মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত তখনও শোকায়নি। দেয়ালে দেয়ালে লেগে আছে রক্তের দাগ! সদ্য স্বাধীন দেশ-বাংলাদেশের জন্মসংগ্রামের ইতিহাসকে নিয়ে সাহিত্য রচনা একদিকে যেমন সহজ অন্যদিকে তেমনই কঠিন! কঠিন একারনেই, মানুষের কোমল অনূভূতিগুলো তখনো ছিলো একেবারেই সতেজ! দুঃসহ সেই সময়কে আবর্তিত করে যে ক’জন কথাসাহিত্যিক কলম ধরতে কুন্ঠাবোধ করেন নি সৈয়দ শামসুল হক তাদের মধ্যে অন্যতম। সময়ের ব্যবধানে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী তিনি একে একে চারটি উপন্যাস বিনির্মান করেন। স্বাধীনতার ইতিহাস সাহিত্যের ক্যানভাসে ধরে রাখার তাঁর এই প্রয়াস ভিন্নমাত্রা সংযোজন করেছে আমাদের কথাসাহিত্যে। তাঁর লেখা বহুল আলোচিত উপন্যাস নিষিদ্ধ লোবান পড়েননি এমন দেশপ্রেমি সাহিত্যিক খুব কমই পাওয়া যাবে। তবে নিষিদ্ধ লোবান এতটাই আলোচিত হয়েছে যে, এর শব্দপ্রভায় অন্য তিনটি উপন্যাস যেন একটু আড়ালেই চলে গেছে! কিন্তু আবডালে যায়নি! তাই, কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এলে অনেকটা অবধারিতভাবেই আসে বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ, নীল দংশন এবং দ্বিতীয় দিনের কাহিনীর কথা। বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ এবং নীল দংশন যুদ্ধজীবনের আখ্যানকে আবর্তিত করে রচিত হলেও মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের কথায় নির্মিত হয়েছে দ্বিতীয় দিনের কাহিনী (১৯৮৪)। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের চিত্র এ উপন্যাসে লেখক এমনভাবে তুলে ধরেছেন যাকে আমরা এক কথায় বলতে পারি, অনন্য। দ্বিতীয় দিনের কাহিনীর পরতে পরতে বাস্তবতাকে সৈয়দ হক ঠিক যেভাবে বিবৃত করেছেন তা আমাদের চেতনবিশ্বকেই শুধু আন্দোলিত করে না, একাত্তর ও একাত্তর পরবর্তী সেইসময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেও সাহায্য করে। এখানেই প্রতিভাত হয় সৈয়দ শামসুল হকের শব্দদক্ষতা! যা আমাদেরকে দাঁড় করায় যুদ্ধত্তোর এক ভিন্ন ইতিহাসের মুখোমুখি!

একাত্তরে পাকিদের পরাজয়ের মধ্যদিয়ে, আত্মসমর্পনের মধ্যদিয়ে, বাঙালি যে বিজয়গাঁথা রচনা করেছিলো লাল সবুজের পতাকা অর্জন করে, মানচিত্র অর্জন করে-সেই অর্জন এবং অর্জন পরবর্তী সামাজিক, পরিবেশ পরিস্থিতিই সৈয়দ শামসুল হক বর্ননা করেছেন দ্বিতীয় দিনের কাহিনীতে। সীমান্তবর্তী গ্রাম জলেশ্বরীকে আবর্তিত করে লেখক বিন্যস্ত করেছেন কাহিনীর শাখা-প্রশাখা। শেকড় থেকে শিখরে আবার শিখর থেকে শেকড়ে আসার তাগিদ, প্রয়াস, প্রচেষ্টা তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন উপন্যাসে। অপ্রত্যাশিত সময় বা ঘটনা মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, কেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে-সেটাই লেখক সুনিপুনভাবে উপস্থাপন করেছেন আলোচ্য উপন্যাসে। আর সেটা তিনি করেছেন মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, নির্মানশৈলীর অভিনবত্বে মুক্তিযুদ্ধোত্তর যে কয়টি উপন্যাস অসাধারনত্বের তিলক পড়েছে তারমধ্যে দ্বিতীয় দিনের কাহিনী অনেকখানি এগিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের অনেক উপন্যাসেই আমরা প্রেম-বিরহের আখ্যান প্রত্যক্ষ করি। বিশেষত মায়ের প্রতীক্ষা, বিলাপ, রাজাকারদের আস্ফালন, লড়াই, জয়-পরাজয়-অবধারিতভাবেই আসে যুদ্ধউপন্যাসে। তবে দ্বিতীয় দিনের কাহিনীতে সে পথে অগ্রসর হননি সৈয়দ শামসুল হক। ব্যতিক্রমী পন্থা অবলম্বন করে উপন্যাসের কাহিনীকে তিনি এমনভাবে বিন্যস্ত করেছেন, যা আমাদের পাঠের আগ্রহই শুধু বৃদ্ধি করে না অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখোমুখিও দাঁড় করায়! যুদ্ধ পরবর্তী মাত্র দুটি দিনের কাহিনী বর্ননা করতে গিয়ে লেখক অনেক অনেক দিনকেই তুলে ধরেছেন। আর সেটা করেছেন তিনি শিক্ষক তাহেরউদ্দিন খন্দকারের আত্মকথন কিংবা স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে। পেশায় শিক্ষক তাহের উদ্দিনের জলেশ্বরী যাত্রায় শুরু হয় উপন্যাসের কাহিনী।
স্তব্ধতা আবার তার অলৌকিক ফলের মতো ক্লান্তি ফিরে পায়; রাত গভীরতর হয়; স্তব্ধতা পূর্ণতর। তাহের তার গন্তব্য জলেশ্বরীতে এসে পৌঁছোয়। মুমূর্ষু ব্যক্তির মতো রেলগাড়ি সংক্ষিপ্ত একটি আর্তধ্বনি তুলে নিস্পন্দ হয়ে যায়; এরপর আর কোন ইস্টিশান নেই; এখান থেকে গাড়ি আবার উল্টোদিকে যাত্রা করবে। মাঝখানে ঘন্টাখানেকের বিরতি, অতএব প্লাটফরমে যাত্রীদের উৎকন্ঠিত কোন ব্যস্ততা নেই। গন্তব্যে যে পৌঁছোয় কেবল সে ছাড়া আর সকলেই এখন নিঃশব্দে ক্রমশ অন্ধকারে বিলীন হয়ে যায়।
জলেশ্বরী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের চাকুরি নিয়ে ঢাকা থেকে গ্রামে পৌছে এক ভিন্ন আবহের মুখোমুখি হন তাহের উদ্দিন। সাবরেজিষ্টার পিতার সন্তান তাহেরের জন্ম এই জলেশ্বরীতেই। শৈশবটা এখানেই কেটেছে তার। কিন্তু বেড়ে উঠা থেকে শুরু করে, সব কিছুই ঢাকাতে। জন্মস্থানের প্রতি বিশেষ দূর্বলতা এবং দেশের জন্য কিছু করার তাগিদ থেকেই তার গ্রামে আসা। কিন্তু জলেশ্বরীতে পৌছে প্রথমেই অদ্ভুত এক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয় তাকে। মুক্তিযোদ্ধা মজাহারের দলের সদস্যরা তাকে বিহারী ভেবে অনুসরন করতে থাকে। মজাহারের দলের কাছে বিহারীরা শুধু জলেশ্বরীরই নয়, তারা দেশের শত্রু, বাঙালিদের শত্রু; তাদের কারনে অনেক সূর্য সন্তানকে হারাতে হয়েছে, তাই তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে। খতম করতে হবে চিরদিনের জন্য। স্টেশনে নামার পর থেকে চা স্টল অবধি তারা তাহেরকে অনুসরন করে। এক পর্যায়ে মজাহার পিস্তল বের করে তাকে আটক করতে উদ্যোত হয়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তাহের নিজের পরিচয় দেন এবং জলেশ্বরীতে আসার কারন ব্যাখ্যা করেন। তাতে নিবৃত হয় তারা। মজাহার ওরফে ক্যাপ্টেন আগে থেকেই জানতেন ঢাকা থেকে একজন শিক্ষক আসছেন স্কুল চালু করার জন্য। তাই ভয়াবহ কোনো পরিস্থিতিতে পরতে হয়নি তাহেরকে। তাৎক্ষনিক এক ধরনের সখ্যতা গড়ে উঠে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে। তার সাথে কথা বলে একটি ভাত খাওয়ার হোটেলে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন তাহের। যদিও ক্যাপ্টেন সম্ভ্রান্ত কারো বাড়িতে তার থাকার ব্যবস্থা করে দিতে চায়, তাতে আপত্তি করেন তিনি। অগত্যা তাকে নিয়ে ক্যাপ্টেন রওয়ানা হয় হোটেল অভিমুখে। লেখকের ভাষ্যে সেই রাতের বর্ননা-
জলেশ্বরীর পথে পথে রাত্রির সূচীভেদ্য অন্ধকারের ভেতরে ক্যাপ্টেন হেটে চলেছে; শহীদ বরকতউল্লাহ রোড দিয়ে, শহীদ আনোয়ার হোসেন রোড পেরিয়ে, শহীদ গেদু মিয়া লেনের ভেতর দিয়ে, চাদবিবির পুকুরের পাশ দিয়ে, শহীদ সিরাজ আলী রোডের ওপর দিয়ে, আরও সমস্ত শহীদের নামাংকিত পথ পেরিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে ক্যাপ্টেন। জীবিত সে, একা, বার বার পাক খেয়ে ঘুরছে। অকস্মাৎ, তাহেরের মনে এই সত্যটি উদ্ভাসিত হয় যে, গোটা শহরটাই এক বিশাল গোরস্থানে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। দু’পাশের বাড়িগুলোকে কবরের মতো মনে হয় তার। চতুর্দিকে জীবিতের চেয়ে মৃতের নিঃশ্বাস সে টের পায়। তাহেরের আরও মনে পড়ে যায়, জলেশ্বরীতে যার সঙ্গেই কথা বলেছে, তারা জীবনের চেয়ে মৃত্যুর সংবাদ বেশি শুনিয়েছে তাকে। এ শহরের প্রতিটি মানুষ যে মৃত্যু নামক এক রাজত্বের প্রজায় পরিণত হয়েছে, এই আবিস্কারের সঙ্গে সঙ্গে তাহের অত্যন্ত নিঃসঙ্গ বোধ করে, এক প্রকার হতাশা তাকে অবসন্ন করে ফেলে।
শুধু জলেশ্বরীর নয়, একাত্তর পরবর্তী সারাদেশেরই দৃশ্যপট ছিলো এমন। শহীদের নামে সড়কে হাটতে হাটতে পুরো জলেশ্বরীকে তাহেরের মনে হয় মৃত্যুপুরী। সন্ধ্যার পর পরই এখানে নির্জনতা নামে, আধারাবৃত্ত রাত ভয় জাগায় মনে। সীমিত হয়ে আসে মানুষের চলাচল। মাঝে মাঝে গুলির শব্দে কেঁপে উঠে জনপদ। স্বাধীন দেশে লড়াই চলে দেশপ্রেমিক ক্যাপ্টেনের দলের সঙ্গে চোরাচালানীদের। কখনোবা শাস্তি কার্যকর করা হয় বিহারীদের। সেই শাস্তি গুলিতে মৃত্যু। ক্যপ্টেনের ভাষ্য অনুযায়ি, এমন শাস্তি কার্যকরের পূর্বে সুযোগ দেওয়া হয় ‘অপরাধীকে’ আত্মপক্ষ সমর্থনের। নিজেকে নির্দোষ প্রমানে ব্যর্থ হলে এবং ৩ জনের বিচারক দল একমত হলে তবেই কার্যকর করা হয় শাস্তি। তাহের জলেশ্বরীর যে হোটেলে প্রথম রাতটি কাটিয়েছিলো, সেখান থেকে এরকম একজন বিহারীকে গণহত্যার দায়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো ক্যাপ্টেনের দল। সে রাতে গুলির শব্দ শুনেছিলেন তাহের। দোকান মালিককে পরদিন সকালে জিজ্ঞেস করলে সে বাশঝাড়ের শব্দ বলে এড়িয়ে গিয়েছিলো প্রসঙ্গ। কিন্তু দোকানির সেই বক্তব্য বিশ্বাস হয়নি তাহেরের। সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে উন্মুখ হয়ে থাকে সে। রহস্যময় ক্যাপ্টেন চরিত্রটি তাকে ভাবনার সাগরে হাবুডুবু খাওয়াতে থাাকে।

ঢাকায় সরকারী চাকুরি করতেন ক্যাপ্টেন। আসল নাম মজাহার। ছিলেন সৎ কর্মকতা। কর্মক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অন্যদের চেয়ে আলাদা। নীতিহীনতাকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেননি কখনো। যুদ্ধ শুরু হলে হাতে তুলে নেন অস্ত্র। দেশ মাতৃকাকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে মুক্ত করতে ঝাপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হলে সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিলেও মাজহার এবং তার সঙ্গীরা কিছু অস্ত্র রেখে দেয় নিজেদের কাছে। এর মূল কারন যুদ্ধোত্তর নিজ গ্রামে সরকারের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ পাকাপোক্ত না হওয়ায় সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা। সেই সঙ্গে বেকারত্ব, চোরাচালিদের দাপট এবং বঞ্চনা। এ থেকে জলেশ্বরীর মানুষকে মুক্ত করতে আইন নিজের হাতে তুলে নেন মুক্তিযোদ্ধা মজাহার। অবতীর্ন হন তিনি ভিন্নতর এক সামাজিক ভূমিকায়। খ্যাত হন ক্যাপ্টেন অভিধায়। স্বাধীন দেশে শুরু হয় মাজহারের নতুন সংগ্রাম, যুদ্ধ। জলেশ্বরীতে এক বিকল্প প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেন তিনি। যা স্থানীয় নেতা হাফেজ মোক্তার স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন নি।
মুক্তিযুদ্ধের অকুতভয় সেনানী মজাহার বীরদর্পেই চালিয়ে যেতে থাকেন লড়াই। এলাকার সাধারন মানুষের চোখে তাই তিনি হয়ে উঠেন ক্যাপ্টেন, হিরো। রাতের বেলা তার গলার হাক এ-এ-রে-এ-এ যেনো অভয়সঞ্চারী বানীতে রূপান্তরিত হয়। দেশের শত্রুরা তটস্থ থাকে তার ভয়ে। ক্যাপ্টেনের এই ভূমিকা মেনে নিতে কষ্ট হয় তাহেরের। তার সাথে মতাদর্শের পার্থক্য উপলব্ধি করেন তিনি। অন্যদিকে যে স্বপ্ন নিয়ে তাহের জলেশ্বরীতে এসেছিলেন, সেই স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার বিস্তর ফারাক প্রথম দিনই তিনি প্রত্যক্ষ করেন। মুক্তিযুদ্ধে যে জলেশ্বরীর রয়েছে গৌরবগাথা, তাদেরকে আজ পেয়ে বসেছে জীবনবিমুখতা। নৈরাশ্যের অন্ধগলিতে যেনো তাদের বসবাস। স্বপ্ন নেই, নেই প্রত্যয়। সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাব তাদেরকে শুধু হতাশাগ্রস্থই করেনি, স্বার্থপরতা এবং দলবাজির বৃত্তে করেছে বন্দি। অন্যদিকে যাদের বদৌলতে এসেছে স্বাধীনতা তারা হয়েছেন প্রত্যাখ্যাাত, অবহেলিত। এ বিষয়গুলো মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন তাহের। স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যাক্তি হাকিম সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে তা আরও পরিস্কার হয়ে উঠে তাহেরের।
হাকিম সাহেব এক পর্যায়ে বলেছিলেন, যে, ইস্কুল খোলার অনেক হ্যাগাম আছে। স্থানীয় কারও মত, যে, ইস্কুল এখন খোলা না হোক। হাকিম সাহেবের কথায় এরকম ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল যে, ইস্কুল খোলার চেষ্টা নিয়ে হয়তো বিপদ ঘটতে পারে এবং বিপদটা প্রধানত তাহেররই। এ কথার স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি বক্তার কাছ থেকে।
এমন কথা শুনে স্বভাবতই একটু ভড়কে গিয়েছিলেন তাহের। তারপরও প্রত্যয়ী ছিলেন সংকল্পের ব্যাপারে। প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে স্কুলে এলেও আর কোন শিক্ষক নেই। স্কুলের অবস্থাও জরাজীর্ন। আগাছা ভরা খেলার মাঠ। গোবরে ভরা স্কুলের বারান্দা। পরান নামের একজন দপ্তরী আছে সেও নিজের কাজেই ব্যস্ত থাকে। প্রথমে চলাফেরার উপযোগি করতে পরানকে দিয়ে জনমজুর সন্ধান করেন তাহের। এরপর চুক্তিতে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ দেন দুই জনমজুরকে। যথারীতি তারা শুরু করে পরিচ্ছন্নতার অভিযান। স্কুলের একটি কক্ষেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন তাহের। দফতরির পরিবারে মাসিক খরচা দিয়ে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে পকেট থেকে বের করে দেন নগদ কিছু টাকা। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা শেষ করে শুরু করেন স্কুল খোলার পরিকল্পনা। কিন্তু হাকিম সাহেবের আতংকজাগানিয়া কথা বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনায় নিয়ে এগুতে থাকেন তিনি। তবে স্কুল চালুর ব্যাপারে অনঢ় থাকেন তিনি। তার উপলব্ধি-
লেখাপড়ার চেয়ে অন্যপ্রকার শক্তি অর্জনই জীবনের পরাকাষ্ঠা বলে পরিচিত হচ্ছে; সে শক্তি হয় আগ্নেয়াস্ত্রের অথবা অর্থের। তাই জলেশ্বরীর কিছু তরুণ এবং কিশোর বর্তমানে হয় কিছু আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করে ক্ষুদে সামন্ত সেজে বসে আছে অথবা সীমান্ত পেরিয়ে পাটের চোরাচালানে মনোযোগ দিয়েছে। যারা এ দুয়ের কোনো দলেই ভেড়েনি তারা বিদ্যা অর্জনের চেয়ে নকল করে পরীক্ষা পাস করাই সহজতর মনে করেছে।
হাফেজ মোক্তারের আশকারা পেয়ে ছাত্ররা না পড়েই পাশের পন্থা বেছে নেয়। কিন্তু এর বিরোধীতা করে পুলিশ এনে পাহাড়া বসিয়ে পরীক্ষা নেন হাকিম সাহেব। এনিয়ে হাকিম সাহেব এবং হাফেজ মোক্তারের মধ্যে প্রকাশ্যেই হাতাহাতির উপক্রম সৃষ্টি হয়। হাফেজ মোক্তার অভিযোগ করেন, বাইরের লোক বলেই প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তি হাকিম সাহেব স্থানীয় ছাত্র সমাজের প্রতি মমতাহীন। এমন পরিস্থিতিতে স্থগিত হয়ে যায় পরীক্ষা। হাফেজ মোক্তারের চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে সকল ছাত্রকে বিনা পরীক্ষায় পাশ ঘোষণা করতে বাধ্য হন প্রধান শিক্ষক এবং একারনে ইস্তফা দিয়ে চলে যান। সে থেকেই হাফেজ-হাকিম দ্বন্দ্ব চলছে। হাকিম সাহেবের ইচ্ছে স্কুলটি চালু হোক। কিন্তু হাফেজের ইচ্ছে সম্পূর্ণ বিপরীত। পরিবেশ পরিস্থিতি অনূকূলে না থাকায় তিনি স্কুলটি চালু করতে পারছিলেন না। বিশেষ করে শিক্ষক না থাকায় সেটি সম্ভব হচ্ছিল না। তাহের জলেশ্বরীতে আসায় স্কুল চালু হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তারপরও থেকে যায় শঙ্কা।
তাহের নিজেও একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। একাত্তরে ঢাকায় নিজের স্কুলে স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলন করার কারনে একদিন পাঞ্জাবীদের আগমন ঘটে তার বাড়িতে। তাকে ধরতে না পেরে স্ত্রী হাসনার উপর চড়াও হয় হায়নারা। নির্যাতনের অপমান সহ্য না করতে পেরে আত্মহনন করেন হাসনা। সেই ক্ষত ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করার তাগিদ থেকেই জলেশ্বরীতে ছুটে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু চাইলেই কি আর অতীত ভোলা যায়? ভুলতে পারেন নি! যুদ্ধ প্রসঙ্গ এলেই স্ত্রীর মুখচ্ছবি ভেসে উঠেছে তার চোখের সামনে। সুখ স্মৃতিগুলো তাকে করে তাড়িত। শুধু সহধর্মীনির স্মৃতিই নয়, তাহেরের স্মৃতিচারণ ও আত্মকথনের মধ্য দিয়ে উপনস্যাসে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে জলেশ্বরীর ভূমিকার কথা, যুবকদের আত্মত্যাগের কথা, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ঘটনার গতি প্রকৃতিকেও একইভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাহেরের মনোবিশ্লেষণ করে উদ্ভুত পরিস্থিতি বর্ননা করেছেন, আঞ্চলিক আখ্যানের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন বৃহত্তর প্রেক্ষিতের কথা।
স্ত্রী সন্তানকে ফেলে যুদ্ধে যাওয়া ক্যাপ্টেন মজাহার দেশ স্বাধীনের পর আর ফিরে যাননি ঢাকায়। খবর পাঠিয়ে কোন কাজ না হওয়ায় স্ত্রী হাসনা নিজেই ছুটে আসেন জলেশ্বরীতে। স্টেশনে ক্যাপ্টেনের খোঁজে গিয়েছিলেন তাহের। তাকে না পেলেও হাসনাকে পেয়ে যান। হাসনা জানেনা তার শ্বশুড় বাড়ির ঠিকানা। তাহেরও জানেন না ক্যাপ্টেনের ঠিকানা। অগত্যা তাকে নিয়ে আসেন স্কুলে। সে রাতেই স্কুলে আগমন ঘটে মজাহারের। হাসনা তাকে নিয়ে যেতে এসেছে বললে ঢাকায় ফিরে না যাওয়ার ব্যাপারে অনঢ় থাকেন ক্যাপ্টেন। উল্টো তাহেরকে তিনি বলে যান, তিনি যেন ট্রেনে তুলে দেন হাসনাকে। কিন্তু হাসনা তার কথা আমলে না নিয়ে থেকে যেতে চায় জলেশ্বরীতে। ক্যাপ্টেনকে সঙ্গে নিয়েই তবে সে যাবে এমন সিদ্ধান্তে স্থির থাকে হাসনা। সে রাতে জলেশ্বরীর মানুষ শুনতে পায় টানা গুলির শব্দ। পরদিন যখন তাহের নিজ স্ত্রীর নামের সাথে ক্যাপ্টেনের স্ত্রীর সাজুয্য খোজে পায় তখন এক ধরনের শিহরন অনুভব করে হৃদয়ে। প্রেমানুভূতি খেলা করে তার মনে। নিজেকে নিজেই সামলে নেয়। স্কুল খোলার স্বপ্ন নিয়ে বাইরে বের হলেও তাহের ফিরে আসে বিমর্ষবদনে। পরাণ তাকে জানিয়েছে, গতরাতে হাফেজ মোক্তারের দলের সঙ্গে ক্যাপ্টেনের দলের যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে ক্যাপ্টেন। এ সংবাদ যখন হাসনাকে অবগত করেন তাহের তখন যেনো পাথরে রূপান্তরিত হন হাসনা! তাহের এবং হাসনার মুখ থেকে যেনো সমস্বরে উচ্চারিত হয় ‘মৃতকে এখানে কেউ স্মরণ করে না; জীবিতকে এখানে কেউ সম্মান করে না। …বাহ, এই তবে স্বাধীনতা? এরই জন্য স্বাধীনতা।’
আকস্মিক বিস্ফোরণে দফতরি পরানের গাভীটি রক্তাক্ত শরীর নিয়ে মাঠ দিয়ে দৌড়ে যায়। ইস্কুল না খোলার জন্যই যে এই হামলা তাহের মুহুর্তের মধ্যেই তা উপলব্ধি করেন। দুই মিনিট দুরত্বের রেল স্টেশনে শোনা যায় ট্রেনের হুইসেল। তাহের হাসনার হাত ধরে টান দেয়, বলে-‘চলুন’। হাসনা প্রথমে হাত ছাড়িয়ে নিলেও পরক্ষনেই হাতটি চেপে ধরে বলে ‘না’। পায়ের নীচের মাটি কাপিয়ে ঘটে দ্বিতীয় বিস্ফোরণ। সৈয়দ শামসুল হক এখানেই ইতি টানেন উপন্যাসের। কি হয়েছিল হাসনার, কি হয়েছিল তাহেরের। তারা কি অক্ষত ছিলো ? নাকি ক্যাপ্টেনের মতো, তাদেরকেও আচ্ছাদিত করেছিলো মৃত্যুর হিমশিতল পরশ! তা আর জানা যায় না। নিজেদের মতো করেই আমাদেরকে উপলব্ধি কবতে হয় এর সমাপ্তি। মুক্তিযুদ্ধের অনেক অসমাপ্ত কাহিনীর মতোই এই কাহিনীটিও অসমাপ্তই থেকে যায়।