পিতলের চাঁদ: মুক্তিযুদ্ধ ও বাস্তবতার অনন্য আখ্যান

আমাদের গর্ব করার মতো যে কয়টা অর্জন আছে মুক্তিযুদ্ধ তারমধ্যে অন্যতম। হাজার বছরের মহত্তম এই অর্জনকে নিয়ে তাই আমাদের আবেগের শেষ নেই। মুক্তিসংগ্রামকে নিয়ে আমাদের যেমন অহংকার অনেক, তেমনই শোকগাথাও কম নয়। একসাগর রক্তের নদী, সীমাহীন দুর্ভোগ, যাতনা, নির্যাতন, নারীর অমূল্য সম্পদ বিসর্জন-কতোনা বিরহকাতরতার আখ্যান লুকিয়ে আছে দীর্ঘ নয়মাসব্যাপি যুদ্ধের পরতে পরতে। বাংলাদেশের জন্মের, ইতিহাস তাই আমাদের কাছে অমূল্য সম্পদ। সেই ইতিহাসকে তুলে ধরতে স্বভাবতই আমাদের চেষ্টার কোনও কমতি নেই। নানা পন্থায় আমরা সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কবিরা কবিতায়, প্রাবন্ধিকরা প্রবন্ধে, গবেষকরা গবেষণায় আর কথাসাহিত্যিকরা গল্প-উপন্যাসে যুদ্ধের নানাদিক লিপিবদ্ধ করে চলেছেন আবেগ ভালোবাসায়। সাম্প্রতিক সময়ে অন্য যে কোনও সময়ের চেয়ে দেশে তুলনামুলকভাবে মুক্তিযুদ্ধ চর্চার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলের সরকারে থাকা, চারদশক পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়াসহ প্রাসঙ্গিক নানা কারন এ চর্চাকে বেগবান করেছে। সেই প্রচেষ্টারই একটি অংশ ‘বেহুলা বাংলা’র একাত্তরের উপন্যাস সিরিজ। গত এক বছরে এই সিরিজের অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে। এরমধ্যে ‘পিতলের চাঁদ’ অন্যতম। কথাসাহিত্যিক ঝর্না রহমানের অনবদ্য এই নিবেদনকে মুক্তিযুদ্ধের কথাসাহিত্যে এক অনন্য সংযোজনও বলা যায়। একজন তরুনের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন, যুদ্ধ শেষে তাঁর যাপিত জীবনের আখ্যানকে আবর্তিত করেই নির্মান করা হয়েছে এই উপন্যাসের পটভূমি। সাধারণের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকেই যেন লেখিকা নির্নিত করার চেষ্টা চালিয়েছেন সুদীর্ঘ কথামালায়।  

    ‘পিতলের চাঁদ’ নিয়ে আলোচনার শুরুতেই লেখক সম্পর্কে সম্যক আলোকপাত করতে চাই। পেশায় শিক্ষক ঝর্না রহমানকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার খুব বেশি প্রয়োজন নেই। কারন ইতোমধ্যেই তিনি স্বনামে খ্যাতি অর্জন করেছেন। লিখেছেন কবিতা, ভ্রমণসাহিত্য, শিশুসাহিত্য, নাটক, গল্প, উপন্যাস সব মিলিয়ে ৩৫টি বই। কিন্তু ঝর্না রহমানের যে দিকটি আমাদের সহজেই আকৃষ্ট করে তা হচ্ছে তাঁর লেখায় দেশাত্ববোধ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। ইতিহাস বিকৃতিকে তিনি ঘৃণা করেন। তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘পিতলের চাঁদ।’ গল্পকথায় মুক্তিসংগ্রামের সঠিক ইতিহাস আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে তাঁর এই প্রয়াস শুধুমাত্র ঐতিহাসিক বার্তাই দিচ্ছে না, পঁচাত্তর পরবর্তী বিকৃতিকেও যেনো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে? এখানেই একজন লেখক হিসেবে ঝর্না রহমানের অনন্যতা।

ঝর্ণা রহমান

মূল প্রসঙ্গে আসতে চাই। ‘পিতলের চাঁদ’ উপন্যাসটি একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবন আখ্যান। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ইব্রাহিমপুরের অকুতভয় আবু তাহেরের যুদ্ধে যাওয়া, ফিরে আসা-এ সবই বিবৃত হয়েছে উপন্যপাসের পাতায় পাতায়। তবে, তাঁর যুদ্ধযাত্রাটা ছিল একটু ব্যতিক্রমী। অনেক দামাল ছেলে স্ব-ইচ্ছায় কিংবা মায়ের ইচ্ছায় যুদ্ধে গেলেও তাহেরের ক্ষেত্রে ছিল তার উল্টো। ব্রিটিশ আমলের সৈনিক পিতা তালেব হোসেনের ইচ্ছায় যুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনি। পরিবার-পরিজনকে ছেড়ে ভারতে পারি জমাতে প্রথমে মন সায় দেয়নি তার। কিন্তু পিতৃ আজ্ঞা পালন এবং সময়ের প্রয়োজনে সে পথে পা বাড়াতে হয় তাঁকে। ভারতযাত্রার প্রাক্কালে তালেব হোসেন ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন ‘ডরাইস না। বুদ্ধি কইরা চলিস। সাবধানে থাকিস। পারলে যুদ্ধ কইরা দ্যাশ স্বাধীন করিস। শ্যাখ মজিবরে স্বাধীনতার ডাক দিছে। মনে রাখিস, তুই হইলি গিয়া সৈনিকের ব্যাটা। সৈনিকের ব্যাটা যদি যুদ্ধ না করে তাহলে শ্যাখ সাবে দ্যাশ স্বাধীন করবো কাদের লইয়া।’

পিতৃ আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন আবু তাহের। যুদ্ধের ময়দানে পিছপা হননি কখনো। যখনই যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা পালন করেছেন যথাযথভাবে। গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের কথা যখনই কানে আসতো যুদ্ধ জয়ের নেশা তখন আরও শানিত হতো। সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিতেন আরও বেশি তীব্রতায়। 

আবু তাহের যে ক’টি অপারেশনে অংশ নিয়েছেন তার প্রত্যেকটিতেই এসেছে সফলতা। বিজয় ছিনিয়ে আনার এসব যুদ্ধে বেশ কয়েকজন সহযোদ্ধাকে হারিয়েছেন তিনি। তাদের অমূল্য প্রাণ উৎসর্গিত হয়েছে স্বাধীনতার বেদীমূলে। শোককে শক্তিতে পরিণত করে লড়াই চালিয়ে গেছেন বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত। ফিরে এসেছেন বিজয়ীর বেশে। যুদ্ধজয়ী আবু তাহেরের ফিরে আসার বর্ননাটা দিয়েছেন লেখিকা বেশ নান্দনিক-‘আনন্দ দোলায় দুলেছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহেরের হাতের পতাকা।…আবু তাহের তরতর করে উঠে গিয়েছিলেন বাড়ির পেছনের লম্বা তালগাছের মাথায়। মুলিবাঁশের মাথায় সেই পতাকা বেঁধে দিয়ে গ্রামবাসীদের নিয়ে সৈনিক স্যালুট দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলার পতাকাকে। অদ্ভুত অনুভূতিতে দুলে উঠেছিল বুকের ভেতরটা। গৌরবের আনন্দে চোখে পানি চিকচিক করে উঠেছিল আবু তাহেরের।’ সে আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো গ্রামে। শুধু আবু তাহেরদের গ্রামেই নয়, সবখানেই ছিল আনন্দের জোয়ার। বাংলার আকাশ বাতাসে সেদিন ছিল শুধুই ‘জয়বাংলা’র প্রতিধ্বনি। তবে স্বাধীন দেশে যুদ্ধ জয়ের আনন্দে বেশিদিন আত্মহারা থাকতে পারেন নি আবু তাহের। জীবনযুদ্ধে অবতীর্ন হতে হয় তাকে। পিতার সঙ্গে হাল গেরস্থির পাশাপাশি বাজারে মনোহরি দোকান দেন তিনি। এক পর্যায়ে বিয়ে করেন। যদিও মা সাফিয়া খাতুনের ইচ্ছে ছিল খালাতো বোন সেলিনাকে পুত্রবধূ করে আনার। কিন্তু বিধবাকে পুত্রবধূ করে আনতে তাহেরের পিতা তালেব হোসেন সম্মত ছিলেন না। তবে, সেলিনাকে তাহেরের ভালো লাগতো। কিন্তু বিয়ের ছয়মাসের মাথায় বৈধব্য গ্রহন করা খালাতো বোনকে জীবন সঙ্গী করা সম্ভব হয়নি পরিবেশ পরিস্থিতির কারনে। সময় গড়িয়ে যায়। রাজধানীর স্কাইহোম অ্যাপার্টম্যান্টে সিকিউরিটি গার্ডের চাকুরি নেন তাহের। সংসারে আসে ৩ ছেলে ১ মেয়ে। এপার্টম্যান্টের এক নিঃসঙ্গ মহিলার আত্মহত্যা এবং পরবর্তী পরিস্থিতি এই চাকুরির প্রতি অনাগ্রহি করে তুলে তাহেরকে। শেষমেশ চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে গায়ে ফিরে শুরু করেন হালচাষ। মামাতভাই জাহেদুলের কথায় ইকরা মডেল কলেজে দরখাস্ত করলে কলেজের সিকিউরিটি গার্ডের চাকুরি জুটে যায় তাহেরের। জাহেদুল বলেছিলেন, ‘এখন দেশে মুক্তিযুদ্ধের সরকার। আপনার মর্ম বুঝবে।’ সে আশায়-ই পুণরায় শহর জীবনকে বেছে নেন তাহের। কলেজ মাঠে পত পত করে ওড়া পতাকাকে স্যালুট দিয়ে শুরু হয় তার নতুন করে পথচলা।

একজন মুক্তিযোদ্ধার দেশের প্রতি, স্বাধীনতার প্রতি, মানচিত্রের প্রতি, বিশেষ করে পতাকার প্রতি যে শ্রদ্ধা, অনুরাগ, ভালোবাসা তার অনুপঙ্ক বর্ননা আমরা প্রত্যক্ষ করি ঝর্না রহমানের বর্ননায়। আবু তাহেরের পেশাগত জীবনের চিত্র তুলে ধরে, তিনি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চতুর্থশ্রেণীর কর্মাচারী সেই প্রতিষ্ঠানের পতাকার প্রতি তার ভালোলাগার বিষয়টি উপন্যাসে এমনভাবে তুলে ধরেছেন, যা এক কথায় অনন্য। এরমাধ্যমে শুধু পতাকার প্রতি একজন মুক্তিযোদ্ধার সম্মান প্রদর্শনই উঠে আসেনি, তুলে ধরা হয়েছে এত আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত পতাকাকে কিভাবে সম্মান প্রদর্শন করতে হয় তা। লেখিকার ভাষ্য থেকে উদৃত করলে তা উপলব্ধি করা যাবে সহজেই।  ‘… সেদিন থেকে তিনি যেন পতাকার পাহারাদার। এই পতাকা যেন তার কর্মস্থলের নিয়ত সঙ্গী। চোখে চোখে রাখার উড্ডীন স্বপ্ন। মাঝে মাঝে রোদে পুড়ে জলে ভিজে পতাকার রং জ্বলে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ভালো লাগে না তখন। ফ্যাকাশে পতাকার জন্য গোটা আকাশই ম্যাদাম্যাদা লাগে।

     আবু তাহের স্পোর্টস টিচার আহমদুল্লাহ স্যারকে মনে করিয়ে দেন, ‘স্যার পতাকা কিনতে হবে। জাতীয় পতাকার রং জ্বলে গেলে হবে না। রং থাকতে হবে টকটকা।

     আহমদল্লাহ স্যার নতুন পতাকা এনে লাগিয়ে দিয়ে আবু তাহেরকে বলেন, ‘তাহের ভাই, ওই যে আপনার পতাকা। নতুন। ঝকঝকে।’ আবু তাহেরের পানের রসমাখা কালশিটে পড়া লালচে দাঁতের সারিতে দুর্দান্ত একটা হাসি মাথা ঝাকিয়ে ওঠে। ‘পতাকা আমাদের সবার, বাদ যাবে রাজাকার!’-এমন দৃপ্ত উচ্চারণে এগিয়ে যায় উপন্যাসের কাহিনী। আবশ্যিকভাবে উঠে এসেছে দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যুদ্ধ পরবর্তী বদলে যাওয়া বাংলাদেশের চিত্র। বিশেষ করে পচাত্তারের পনের আগস্ট জাতীর জনককে স্বপরিবারের হত্যার বিষয়টি ক্ষত-বিক্ষত করে আবু তাহেরকে। পনের আগস্ট নিয়ে আবু তাহেরের সত্যকথন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় দুঃসহ সেই সময়ে। যুদ্ধপরবর্তী দেশ পুনর্গঠনকালে পচাত্তরের সেই বিভীষিকাময় রাতের কথা আমাদের মানসপটে ভেসে উঠে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিকে হত্যা এবং পরবর্তী পরিস্থিতি, মহুর্তে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের চিত্র ফুটে উঠেছে উপন্যাসিকের ভাষ্যে।

    ‘পচাত্তরের পর থেকে জাতীয় জীবনে তাহের এই দিবসটির কত রকম মুখ যে দেখেছেন, তা ভাবলে তার বড় খারাপ লাগে। এমনও সময় গেছে যখন শোকাবহ এই দিনটিকে পালন করা দূরের কথা, লোকে শেক সাহেবের নাম নিতেও ডরাইত। কে জানে কে কোনদিক দিয়ে শুনে ফেলে! তারপর তার ওপর কোনদিক দিয়ে কীভাবে জুলুম শুরু হয়ে যাবে বলা যাবে না। কিন্তু আবু তাহের ভয়-ডর পাত্তা দিতেন না। ধার ধারতেন না ফিসফিসানির। স্কাইহোমের দারোয়ান ইসমাইলের সঙ্গে ইচ্ছা করেই জোর গলায় গল্প করতেন। গেটের বাইরে থেকে তার গলার গমগমে আওয়াজ শোনা যেত।’…বাঘের বাচ্চা বঙ্গবন্ধুরে কতগুলা শিয়ালে খুন কইরা ফালাইল! কুচক্রী শিয়াল। মুরগাখোর! …বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি দেইখা যেন আমি মরতে পারি!’

     একজন মুক্তিযোদ্ধা, যার আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন, সেই মহানায়কের মৃত্যুকে তিনি মেনে নিতে পারেন না। তাঁর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। এই ক্ষরণ কি শুধু আবু তাহেরের? নিশ্চয় নয়। এ ক্ষরণ ছিল প্রত্যেক দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার। এ ক্ষরণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল লেখকের। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের ঠিক যেভাবে প্রতিবাদ করার কথা ছিল কালির আঁচরে তা তারা করতে পারেন নি। নিষ্টুর সময় কি তাদের চেপে ধরেছিল? হয়তো, তবে সবাই নির্বাক থাকেন নি! কেউ কেউ সরব হয়েছিলেন। যদিও তাদের সংখ্যা ছিল একেবারেই হাতেগুনা। তবে, সময় এখন বদলে গেছে। স্বাধীনতা বিরোধীদের সেই দাপট আজ আর নেই। যুদ্ধপরাধীদের বিচার হয়েছে। কার্যকর করা হয়েছে রায়। অবধারিতভাবেই উপন্যাসে উঠে এসেছে এসব প্রসঙ্গ। বাস্তব আখ্যানই যে বিবৃত হয়েছে ১১২ পৃষ্ঠার উপন্যাস জুড়ে সেটা উপলব্ধি করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হবেনা কোনও পাঠকেরই। আবু তাহেরকে দিয়েই লেখিকা দেখিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ ও বিগত চৌচাল্লিশ বছরের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের সাথে সাথে উঠে এসেছে একজন সৎ নির্লোভ মুক্তিযোদ্ধার জীবনের করুণ আখ্যান।

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহেরের খুব বেশি প্রত্যাশা ছিল না। আর দশটা মানুষের মতোই স্বাভাবিক জীবন চেয়েছিলেন তিনি। টানাপোড়নের মধ্যেও দিন কেটে যাচ্ছিল বেশ। ‘সিকিউরিটি গার্ডের’ ইউনিফর্মের আড়ালে যেনো ঢাকা পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহনের গৌরবগাথা। যেহেতু চাকুরিটা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা কৌটায় তাই শিক্ষকদের প্রায় সবাই অবগত ছিলেন তাঁর সম্পর্কে। কলেজের সহকারী অধ্যাপক সাজেদুল ইসলাম আগ্রহ নিয়েই জানতে চান আবু তাহেরের যুদ্ধদিনের কথা। তার ইচ্ছে, কলেজ বার্ষিকীতে আবু তাহেরের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যে আবু তাহের কখনো বিশেষ কোনও প্রচার চাননি তিনিই শিক্ষকের এমন আগ্রহে অন্যরকম স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। গর্বে তাঁর বুকটা ভরে উঠে। ভাবতে থাকেন, ইন্টারভিউ ছাপা হলে ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে মান্য করবে যুদ্ধজয়ী সৈনিক হিসেবে। এনিয়ে একধরনের আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন তাহের। সাজেদুল ইসলাম যেদিন আবু তাহেরের মুখোমুখি হলেন বেশ জমে উঠেছিল কথোপকথন। কিন্তু বিপত্তি দেখা গেলো একটি প্রশ্নের উত্তরে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এক পাঞ্জাবী সৈনিকের জীবন বাঁচিয়েছেন একথা ছন্দপতন ঘটায় সাজেদুল ইসলামের আগ্রহে। যুদ্ধের কৌশল হিসেবে আবু তাহের ও তার দলের সদস্যরা এমনটি করেছিলেন এবং যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তাদের দলের হাতেই প্রাণ দিতে হয়েছিল ঐ পাঞ্জাবী সৈনিককে- আবু তাহেরের এ বক্তব্যে শংসয় তৈরি হয় সহকারী অধ্যাপকের মনে। আবু তাহের সেটি উপলব্ধি করতে পারেন নি। আশায় ছিলেন ম্যাগাজিন ছাপা হলে তাতে থাকবে তার সাক্ষাৎকার। কিন্তু যেদিন কলেজ বার্ষিকী বের হল দুরুদুরু বুকে সেটি উল্টে দেখেন তার সম্পর্কে একটি অক্ষরও নেই কোথাও। অমানিশার কালো আধারে আচ্ছাদিত হয় আবু তাহেরের মুখ। ম্যাগাজিনটি হাতে নিয়ে তিনি অগ্রসর হন শিক্ষক মিলনায়তনের দিকে। অন্য শিক্ষকদের সাথে সাজেদুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। আবু তাহের তার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। সাজেদুল ইসলাম আবু তাহেরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন ‘কিছু বলবেন তাহের ভাই?’ আবু তাহেরের সব গুলিয়ে যায়। এতজন শিক্ষকের সামনে নিজেকে কেমন অসহায় লাগে।…আবু তাহেরের চোখ ফেটে জল আসতে চায়। কোনমতে সাজেদ স্যারকে বলেন, ‘স্যার আমার কথাগুলো আপনি লেইখা নিলেনে, বললেন…’ গলা বুজে আসে তাহেরের। বলতে পারেন না।’ একটু উত্তেজিত হয়েই উত্তর দেন সাজেদ স্যার। ‘হ্যা নিয়েছিলাম। তো কি হয়েছে! লেখাগুলো তো ফেলে দিইনি! আছে।… ‘কিন্তু স্যার, আমি তো জানতাম না। সবাইকে বলা হইয়া গেছিল…। ‘এখন আবার বলে দেন, আপনার কাহিনী ছাপা হয়নি। তা ছাড়া আপনার কাহিনীতে গলদ আছে। ওটা ছাপা যেত না। আপনি মুক্তিযোদ্ধা আছেন ভালো আছেন, রাজাকার পরিচয় হলে কি ভালো হবে?…

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা উঠায় তাতে শামিল হন ভিন্নপন্থী শিক্ষক রহমত। সাজেদুল ইসলামের সাথে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তর্ক শুরু হয় তার। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করেন রহমত। মাথায় যেনো আগুন ধরে যায় আবু তাহেরের। সকলেরর সামনেই উচ্চস্বরে বলে উঠে-‘স্যার, আপনারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাজে কথা বলবেন না। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছি। বঙ্গবন্ধু না থাকলে এ দেশ স্বাধীন হইত না স্যার। সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক না দিলে এই দেশের মানুষ লড়াইয়ে নামত না। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে মুক্তিযুদ্ধ হইত না। বঙ্গবন্ধুরে বাজে কথা বললে স্যার আমার রক্ত গরম হইয়া ওঠে স্যার।’ এ কথা বলার সাথে সাথে রহমত ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে আবু তাহেরকে বের করে দেন। শিক্ষকদের সাথে ‘খারাপ’ আচরণের জন্য তাকে শোকজ করা হয়। এছাড়া বার্ষিক ম্যাগাজিন নিয়ে এখতিয়ারের বাইরে আগ্রহ দেখানোয় সিকিউরিটি গার্ড থেকে ডিমোশন দিয়ে ছয় মাসের জন্য আবু তাহেরকে দেওয়া হয় সুইপারের দায়িত্ব। এই অবনমন সত্যিই বেদনার। একজন মুক্তিযোদ্ধা, যার হাতে একাত্তরে ছিল হাতিয়ার তাঁর হাতেই কিনা বিদ্যা শিক্ষার প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা ধরিয়ে দিলেন ময়লা পরিস্কারের ঝাড়–। এ বিষয়টিই ‘চোখে আঙুল দিয়ে’ দেখিয়ে দেয়, আমাদের মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চিত্র। সত্যিই কি বিচিত্র আমাদের সমাজ!    উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আবু তাহের বোধহীন মানুষে পরিনত হন। যে তাহের যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন অসীম সাহসী তিনিই যেনো জীবন যুদ্ধে হয়ে পড়েন দিশাহীন। বেদনাগাথায় আচ্ছন্ন হৃদয় আরও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে বড় ছেলের দুর্ঘটনার খবরে। এক্সিডেন্টের কারনে অটোরিকশা চালক ছেলে ফজলের একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে। বখাটেদের পাল্লায় পড়ে ছোট ছেলে বাসেতের ঠাই হয়েছে জেলে। সব মিলিয়ে অমানিশার ঘোর অন্ধকার যেনো গ্রাস করে তাহেরকে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সহকর্মী মতিউরের পরামর্শে কলেজে সাহায্য চেয়ে আবেদন করেন। তাতে কোন লাভ হয় না। সর্বশেষ  ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে গ্রামের বাড়ির একমাত্র ধানী জমি বিক্রির বদলে ২০ বছরের লীজ দেন এক লাখ টাকায়। কৌশলে সেটি করায়ত্ব করেন স্থানীয় চেয়ারম্যান।

    এ সবই আমাদের সমাজবাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। তাহেরের মত মানুষরা বড় অসহায়। অথচ একটি শ্রেণি গড়ে উঠেছে যারা আখের গোছাতে ব্যস্ত। যে যেভাবে পারছে ফায়দা লুটছে। আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে কেউ কেউ। অথচ যাদের নূন আনতে পান্থা ফোরায়, যারা স্বপ্ন দেখা ভুলে গেছে তাদের কোনও পরিবর্তন হয় না। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে যে আবু তাহের দেশ মাতৃকার জন্য যুদ্ধের ময়দানে শত্রু নিধনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন তিনি ভুলে যান স্বপ্ন দেখতে। আরও বেশি অবাক হই, এই অবনমনকে যখন নিয়তি বলেই মেনে নেন যুদ্ধ জয়ী এই সৈনিক। মনে হয়, প্রতিবাদের চেয়ে চাকুরিটাই তাঁর কাছে বড়। কারন এই চাকুরিটা যদি না থাকে তাহলে গ্রামের বাড়িতে মাস শেষে টাকা পাঠানো যাবেনা। কী করে চলবে সংসার?

তখন তাহেরকে মনে হয় ‘জীবন যুদ্ধে পরাজিত এক মানুষ।’ এত দুর্বিসহ পরিস্থিতিতেও কর্তব্য পালনে তাঁর বিচ্যুতি ঘটেনা। নিষ্ঠার সাথেই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ যেন একজন মুক্তিযোদ্ধার ধর্য্যরে পরীক্ষা। সাজেদুল ইসালামের প্রচেষ্ঠায় দ্বিতীয় দফায় মাত্র বিশ হাজার টাকার আশায় পুণরায় কলেজ কতৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন আবু তাহের। অধ্যক্ষ তাহেরকে অকপটে বলেন, আপনার পেছনে লোক লাগানো ছিল। আপনি খুবই ‘ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট’। এ কথাটা যেনো বড্ডবেশি কানে বাজে। যারা পুকুর চুরি করে তাদের পেছনে কি কাউকে নিযুক্ত করা হয় দেশে, অথচ একজন মুক্তিযোদ্ধা, যার শাস্তি হয়েছে ‘বিনা কারনে’ তিনি সুইপারের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন কিনা তা দেখার জন্য তার পেছনে লোক লাগানো হয়েছে, সব সম্ভবের এই দেশের চিত্রই তখন ভেসে উঠে আমাদের সামনে। 

উপন্যাসে না বলে অনেক কথা বলেছেন ঝর্না রহমান। অনেক ক্ষেত্রে তার অব্যক্ত কথাকেই মনে হয়েছে অনেক অনেক শক্তিশালী। এখানেই বোধহয় তার সফলতা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনেকগুলো প্রশ্নের উদ্রেক হয়, কিন্তু সে প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে যেন সেই উত্তর খুজতে আমাদের প্রলুব্ধ করেন ঝর্না রহমান। 

মোটাদাগে দেখলে উপন্যাসটিকে মনে হবে সাদামাটা। কিন্তু এই সহজ-সরল আখ্যানের মাঝে কত কত সত্যকথা তুলে ধরেছেন লেখিকা, তার হিসেব করা মুশকিল! একজন আবু তাহেরকে দিয়ে লেখিকা দেখিয়েছেন আমাদের প্রবহমান সময়ের চিত্র। স্বাধীনতার পর পয়তাল্লিশ বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও আমরা কতটুকুই বা এগিয়েছি? একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনায় আমাদের উদ্দীপিত হওয়ার কথা ছিল, যে সাম্য সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠার কথা ছিল সমাজে, তা কি হয়েছে? বৈষম্য কি কমেছে? বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? যে স্বপ্নে বিভোর হয়ে একাত্তরের যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন আবু তাহেরের মত বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা তাদের প্রত্যাশা কি পুরণ হয়েছে? আমার মনে হয়, এইযে জিজ্ঞাসা, পাঠকের মনে তা উত্থাপিত করে প্রকৃত কথাসাহিত্যিকের দায়িত্বই পালন করেছেন ঝর্না রহমান। এখানেই তার স্বার্থকতা। যা সত্যিই প্রশংসনীয়। তিনি কালকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। যে চেষ্টা সাম্প্রতিককালের উপন্যাসে খুব একটা দেখা যায় না।