার পরিবারের সবাইকে বলে রেখেছি, আমি মারা যাওয়ার পরপরই কোরান শরীফ, সূরা ইউনুছের আগেও যেন বাজানো হয় ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়…’ গানটি।’৫

বিদিত লাল দাস বেশ কয়েকটি নাটক ও নৃত্যনাট্যের পরিচালনা করেছেন। তন্মধ্যে ‘সিরাজ-উদ-দৌলা’, দিপান্তর’,‘তাপসী’, ‘প্রদীপ শিখা’, ‘বিসর্জন’, ‘সুরমার বাঁকে বাঁকে’ উল্লেখযোগ্য। চলচ্চিত্রেরও সংগীত পরিচালনা করেছেন। তিনি ‘সোনার কাজল’ ছবির পরিচালক এবং ‘হাসন রাজা’ চলচ্চিত্রের সংগীত উপদেষ্টা ছিলেন।

চলচ্চিত্র শিল্পের পৃষ্টপোষকতায়ও নিবেদিত ছিলেন বিদিত লাল দাস। তাদের পারিবারিকভাবে প্রতিষ্ঠিত লালকুঠি ও রংমহল সিনেমা হল দুটি সিলেটের প্রথমদিককার প্রেক্ষাগৃহ। চলচ্চিত্র শিল্পের মন্দাসহ নানা প্রতিকুলতা সত্ত্বেও এখনো টিকিয়ে রেখেছেন লালকুঠি সিনেমা হলটিকে।

তিনি একজন সংগ্রাহকও ছিলেন। সিলেট অঞ্চলের সাতানব্বই জন মরমি কবির গান তিনি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যখনই সুযোগ পেয়েছেন তখই আত্মনিয়োগ করেছেন সংগ্রহের কাজে। প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেড়িয়েছেন। পাঁচদশকের প্রচেষ্টায় তিনি গড়ে তুলেছেন সংগীতের এক অমূল্য ভান্ডার।

পারিবারিক পরিবেশ তাঁর সঙ্গিত চর্চায় কখনো প্রতিবন্ধকতার কারন হয়ে দাঁড়ায়নি। জীবনের শুরুতে বাবা-মা, ভাইবোন এবং আত্মীয়-স্বজন তাঁকে অগ্রসর হতে আকুণ্ঠ সহায়তা করেছেন। ১৯৬৮ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ে করেন সংগীত অনুরাগী কুমিল্লার মেয়ে কনক রানী দাসকে। বিদিত লাল দাসের বর্তমান পর্যায়ে আসতে জীবনসঙ্গীনি কনক রানী দাসের অবদান অনেকখানি। তাঁর আকাশ ছোয়া সাফল্যের পেছনে প্রেরণাদাত্রী তিনি। তার প্রথম সন্তান নীলম চার বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করে। একমাত্র ছেলে বিশ্বদীপ লাল দাসকে তিনি গড়ে তুলেছেন যোগ্য উত্তসূরি হিসেবে।

ছেলে নীলমের মৃত্যু মেনে নিতে পারেন নি বিদিতলাল দাস। তার স্মৃতি তাকে বেদহত করতো অহর্নিশ।  ছেলের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ ২০০২ সালে তিনি সিলেট নগরীর শেখঘাট এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘নীলম লোক সঙ্গীতালয়’। লোক সংগীতের সুস্থ ধারাকে প্রবাহিত করার লক্ষ্যেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এই বিদ্যালয়। জীবনের শেষ দিকটায় ছাত্র-ছাত্রীদের সান্নিধ্যেই কাটিয়েছেন অধিকাংশ সময়। এই সংগীত স্কুলটিকে কলেজ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন ছিলো তাঁর।   

হাসনরাজা, রাধারমন, গিয়াস উদ্দিনসহ অনেক গীতিকারের গান তিনি সুর করেছেন। মরমী কবিদের গান ছাড়াও তিনি সিলেটের বিলুপ্তপ্রায় লোকসংগীত সংগ্রহ ও প্রচারে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। জারী, সারী, ভাটিয়ালী ও ধামাইল গান সংগ্রহে নিয়োজিত ছিলেন আজন্ম। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তিনি ছিলেন সোচ্চার। সেই সময়কার জনপ্রিয় শিল্পীদের নিয়ে তিনি ভারতে একটি সংগীত দল গঠন করেন। এই দল বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ উপর্জন করে তা মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহার্য্যার্তে ব্যয় করে।

সংগীতকে তিনি অনেক কিছুই দিয়েছেন। জীবনের প্রায় সবটুকু সময়ই তিনি ব্যয় করেছেন সংগীতের কল্যানে। মাটি ও মানুষের গান প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর কাছে। কিন্তু এই সুরস্রষ্টা, শিল্পীর ভাগ্যে জাতীয় পুরস্কার জুটেনি। এনিয়ে জীবদ্দশায় কোনো খেদ ছিলো না তাঁর। বলেছিলেন-‘পুরস্কারের আশায় সংগীত সাধনা করিনি। সংগীতের প্রতি প্রেম ভালোবাসা, মায়া-মমতা øেহ-সোহাগ ছিলো বলেই করেছি আজীবন সংগীত সাধনা। আসলে সংগীত সাধনা করা ছাড়া অন্য কিছু করার ক্ষমতা আমার ছিলো না কখনো।’ জাতীয় পুরস্কার না পেলেও জনমানুষের ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন ঠিকই। সম্মানিতও হয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর গুণীজন সম্বর্ধনা ছাড়াও তিনি দেশে-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার, সংবর্ধনা ও সম¥াননা লাভ করেছেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য লিটল থিয়েটার সিলেট সম্মাননা স্মারক (১৯৯৯), শাপলা শিল্পীগোষ্ঠী গুণীজন পদক (২০০০), জালালাবাদ যুব ফোরাম একুশে পদক (১৯৯০), স্টেশন ক্লাব সিলেট শুভেচ্ছা স্মারক (১৯৮৯), বাংলাদেশ লোকসঙ্গীত কেন্দ্র পদক (২০০০), মানবাধিকার দিবস সম্মাননা পুরস্কার (১৯৯১), গুণিজন সম্বর্ধনা-২০০০, নিখিল ভারত বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন অভিজ্ঞানপত্রস্মারক (১৯৮৯) প্রভৃতি।

তাঁর মতো অনন্য একজনের জাতীয় পুরস্কার না পাওয়া দুঃখজনক। তবে, এতে তাঁর আর কিছু যাবেওনা আসবেওনা, কারণ সব কিছু উর্ধে চলে গেছেন তিনি। রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে তিনি আমাদের মাঝে না থাকলেও সুরের ভূবনে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।

তথ্যসূত্র:
১.    সুরমাপারের গান, উৎস প্রকাশন, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ২০০৬
২.    স্মরণ, বিদিতলাল দাস, শাকুর মজিদ, ঈদুল আজহা সংখ্যা, সাপ্তাহিক ২০০০, ঢাকা, ২০১২
৩.    স্মরণ, বিদিতলাল দাস, প্রাগুক্ত
৪.    সুরমাপারের গান, প্রাগুক্ত
৫.    সুরমাপারের গান, প্রাগুক্ত