
বাচিক শিল্পী হিসেবে মুনিরা পারভীন এখন একটি আলোচিত নাম। বাংলা কাব্যকথাকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার প্রত্যয়ে একের পর এক উদ্যোগ গ্রহণ করে তিনি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে অর্জন করেছেন বিশেষ খ্যাতি। শুধু আবৃত্তি শিল্প সংশ্লিষ্টদের কাছেই নন, আবৃত্তিপ্রেমিদের কাছেও তিনি এখন সমানভাবে জনপ্রিয়। সংস্কৃতির নানা শাখায় দীর্ঘদিনের বিচরণই তাঁকে এনে দিয়েছে এমন ঈর্ষনীয় সাফল্য। সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিভাষ্য পাঠ ও আবৃত্তি করে তিনি অধিষ্ঠিত হয়েছেন এক ভিন্ন উচ্চতায়। তাঁরমতো করে এর আগে কেউ ঠিক এভাবে শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধকে মঞ্চ এবং টিভি পর্দায় বিদেশ-বিভুইয়ে উপস্থাপন করেনি। তাঁর এই উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে বিলেতে বাঙালির তৃতীয় প্রজন্ম। মুনিরার প্রদীপ্ত উচ্চারণের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে নতুন প্রজন্মের অনেকেই এখন গর্ব করে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে। আর চরমভাবে ঘৃণা করে হানাদার ও তাদের দোসরদের।
সূচনা কালের কথা
মুনিরা পারভীনের জন্ম সিলেট শহরে । পৈত্রিক নিবাস হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে। মো. শওকত আলী, শাহানা সুলতানা দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে বড় তিনি। আদুরে হলেও পরিবারের সাংস্কৃতিক আবহের কারণে বুঝতে শেখার আগেই হৃদ্যতার পথে পথ চলা শুরু হয় তাঁর। শিক্ষক পিতার মুখে শুনে শুনে অ-আ,ক-খ শেখার আগেই তিনি রপ্ত করেন, ‘আয় আয় চাঁদ মামা, টিপ দিয়ে যা’-ছড়াটি। সেই যে আবৃত্তির সঙ্গে সখ্য হয়েছিল, সেই সখ্য দিনে দিনে গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো মঞ্চে আবৃত্তি করেন তিনি। শিশু একাডেমির শিক্ষার্থী হিসেবে সিলেট সারদা হলে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে ‘হাঁস’ কবিতা আবৃত্তি করে সবাইকে চমকে দেন। এরপর থেকে শিশু একাডেমি এবং স্কুলের প্রতিটি অনুষ্ঠানে নিয়মিত আবৃত্তি উপস্থাপন করে শিশু শিল্পী হিসেবে অর্জন করেন খ্যাতি। মাত্র ১২ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্রে আবৃত্তি করে মন জয় করেন সবার। সেই থেকে রেডিওতে শিশু-কিশোরদের আবৃত্তি অনুষ্ঠানে অনেকটা অপরিহার্য হয়ে ওঠেন মুনিরা। তাঁকে যুক্ত করা হয় কিশোলয় ও প্রভাতী বিচিত্রা অনুষ্ঠানের সঙ্গে। দুটি অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হিসেবে রেডিওতে জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি। শিশু একাডেমি এবং শিল্পকলা একাডেমির কোর্সসমূহ কৃতিত্বের সঙ্গে সমাপ্ত করেন মুনিরা। মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হওয়ার পর তাঁর কাঁধে অর্পিত হয় বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সিলেট শাখার ‘ক’ বিভাগের দায়িত্ব। আবৃত্তি গুরু হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের কল্যাণে ঐ সময়ে দেশের সর্বকনিষ্ঠ প্রশিক্ষক হিসেবে শিশু একাডেমিতে যোগদান করেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে আবৃত্তি বিষয়ক বেশ কয়েটি স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন । ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত শিশু একাডেমিতে পালন করেন আবৃত্তি প্রশিক্ষকের দায়িত্ব। ১৯৯৬ সালে ঘোষক এবং ১৯৯৭ সালে সিলেট বেতারে সংবাদ পাঠক হিসেবে তালিকাভূক্ত হন মুনিরা। পাশাপাশি শুরু করেন রেডিও নাটক। অল্পসময়ের ব্যবধানে অর্জন করেন প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সক্ষমতা। রেডিওতে এতটাই অপরিহার্য্য হয়ে উঠেন যে, তাঁকে প্রধান চরিত্রে চিন্তা করে স্ক্রিপ্ট লিখতে শুরু করেন নাট্যকাররা। মুনিরার অভিনয় মানেই, নাটক জনপ্রিয়-এমন একটি আবহ তৈরি হয় বেতারে। তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন নাট্যকার, প্রযোজক এবং শ্রোতারা। এমনকি প্রবাসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরুর পর যখনই দেশে এসেছেন অভিনয় করতে হয়েছে নাটকে, সংশ্লিস্টদের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেন নি তিনি। আবৃত্তির পরপরই বেতার নাটকে অভিনয় করতে ভালো লাগে মুনিরার।
দেশ থেকে বিলেতে
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমসি কলেজ থেকে অনার্স শেষ করে মুনিরা পাড়ি জমান ঢাকায়। একই বিষয়ে মাষ্টার্সে ভর্তি হন ইডেন কলেজে। অধ্যয়ন শেষে ২০০৩ সালে বেডফোর্ড শায়ার ইউনিভার্সিটিতে মিডিয়া কালচার অ্যান্ড টেকনোলজি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য পাড়ি জমান বিলেতে। এরপর তিনি এমবিএ সম্পন্ন করেন । প্রবাসী হলেও একদিনের জন্য স্বদেশ থেকে বিযুক্ত হননি তিনি। দেশের মতোই সম্পৃক্ত হন সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে। ওই বছরই লন্ডনে উদীচী স্কুল অব পারফর্মিং আর্টসের বাংলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বাংলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেও তারই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রথমবারের মতো বিলেতে চালু হয় আবৃত্তি শাখা। শিশু এবং বড়দের জন্য আলাদা আবৃত্তি ক্লাস গ্রহনের ব্যবস্থা করেন তিনি। শিশুদেরকে বাংলা আবৃত্তি শেখানো ছিলো সবচেয়ে কঠিন কাজ। তারা যাতে সহজে পড়তে পারে সেজন্য কবিতাকে ইংরেজি অক্ষরে লিখে দিতেন তিনি। ২০০৭ সাল পর্যন্ত পালন করেন এই দায়িত্ব । এ সময় শিশুদের আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজনের পাশাপাশি শিশুদের বৃন্দ এবং একক আবৃত্তির বিভিন্ন অনুষ্ঠান করেছেন তিনি। এছাড়াও বাংলা টিভিতে ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের উপর শিশুদের দিয়ে একটি নাটিকা তৈরি করে অভিভাবকদের শংসা অর্জন করেন। এছাড়া টাওয়ার হ্যামলেটস পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্পে বাংলার প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন মুনিরা। নাট্যাভিনয় এবং গল্পবলায় তাঁর দক্ষতা সর্বজনবিদিত। বিলেতে বেশ কয়েয়টি মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। ২০১৬ সালে আয়োজন করেন শ্রুতি নাটক। এরপর ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি শ্রুতি নাটক মঞ্চস্থ করেন মুনিরা। সংগঠক হিসেবেও তাঁর রয়েছে বিশেষ খ্যাতি। মঞ্চ উপস্থাপনায় রয়েছে তাঁর মুন্সিয়ানা। সংস্কৃতি অঙনের বড় বড় সব আয়োজন অনেকটা নিয়মিতভাবেই উপস্থাপনা করেন তিনি।
২০০৬ সাল থেকে শুরু করেন বিলেতে বসবাসকারী কবিদের কবিতা আবৃত্তি। প্রায় নিয়মিতই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিলেতের কবিদের কবিতা আবৃত্তি করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন তিনি। ২০১৫ সালের মে মাসে ব্রাডি আর্টস সেন্টারে বিলেতের ৩০ জন কবির কবিতা থেকে আবৃত্তির অনুষ্ঠান আয়োজন করে সবাইকে চমকে দেন। বিলেতে বাঙালীর ইতিহাসে এ ধরনের অনুষ্ঠান এটাই ছিলো প্রথম।
যুক্তরাজ্যে সম্প্রচার মাধ্যমের সঙ্গেও তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সংবাদভাষ্যের খুবই পরিচিত মুখ তিনি। শুরুটা হয়েছিল বাংলা টিভির মাধ্যমে, এরপর কাজ করেছেন ভেকটন টিভিতে। ভেকটন টিভিতে এসিস্ট্যান্ট নিউজ এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১০ সাল থেকে চ্যানেল এস এ নিয়মিত সংবাদ পাঠ করছেন। বর্তমানে প্রতি শুক্রবারের রাতের সংবাদ পাঠ করেন মুনিরা। খুব শীগগীর লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের নিয়ে চ্যানেল এস এর আধঘণ্টার একটি সাক্ষাৎকারভিত্তিক বিশেষ অনুষ্ঠানে উপস্থাপক হিসেবে দেখা যাবে তাঁকে। বাতিঘর নামের পাক্ষিক এই অনুষ্ঠানটি পরিকল্পনা, গ্রন্থনা এবং সঞ্চালনা করবেন তিনি।

ছান্দসিক প্রতিষ্ঠা
২০০৮ সালে মুনিরা পারভীন প্রতিষ্ঠা করেন আবৃত্তি সংগঠন ছান্দসিক। এক দশকের পথচলায় এই সংগঠনটি এখন বিলেতের প্রধান আবৃত্তি সংগঠনে পরিণত হয়েছে। শুধু বিলেতেই নয়, মুনিরার নেতৃত্বগুনে বিশ্বব্যাপিই পরিচিতি পেয়েছে সংগঠনটি। মুনিরার মেধা, মননশীলতা এবং শ্রদ্ধাবোধের মানষিকতার প্রমান পাওয়া যায় ছান্দসিকের প্রতিটি অনুষ্ঠানে। দেশাত্ববোধে অনন্য ছান্দসিকের প্রতিটি আয়োজন। সংগঠনের নাম দিয়েছেন তাঁরই আবৃত্তিগুরু হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য।
প্রবাসে অবস্থান করলেও গুরুর সাথে কখনো দুরত্ব তৈরি হয়নি মুনিরার। একদিন কথাপ্রসঙ্গে মুনিরা হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্যকে আবৃত্তি সংগঠন প্রতিষ্ঠার কথা বলে সংগঠনের জন্য নামকরণ করার প্রস্তাব দেন। এর কয়েকদিন পর হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য প্রিয় ছাত্রীর সংগঠনের নাম দেন ছান্দসিক। মুনিরা শুরু করেন কর্মতৎপরতা। হাটিহাটি পা পা করে এগুতে থাকে সংগঠন। তবে, বৃহত্তর পরিসরে কর্মকাণ্ড শুরু হয় হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্যরে মৃত্যুর পর। ২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট মুনিরা হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য স্মরণে ইস্ট লন্ডনের মন্টিফিওরী সেন্টারে আয়োজন করেন শোকসভা। এরপর ২০১৭ সালের ২ জুলাই প্রয়াত আবৃত্তিগুরুকে উৎসর্গ করে ‘হাজার বছরের বাংলা কবিতা, উল্লাসে সংকটে’ শীর্ষক অনুষ্ঠান আয়োজন করেন তিনি। ছান্দসিকের আট জন বাচিক শিল্পী পরিবেশন করেন ২৭টি কবিতা। চর্চাপদ থেকে শুরু করে আধুনিককালের কবিদের কবিতা স্থান পায় হাজার বছরের বাংলা কবিতায়। অনুষ্ঠান পরিকল্পনা, গ্রন্থনা এবং উপস্থাপনায় মুনিরা ছড়ান নান্দনিকতার বিভা। তাঁর কাব্যধারার শেকড়সন্ধানী প্রয়াস শ্রোতা মাত্রেই বিমোহিত করে। হলভর্তি দর্শক পিনপতন নীরবতায় উপভোগ করেন ব্যতিক্রমী এই আয়োজন। প্রথমবারের মতো এরকম বৃহৎ আয়োজন দেখে মোহাবিষ্ট হন কবিতাপ্রেমিরা। এ অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে ভিন্ন এক মুনিরাকে দেখেন ব্রিটেনবাসী। প্রচার মাধ্যমের বদৌলতে তাঁর আলোকপ্রভা এসে পৌছায় বাংলাদেশঅবদি। গুরুবন্দনার এই অনন্য আয়োজন দেখে অনেকেই ভূয়সী প্রশংসা করেন মুনিরার। তাঁর দক্ষ নেতৃত্বে সংগঠনটি আজ শুধু পরিপূর্ণই নয়, বিলেতের অন্যতম অপরিহার্য্য সংগঠনে পরিনত হয়েছে। এখানকার সাংস্কৃতিক প্রতিটি আয়োজনে ছান্দসিকের ডাক পড়ে অবধারিতভাবে। তার পেছনে রয়েছে মুনিরার বুদ্ধিমত্তা এবং উপস্থাপনায় ব্যতিক্রমী প্রয়াস। সেটাই যেনও প্রতিভাত হয়ে উঠেছে ছান্দসিকের উদ্দেশ্য কথনে। সংগঠনটির সাবলীল ভাষ্য-‘বাংলা কাব্যকথাকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে প্রত্যয়ী আমরা। প্রগতিশীলতার পথে সুন্দর আগামী বিনির্মান আমাদের লক্ষ্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে আমরা বদ্ধপরিকর। কুসংস্কার আর কূপমণ্ডকতার বিরুদ্ধেই আমাদের সকল আয়োজন। শব্দভাষ্য আমাদের প্রতিবাদের হাতিয়ার, হতাশায় আশা। রক্তদিয়ে অর্জিত মাতৃভাষার সম্মান রক্ষায় আমরা আপোষহীন। ছন্দভাষ্যে আমরা ছড়াই নান্দনিকতার বিভা। আবৃত্তিকে শিল্পময়তায় ভাস্মর করাই আমাদের অভিলাষ।’ ছান্দসিকের প্রত্যয় কথা আমাদেরকে গভীরভাবে আশাবাদী করে। স্বপ্ন দেখায় সুন্দর আগামীর।
ঐক্যবদ্ধতায় বিশ্বাসী
মানুষের সম্মিলনে বিশ্বাস করেন মুনিরা। যে কোনও শিল্পকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছতে যে ঐক্যবদ্ধতার বিকল্প নেই তা গভীরভাবে বিশ্বাস করেন তিনি। বিলেতের আবৃত্তি সংগঠনগুলোকে এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তারই উদ্যোগে শুরু হয় সম্মিলিত আবৃত্তি পরিষদ গঠনের প্রক্রিয়া। মুনিরা পারভীনের আহ্বানে গত ১২ এপ্রিল বাংলাদেশ প্রতিদিনের অফিসে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সম্মিলিত আবৃত্তি পরিষদের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এতে স্বাভাবিকভাবেই আহ্বায়ক মনোনীত হন মুনিরা। তাঁর এই উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন বিলেতের সুধিজনেরা। তারা এই উদ্যোগকে বাচিক শিল্পের দিক নির্ণায়ক হিসেবে আখ্যা দেন। আবৃত্তি সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার তাঁর এই প্রয়াসটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। সংঘবদ্ধতার এই উদ্যোগটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বিলেতের আবৃত্তির ইতিহাসে।
ব্যতিক্রমী ফেসবুক লাইভ
একের পর এক ব্যতিক্রমী ফেসবুক লাইভ আয়োজন করে মুনিরা পারভীন প্রমান করেছেন আগ্রহ এবং ইচ্ছে থাকলে চিরায়ত মাধ্যমের বাইরে গিয়েও উপস্থাপন করা যায় সৃজনশীলতাকে। আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে বিশ্ববাসীর কাছে ছড়িয়ে দিতেই সামাজিক যোগাযোগের অপরিহার্য্য এই মধ্যমকে ব্যবহার করে চলেছেন তিনি । লল্ডনের অন্যতম প্রধান কবি শামীম আজাদকে নিয়ে প্রথমবারের মতো এ বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি ফেসবুক লাইভে আসেন মুনিরা পারভীন। কবি কণ্যার মুখোমুখি হন বাচিক কন্যা। শামীম আজাদাদের ‘কইন্যা কিচ্ছা’ থেকে আবৃত্তি করেন। এই অনুষ্ঠানটি ছিলো একটি ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা। আঞ্চলিক ভাষ্যে বিলেতের তিন প্রজন্মের নারীর আখ্যান এত সুন্দর করে বিবৃত হয়েছে এতে, যা শ্রোতা মাত্রই আকৃষ্ট করেছে। এরপর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে একুশের গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরীকে নিয়ে ফেসবুক লাইভ করেন তিনি। একটি ঐতিহাসিক গানের জন্মকথা জাতির সামনে নতুন করে উপস্থাপন করেন মুনিরা। এটি ছিলো গাফফার চৌধুরীর ফেসবুকে এ ধরনের প্রথম কোনও লাইভ অনুষ্ঠান। প্রাণের একুশ শিরোনামের এই অনুষ্ঠানটি গতানুগতিকভাবে করেন নি মুনিরা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলো ভিন্নতা। আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা কবিতা আবৃত্তির ফাঁকে ফাঁকে চলে আলোচনা। সাংবাদিক এবং কলাম লেখকের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া কবিকেই যেনও এদিন নতুন করে উপস্থাপন করেন তিনি। মুনিরার কাছে নিজের এত কবিতা রয়েছে দেখে বিস্মিত হন গাফফার চৌধুরী। এরপর ১ জুন ‘রমজানে রক্তাক্ত বাংলা’ শিরোনামে ফেসবুক লাইভে আসেন মুনিরা। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে রমজান মাসের গণহত্যার হৃদয় বিদায়ক কয়েকটি ঘটনা পাঠ করেন তিনি। কথা বলেন, লেখক আরাফাত তানিমের সাথে। সর্বশেষ গত ১০ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদের মুখোমুখি হন তিনি। প্রায় দেড়ঘন্টার লাইভে মুক্তিযুদ্ধের এমন সব লোমহর্ষক ঘটনা লেখকের কাছ থেকে বের করে আনেন যা নতুন করে জানতে পারে মানুষ। মূলত শেকড় থেকে বিচ্ছিন্নদের শেকড়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানোর মানস থেকে এমন সব আয়োজন করে চলেছেন তিনি। যা আরও অনেককে এই পথে পরিচালিত হতে স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
লেখালেখিতেও প্রতিভার স্বাক্ষর
শৈশবে লেখালেখির সাথে নিবিড় সংযোগ ছিলো মুনিরার। শিক্ষাব্রতি পরিবারের সদস্য হিসেবে শৈশবে এটা-ওটা লিখে সবাইকে চমকে দিতেন তিনি। শিক্ষক পিতা এবং স্নেহময়ী মায়ের অগাধ ভালোবাসায় নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বেশ কিছু পুরস্কারও অর্জন করেন। ক্লাস নাইনের ছাত্রী থাকা অবস্থায় প্রান্তিক কচি-কাঁচার মেলায় আঞ্চলিক পর্যায়ে মেয়ে শিশুদের অধিকার বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে প্রথমবারের মতো রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন মুনিরা। পুরস্কার বিজয়ী লেখক হিসেবে মুনিরার লেখার উচ্ছসিত প্রশংসা করেন দাদাভাই। শুধু তাই নয়, সৃজনশীল লেখনীর বাইরে শুধুমাত্র সুন্দর হাতের লেখার জন্য জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত হন মুনিরা। বইয়ের প্রতি আগ্রহ আর লেখালেখিতে নেশার কারনেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া করেন তিনি। অথচ প্রবাস যাত্রার ফলে সাহিত্যের ছাত্রীর সাহিত্যচর্চায় ঘটে ছন্দপতন। এই সময়ে আবৃত্তির প্রতি অধিক মনোনিবেশ করেন তিনি। লেখালেখির সাথে তৈরি হয় দুরত্ব! তবে, সুযোগ পেলেই কলম ধরেন মুনিরা। সাম্প্রতিককালে আবারও লিখতে শুরু করেছেন তিনি। ২০১৮ সালে দৈনিক যুগভেরীর ঈদ সংখ্যায় লিখেছেন শৈশবের ঈদ নিয়ে। সাপ্তাহিক জনমতে লিখেছেন, শাপলার বিল এবং রমেশ রাম গৌরের সাতরঙের চা নিয়ে। সিলেট সম্মিলিত নাট্যপরিষদ থেকে প্রকাশিত লিটলম্যাগে লিখেছেন আবৃত্তি গুরু হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্যকে নিয়ে। সম্প্রতি শুরু করেছেন আবৃত্তি এবং আবৃত্তি অঙ্গন নিয়ে লেখালেখি। পাশাপাশি সম্পাদনার সাথেও যুক্ত হয়েছেন। যৌথভাবে সম্পাদনায় সম্পৃক্ত আছেন তিনটি প্রকাশনার সাথে। ছান্দসিকের উৎসব স্মারক এর মধ্যে অন্যতম। লেখালেখি সম্পর্কে তাঁর অভিব্যক্তি- ‘লিখে ঠিক যেভাবে মনের ভাব প্রকাশ করা যায় অন্যত্র ঠিক সেভাবে সেটা সম্ভব নয়। এছাড়া লেখা থেকে যায়। হারিয়ে যায় না কখনো।’ তিনি বলেন, ‘জন্মদাত্রীর জন্যই নতুন করে আবার লেখালেখি শুরু করেছি। তাঁর অব্যাহত চাপের কারনেই নানা ব্যস্ততা সত্বেও প্রায় নিয়মতই এখন লিখতে হয় আমাকে। মায়ের ইচ্ছে অন্তত একটি হলেও যেনও বই বের হয় আমার।’

বিশ্বমঞ্চে মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিভাষ্য এবং প্রথম একক
বহিঃবিশ্বে গণহত্যা এবং একাত্তরে নারী নির্যাতন নিয়ে যেখানে নেতিবাচক প্রচারণা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা সেখানে এই অপপ্রচারের দাতভাঙ্গা জবাব দিতে উদ্যোগী হয়েছেন মুনিরা পারভীন। একাত্তরের বিভিষিকা তুলে ধরে তিনি এই মিথ্যচারের জবাব দিয়ে চলেছেন মাঠ পর্যায়ের গবেষণা উপস্থাপনের মাধ্যমে। যুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের এই অনন্যা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে আপোষহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, যে অনুষ্ঠানে একাধিক কবিতা পাঠ বা আবৃত্তির সুযোগ পাবেন সেখানে আবশ্যিকভাবে বীরাঙ্গনাদের বেদনাভাষ্য উপস্থাপন করবেন। কথার বরখেলাপ করেননি আজঅবদি। যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ এবং ‘বীরাঙ্গনা কথা’ গ্রন্থ থেকে পাঠ ও আবৃত্তি করে সংস্কৃতিপ্রিয় বাঙালী ব্রিটেনবাসীর মনে তৈরী করেছেন তারজন্য বিশেষ আসন। ২০১৮ সালে ২৫ মার্চ পূর্ব লন্ডনের শাহ কমিউনিটি সেন্টারে প্রথমবারের মতো মুনিরা পারভীনের পরিকল্পনা এবং নির্দেশনায় ছান্দসিক আয়োজন করে ‘মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিভাষ্য, বীরাঙ্গনা’ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানটি এতটাই সাড়া ফেলে যে এটি পুণরায় আয়োজন করতে হয়। দর্শক শুভানুধ্যায়িদের অনুরোধে মাত্র ১২ দিনের মাথায় কবি নজরুল সেন্টারে দর্শনীর বিনিময়ে ৮ এপ্রিল দ্বিতীয়বারের মতো উপস্থাপনা নিয়ে মঞ্চে আসতে হয় ছান্দসিক সদস্যদের। যা দৃষ্টি কাড়ে সবার। এরপর ভিন্নভাবে বীরাঙ্গনাদের আখ্যান উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন মুনিরা। তারই নাট্যরূপ এবং নির্দেশনায় সিজন অব বাংলা ড্রামায় Birangona The War Heroines – The Untold Story of 1971 নাটক মঞ্চস্থ করে ছান্দসিক। বীরাঙ্গনাদের চারটি আখ্যান দর্শকমাত্রেই অশ্রুসিক্ত করে। এ প্রসঙ্গে মুনিরার সরল অভিব্যক্তি-‘আমি স্বার্থক। সিজন অব বাংলা ড্রামায় তৃতীয় এবং চতুর্থ প্রজন্মের অনেকে নাটকটি দেখে চোখের জলে বুক ভাসিয়েছে। এবং টাওয়ার হ্যামলেটস কর্তৃপক্ষ বলেছেন এটি যদি আমরা পুণরায় উপস্থাপন করি তাহলে তারা হলের ব্যবস্থা করে দেবেন। এটা আমাদের জন্য একদিকে যেমন পরম পাওয়া তেমনই গৌরবের।’
এখানেই থেমে থাকেননি মুনিরা। বীরাঙ্গনাদের অশ্রুত আখ্যান পাঠ ও আবৃত্তি করতে ছুটে এসেছেন বাংলাদেশে। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর সিলেট কাজী নজরুল অডিটরিয়ামে শ্রুতির আয়োজনে ‘বীরাঙ্গনা কথা’ অনুষ্ঠানে হলভর্তি দর্শকদের কাঁদিয়েছেন তিনি। নিজেও কেঁদেছেন। জন্মভূমিতে প্রথম একক অনুষ্ঠান করে হয়েছেন গভীরভাবে আপ্লুত। সেইদিনের ফেসবুক স্ট্যাটাসে পাওয়া যায় তারই প্রমান। সিলেটে প্রথম একক অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে তাঁর ভাষ্য-, ‘সিলেট আমার প্রাণের শহর। এ শহরেই আমার জন্ম এবং বেড়ে উঠা। এখান থেকেই গ্রহন করেছি সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতার শিক্ষা। একজন বাচিক শিল্পী হিসেবে আমার যেটুকু অর্জন তার অভিযাত্রাও শুরু হয়েছিলো এই সবুজ ভূমি থেকে। মা-বাবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর গুরু হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের আপত্য স্নেহ-ই আমাকে আজকের আমি যতটুকু তাতে রূপান্তরিত করেছে। একজন আবৃত্তি শিল্পী হিসেবে প্রবাসে বাংলার কাব্যধারাকে বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপনের যে প্রয়াস দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে যাচ্ছি তার সূচনাও হয়েছিল সুরমা উপত্যকায়। যে অডিটরিয়ামের দ্বিতীয় তলায় বসে আবৃত্তি শিখেছি এবং একসময় শিশু একাডেমিতে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছি চিরচেনা সেই অডিটরিয়ামে আমার একক আবৃত্তি অনুষ্ঠান ‘বীরাঙ্গনা কথা’ উপস্থাপন ছিলো আমার কাছে অনেকটা স্বপ্নের মতো।’সত্যিই সেদিন স্বপ্নময়তায় অবগাহন করছিলেন মুনিরা। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনসহ প্রিয়জনদের সামনে প্রথম একক নিয়ে হাজির হয়েছিলেন জন্মশহরে। যা স্বপ্নের চেয়ে কম ছিল না কোনও অংশেই।
বীরাঙ্গনাদের সান্নিধ্যে
বীরাঙ্গনাদের বেদনাবহ আখ্যানগুলো পাঠ করতে করতে তাদের সাথে সাক্ষাতের জন্য আকুল হয়ে উঠে তাঁর প্রাণ। সিদ্ধান্ত নেন দেশে এলে অবশ্যই রণাঙ্গনাদের দেখতে যাবেন তিনি। যেই কথা সেই কাজ। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে দেশে এসেই উদ্যোগ নেন বীরাঙ্গনাদের সান্নিধ্যে যাওয়ার। বীরাঙ্গনা সন্ধ্যারাণী, প্রভারাণী এবং সাফিয়াকে দেখতে তিনি মৌলভীবাজার, কমলগঞ্জ এবং বড়লেখা ছুটে যান। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্বেও নিজ সিদ্ধান্তে অনঢ় থাকেন তিনি। বীরাঙ্গনাদের কাছে পেয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেন নি মুনিরা। তাদেরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারাও অশ্রুসিক্ত হন মুনিরার শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়। এ প্রসঙ্গে মুনিরার ভাষ্য-‘যতবারই বীরাঙ্গনাদের অগ্নিভাষ্য পাঠ করেছি ততবারই মনে হয়েছে, আমি যদি তাঁদেরকে জড়িয়ে ধরতে পারতাম। কাছে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারতাম, তাহলে স্বার্থক হতো জীবন। সিদ্ধান্ত নেই দেশে গেলে অবশ্যই যে ক’জন বীরাঙ্গনার সান্নিধ্যে যাওয়া সম্ভব, যাব। ধণ্য হবো তাদের স্পর্শে। গত বছরের জুলাই মাসে আসে সেই সুযোগ। বীরাঙ্গনা সন্ধারাণীকে স্পর্শ করার সাথে সাথে যেনও আমার সারা শরীর বিদ্যুতের মতো চমকে উঠেছিল। আবৃত্তি করতে করতে একাকার হয়ে যাওয়া চরিত্রের মানুষটির সংস্পর্শে এসে কি-যে অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছিল তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। সেদিন অনেকক্ষন জড়িয়ে ধরে রেখেছিলাম তাঁকে। তাঁর বেদনা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছিলাম হৃদয় দিয়ে। ছাড়তে ইচ্ছে করছিলনা সন্ধ্যারাণীকে। ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষিকে স্পর্শের অনুভূতি আজও আমাকে শিহরিত করে।’
আন্তর্জাতিক বাংলা আবৃত্তি উৎসব আয়োজন
অনেকেই স্বপ্ন দেখেন এবং দেখাতে পছন্দ করেন। তবে, সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পারেন না। এক্ষেত্রে মুনিরা ব্যতিক্রম। তিনি যেমন স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করেন তেমনই সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নে থাকেন বদ্ধপরিকর। আন্তর্জাতিক বাংলা আবৃত্তি উৎসব তেমনই তাঁর একটি লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন। অনেকটা একক প্রচেষ্ঠায় এই স্বপ্নকে স্বার্থকতা দিতে চলেছেন তিনি। বাংলাদেশের বাইরে লন্ডনে এ ধরনের আয়োজন এটাই প্রথম। বিলেতে অন্য অনেক অনুষ্ঠান এবং উৎসবের আয়োজন হলেও আবৃত্তি উৎসব এবারই প্রথম। দীর্ঘদিন ধরেই এ স্বপ্নটি তিনি লালন করছিলেন মনে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ছান্দসিকের সহযাত্রীদের নিয়ে বৈঠকে বসেন আবৃত্তি কণ্যা। প্রস্তাব করেন, এরকম একটি উৎসব আয়োজনের। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধানের মুখ থেকে এমন কথা শুনে এক বাক্যে সম্মত হন সদস্যরা। শুরু হয় কর্মপ্রবাহ। মুনিরার দক্ষ নেতৃত্বে আগামী ১ সেপ্টেম্বর পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বাংলা আবৃত্তি উৎসব। উৎসবে অংশ নেবেন বাংলাদেশ, ভারত, আমেরিকা, ফ্রান্স এবং কানাডার শীর্ষ স্থানীয় বাচিক শিল্পীরা। অংশ নেবেন বিলেতের প্রায় সব আবৃত্তি শিল্পী। উৎসব উদ্বোধন করবেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিষ্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী। বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আবৃত্তি শিল্পীদের একমঞ্চে নিয়ে আসার জন্যই এমন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন মুনিরা। যা একদিক থেকে যেমন সময় উপযোগি তেমনই অন্যদিক থেকে ঐতিহাসিক। দিনব্যাপি এ আয়োজনে ছন্দপ্রভা তিনি ছড়িয়ে দিতে চান বিশ্বপ্রাণে।
সাফল্যের সাতকাহন
স্বীয় কর্মের স্বীকৃতিও পেয়েছেন মুনিরা। যা তাঁর সাফল্যের পালককে করেছে স্বর্ণালি। বাংলাদেশে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে একাধিকবার জিতেছেন জাতীয় পুরস্কার। ১৯৯৭ সালে আবৃত্তিতে দেশ সেরা হন। লাভ করেন স্বর্ণপদক। আর ১৯৯৮ সালে সুন্দর হাতের লেখা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অর্জন করেন রৌপ্যপদক। এ দুটি পুরস্কারই তিনি গ্রহণ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। সুন্দর হাতের লেখা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার অর্জনের পর খ্যাতির বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাঁকে। এমসি কলেজের প্রতিটি দেয়ালিকা লিখে দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় তাঁর উপর। নাছোড়বান্ধা সহপাটিদের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারতে না তিনি। সঙ্গে যুক্ত হতো অধ্যক্ষের আবদার। মধুর জ্বালাতন সহ্য করে তাঁকে পালন করতে হয় সৃজনশীল এই দায়িত্ব। দেয়ালিকাগুলোকে নান্দনিক করতে তাঁর ঐকান্তিকতার কোনও কমতি ছিলনা। রাত জেগে দেয়ালিকার ক্যানভাসকে করতেন বহুবর্ণিল।
২০০২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রাণতরঙ্গ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন তিনি। এই প্রতিযোগিতায় আবৃত্তি, নাট্যাভিনয় ও গল্পবলা-এই তিনটি বিষয়ে দেশসেরা হন মুনিরা। ‘বাচিক কন্যার’ এমন কৃতিত্বের জন্য এমসি কলেজ এবং সিলেট পিটিআইয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মান জানানো হয়। আয়োজন করা হয় ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের। উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে আবৃত্তি, নাট্যাভিনয়, গল্পবলা এবং সুন্দর হাতের লেখা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করতে সক্ষম হন তিনি। যা তাঁর প্রাপ্তির খাতাকে করেছে ঋদ্ধ।
মুনিরার প্রথম আবৃত্তি সিডি ‘প্রভাত পাখির গান’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। পরবর্তী সময়ে আবৃত্তির আরও দুটি যৌথ সিডি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে ‘বীরাঙ্গনা কথা’ নামে আরও একটি আবৃত্তির সিডি। বর্তমানে টাওয়ার হ্যামলেটসে আপাসান্তের সিনিয়র কেয়ার কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মুনিরা। পারিবারিক জীবনে দুই সন্তানের স্নেহময়ী মা তিনি। ছেলে ইলহাম খন্দকার ও মেয়ে আফরা রহমান খন্দকারকে নিয়ে সুখের সংসার তাঁর। যোগ্য জীবনসঙ্গী হিসেবে তাঁকে প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছেন আরিফুর রহমান খন্দকার।
নির্ভরতার অন্য নাম
ব্রিটেনের সংস্কৃতি অঙনে নির্ভরতার সাথে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। সব বয়সের, শ্রেণী ও পেশার মানুষের কাছেই রয়েছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা। প্রবাসে যেখানে অনুষ্ঠান আয়োজন করলে দর্শক সমাগম নিয়ে মহাদুশ্চিন্তায় থাকতে হয় আয়োজকদের মুনিরা সেখানে ব্যতিক্রম। তাঁর প্রতিটি অনুষ্ঠানই হাউসফুল। শুধু হাইসফুল বললে ভুল হবে, তাঁর প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানেই স্থান সংকুলান হয় না। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় যেটি, বর্তমান সময়ে যেখানে মানুষের মধ্যে এক ধরনের সংস্কৃতি বিমুখতা প্রকট সেখানে মুনিরা পারভীনের আয়োজন মানুষ উপভোগ করেন টিকেটের বিনিময়ে। তখন বিস্মিত না হয়ে পারা যায়না। সর্বশেষ তাঁর জনপ্রিয়তার প্রমান পাওয়া যায় দোঁহে অনুষ্ঠানে। যে অনুষ্ঠানটি তাঁর অর্জনের খাতায় যুক্ত করেছে এক ভিন্নমাত্রা। লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে দর্শনীর বিনিময়ে ‘দোঁহে’ শিরোনামে কাব্যসন্ধ্যা আয়োজন করে এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেন তিনি। প্রমাণ করেছেন, সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চার পথ এখনো রুদ্ধ হয়ে যায়নি। যথাযথ উদ্যোগের মধ্যেই নিহিত রয়েছে এর বিকাশ। এ প্রসঙ্গে মুনিরার সাবলীল ভাষ্য, ‘উদ্দেশ্যের প্রতি যদি আপনি মহৎ থাকেন আর মর্মমূলে থাকে দেশাত্ববোধ তাহলে মানুষ আবশ্যই শেকড় সন্ধানী উদ্যোগের সহযাত্রী হবে। আমার আয়োজনের ক্ষেত্রেও তেমনটি হচ্ছে। এখানে আমার বিশেষ কোনও কৃতিত্ব নেই। আমি দেশকে ভালোবাসি। আর দেশকে ভালোবাসি বলেই মানুষও আমাকে ভালোবাসে।’
মুনিরায় মুগ্ধতা
মুনিরার আবৃত্তি শুনে মুগ্ধ হননি এমন শ্রোত বা কবিতা প্রেমি একজনও পাওয়া যাবে না। সংস্কৃতির যে শাখায়ই কাজ করছেন তিনি সেখানেই ছড়াচ্ছেন মুগ্ধতা। আবৃত্তিতে, উপস্থাপনায়, সংবাদপাঠে বাঙালিয়ানার ঐতিহ্য সমুন্নত করে চলেছেন তিনি। এ কথা দ্বিাধাহীনভাবেই বলা যায়, বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে প্রবাসে যে কজন বাঙালি অনন্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন মুনিরা পারভীন তাঁদের অন্যতম। বিগত দেড় দশক ধরে প্রবাসে বাংলার মুখ হয়ে শুধু আলোই ছড়াচ্ছেন না মুনিরা, তরুণ প্রজন্মকে শেকড় সন্ধানী হতেও করছেন উদ্বুদ্ধ। তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর হতে দিচ্ছেন সঠিক পথের দিশা। এর মাধ্যমে নিজেকেই শুধু অতিক্রম করে চলেছেন তিনি। আর ব্যক্তি থেকে পরিণত হতে চলেছেন ইনস্টিটিউশনে। ব্রিটেনের গণ্ডি পেরিয়ে তাঁর সৃজনশীলতার প্রভা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বময়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার বদৌলতে আবৃত্তিপ্রেমিরা অনেকটা এক নামেই চিনেন তাঁকে। এ প্রসঙ্গে মুনিরার সরল ভাষ্য-‘দেশ-মাতৃকার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়ে প্রবাসে কাজ করে যাচ্ছি। কারণ আমি প্রথমে বাঙালি, তারপর অন্যসব। তিনি বলেন, আমি সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা করে যেতে চাই সারা জীবন। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা হিসেবে বাংলা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবে, দেখি সেই স্বপ্ন। আশাকরি খুব বেশি দূরে নয় সেইদিন।’