মানুষই ইতিহাসের নির্মাতা। যুগে যুগে কালে কালে মানুষ নিজেদের প্রয়োজনেই ইতিহাসের গতিপ্রবাহকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। বিশেষকরে লেখকরা নানাভাবে নানা পদ্ধতিতে সেই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে পালন করে চলেছেন অগ্রনী ভূমিকা। সমকালে যেসব কথাসাহিত্যিক সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন রিজিয়া রহমান তাদের মধ্যে অন্যতম। আমাদের ইতিহাসের ঘটনাক্রম প্রবন্ধ, নিবন্ধ এবং গবেষণায় মলাটবন্ধি থাকলেও একক কোনও উপন্যাসে লিপিবদ্ধ ছিল না এতকাল। ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসের মাধ্যমে সেই অপূর্ণতা পুরণ করে রিজিয়া রহমান প্রমান করেছেন, ইচ্ছে থাকলে ইতিহাসকেও রূপান্তর করা যায় উপন্যাসে!
আমাদের মুক্তি সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসের ধারাবাহিকতাই বিবৃত হয়েছে ‘বং থেকে বাংলা’য়। বাংলাদেশের উৎপত্তি থেকে শুরু করে-এ বদ্বীপে বসবাসকারী বিভিন্ন জনজাতির সংমিশ্রন এবং সভ্যতার ক্রমবিকাশ সুনিপুনভাবে উঠে এসেছে রিজিয়া রহমানের বর্ননায়। ‘আরণ্যক আদিম ভূমির বুকে বিচিত্রতর শ্বাপদসংকুল জীবন’-এর আখ্যান দিয়ে শুরু হয়েছে তাঁর উপন্যাসের পটভূমি। উপস্থাপনের নান্দনিকতা আমাদের সহজেই নিয়ে যায় সেইকালে-যে কালকে হৃদয়াঙ্গম করে লেখা হয়েছে-‘বং থেকে বাংলা’। আমাদের সামনে যেন ভেসে উঠে সেই সময়ের চিত্র। উপন্যাসিকের বয়ান দিয়েই শুরু করতে চাই আলোচনা।
‘সমুদ্র মেখলা স্রোতস্বিনীর ধারা-স্পর্শী নীল বনাচ্ছন্ন এক ভূমি। কবে সেই সৃষ্টির আদিতে যখন তৃতীয় হিমবাহর যুগ অতীত হয়ে পৃথিবীর বুকে নেমেছে সোনালী বসন্ত। কিন্তু তখনও জন্মলগ্নের আলোড়ন হিমালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব সীমানায়, সেই জন্মলগ্নের বেদনা-আনন্দের মধ্য দিয়ে নীল জলধির বুক চিরে দেবী ভেনাসের মত জেগে উঠেছিল এক ভূখ-। পাষাণ পর্বতের অন্তঃস্থল থেকে যে পয়োধর সদৃশ্য স্নিগ্ধ ধারা কিশোরীর চঞ্চলতার নৃত্যছন্দে স্বচ্ছ শরীরে ঘর ছেড়েছিল সেই ক্ষীণাঙ্গী ধারাই পূর্ণ যৌবনা হয়ে জন্ম দিল এক সুবর্ণ পলিখ–সমতট।’
…‘এখানে এলো একদিন দুটি ছিন্নমূল মানুষ। উত্তরে সমৃদ্ধশালী দ্রাবিড়ভূমিতে স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র আর মণিমুক্তার লোভে হানা দিল স্বর্ণকেশী গৌরবর্ণ দীর্ঘকায় অশ্বারোহী যাযাবর আর্যরা। তাদের বর্বর অস্ত্রের আঘাতে শান্তিপ্রিয় নিরীহ দ্রাবিড়েরা হল ছিন্ন-বিচ্ছন্ন। কিন্তু আর্যদের বিক্রম কেবল স্থল-ভূমিতে, জল বিচরণে তারা অপটু। তাই সেই স্থলে বারংবার হানা দিয়ে তারা এক সন্ত্রাসের রাজ্য তৈরি করল। অসংখ্য দ্রারিড় পুরুষ নিহত হল। নারীদের লাঞ্ছিত করে করা হল দাসী। শিশুদের বর্শার ফলকে বিদ্ধ করে বল্লমধারী চর্ম-পরিহিত আর্যরা মহা উল্লাসে অগ্নিসংযোগ করল দ্রাবিড় জনপদে। দ্রাবিড় দুর্গগুলির পতন ঘটল একে একে। তীরন্দাজ দ্রাবিড় যোদ্ধারা তীর নিক্ষেপ করতে করতে পিছু হটে অবশেষে ঘাঁটি তৈরি করল পর্বত-বন্ধুর দক্ষিণ ভূমিতে। এদেরই একদল জাহাজ ভাসিয়ে সমুদ্রচারী হল। সমুদ্রে তাদের জলযানগুলো ভাসতে লাগল নতুন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। এই বহরের একটি জাহাজ প্রবল কুয়াশায় দিগভ্রষ্ট হয়ে দলছাড়া হল। অনির্দষ্টভাবে নোনা জলের ঝাপটা খেয়ে ভাসতে লাগল দিগ্বিহীন অসীম সাগরে।’ (পৃ. ১৯-২০ )
এভাবে শুরু হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার বছরের ঘটনাক্রম। সূচনাতেই আমরা প্রত্যক্ষ করি নিষ্ঠুরতা। যে জাহাজটি দিকভ্রষ্ট হল, সেই ভাসমান জাহাজ থেকে বং এবং এলা নামের যুবক-যুবতীকে ফেলা দেওয়া হলো সমুদ্রে। কারন তাহলে তুষ্ট হবেন দেবতা, কেটে যাবে বিপদ। কিন্তু প্রকৃতির অপার করুণায় বেঁচে যায় তারা। জলের স্রােতধারা অবচেতন এই যুগলকে তীরে নিয়ে যায়! তাদের যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন নতুন এক ভূ-খ-ের সন্ধান লাভ করে তারা। প্রাণের সন্ধানে ছুটতে গিয়ে যাদের সাথে দেখা হয়, তারা যেন ভিন্ন এক জগতের মানুষ। তারপরও বং এবং এলার সেইসব মানুষের সাথে মিশে যেতে কোনও সমস্যা হয়না। তাদের জীবনযাত্রার সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠে তারা। সেইকালে মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, জংলী জানোয়ার, কুমির আর হিংস্র প্রাণীদের সাথে লড়াইয়ের আখ্যান চমৎকারভাবে ওঠে এসেছে উপন্যাসের প্রথম পর্বে। আমরা যখন শব্দের সিড়ি বেয়ে এগিয়ে যাব আগামীর পথে-তখন মনে হবে আমরা হাটছি ইতিহাসের সাথে, সভ্যতার বিবর্তনের সাথে। তখন সহজেই অনুমেয় হবে ভূমিকাংশে লেখকের দাবির কথা। রিজিয়া রহমান অকপটে বলেছেন, -‘বং থেকে বাংলা উপন্যাস মূলত একটি দেশ ও জাতি গঠনের ইতিহাস, সাধারণ মানুষের দুঃখের হাহাকারের ইতিহাস এবং একটি জাতির জাগরণের ইতিহাস।’সেই জাতিটি আবশ্যিকভাবেই বাঙালি জাতি।
মূল প্রসঙ্গে আসতে চাই আবার। বং এবং এলা যাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল সেইসব মানুষেরা পাহাড় থেকে খাবার সংগ্রহ করলেও হিং¯্র প্রাণীদের কাছ থেকে বাঁচার জন্য নৌকায় কাটাতো রাত। কিন্তু নদীও কি নিরাপদ ছিল? না সেখানেও ছিল কুমিরের ভয়। এই ভয়কে জয় করে, কখনওবা বাঘের খাদ্য হয়ে, কিংবা কুমিরের আহারে পরিণত হয়ে এগিয়েছে মানুষের জীবন। উদ্বেগ আর আতংককে সঙ্গী করে চললেও পরিণয়ের বাসনা ঠিকই ছিল মানুষের। সেইকালেও প্রেম ছিল, ভাষিক ব্যবধান সেই প্রেমের পথে অন্তরায় হতে পারেনি-সেটাও লেখিকা দক্ষতার সাথে অংকন করেছেন শব্দমালায়। প্রথম পর্বে কারোরই অনুধাবন করতে এতটুকু কষ্ট হবে না, যে সময়টাকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে সেটি ছিল মূলত নারী প্রধান সমাজ ব্যবস্থার চিত্র। প্রথম অধ্যায়ের শেষাংশ উদৃত করতে চাই।
‘নৌকা এগিয়ে চলেছে। একঘেয়ে ছপছপ তালে বৈঠা পড়ছে জলে। চাঁদ নেমে এসেছে নদীর বুকে। নৌকার অধিবাসীরা সবাই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। বংও ঘুমিয়ে পড়েছিল। সহসা কার উষ্ণ কঠিন আকর্ষণে ঘুম ডাঙল। অনুমানে বুঝল একটি নারী তার সান্নিধ্যে। এলার পরিচিত দেয়াবয়ব নয়। তবে কি পাইককী! বিদ্যুৎ শিহরিত হল বংয়ের শিরা-উপশিরায়। কিন্তু না পইককী নয়। বাইদ্যা। এ গোত্রের নেত্রী। সব পুরুষ যার স্বামী। সব পুরুষের ওপর যার অধিকার।
নৌকা দুলে উঠেছে। নৌকার নীচে অস্থির জলের মাতন নিয়ে মিলিত হয়েছে দুটি নদীর ধারা। বং এলা বাইদ্যা পাইককী-কৈয়াততদের নৌকা এসে পৌছল দুই নদীর সঙ্গমস্থলে।’ (পৃ. ৩০)

বঙ্গআলদের আবাসভূমি নিয়ে শুরু হয়েছে উপন্যাসের দ্বিতীয় অধ্যায়। কালু বুইনী এবং নমসিন এই পর্বের অন্যতম চরিত্র। পাখি শিকারী নমসিন লোহার কাটারি আর-সোনার টুকরো কিনতে আসে বঙ্গালভূমে। পথে তার দেখা হয় ভুলুর সাথে। গড়ে উঠে সখ্যতা। ভুলু তাকে বাড়িতে দাওয়াত করে। যেদিন ভুলুর বাড়িতে খেতে আসে নমসিন সেদিন ঘটে বেদনাবহ ঘটনা। বুনো মহিষ হানা দেয় বংআলদের ক্ষেতে। ভুলু মারা যায় বুনো মহিষের হিংস্রতায়। প্রথা অনুযায়ী বংআলদের প্রধান হওয়ার কথা ছিল ভুলুর ছেলে কালুর কিন্তু তার মাথায় খেলা করে অন্য চিন্তা ; যে বংআলরা ছিল সাম্যে বিশ্বাসী তাদের কালু বাধ্য করে বশ্যতা স্বীকার করতে এবং সবকিছুর একক অধিকারী হয়ে যায় সে। কিন্তু সেটা মেনে নিতে পারেনি বেদে কন্যা বুইনি। নমসিনকে নিয়ে সে গড়ে তুলে আরেকটি আল। সগোত্রীয় অনেকে সেখানে সমবেত হয়। একদিন কালুর সাথে যুদ্ধ বাধে বুইনির। প্রাণ হারায় কালু। প্রলয়ে অনেক কিছু ধ্বংস হয়; সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করে কালুর অনুসারীরা, বংআলরা। এ পর্বটি দেড় হাজার বছর পূর্বের ঘটনা প্রবাহ দিয়ে সাজিয়েছেন লেখিকা। পর্ব শেষে সে ব্যাপারে দিয়েছেন খানিক ব্যাখ্যা। যা উপন্যাসকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা।
দশটি অধ্যায়ে বিবৃত এ উপন্যাসের প্রতিটি পর্বেই বাঙালী নারী চরিত্রের আখ্যান লেখিকা দিয়েছেন নান্দনিকতা, মাদকতা কিংবা-মায়াময়তায়। বর্ণনা বৈশিষ্টে তাদের সৌন্দর্য্যের যে ছবি তিনি এঁকেছেন তাতে উপন্যাসটি সার্বিকভাবে পেয়েছে এক অনন্যমাত্রা। প্রায় প্রতিটি পর্বেই বিবৃত করার চেষ্টা করেছেন শ্যামবর্নের দীঘলকেশী রমনীর মোহনীয়তা। এছাড়া সময়বিন্যাস ও এর প্রাসঙ্গিকতাকে তিনি যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তাতে উপন্যাসের গতিপ্রবাহ হয়েছে আকর্ষনীয়। তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা সেই প্রচেষ্টারই স্বার্থক রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করি। আর্য-যোদ্ধারা পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপশ্চিমবঙ্গ, উত্তরবঙ্গের মহাস্থানগড় আর বাংলার প্রাপ্তসীমায় হানাদেয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তাদেরই কিছু সেনার থেকে যাওয়া এবং এদেরই একজন নীলাক্ষকে অন্যতম চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করে বিন্যস্ত করেছেন লেখিকা এ অধ্যায়ের পরিসীমা।
ক্ষত্রিয় নীলাক্ষ একদিন ভ্রমন তৃষ্ণা মেটাতে নৌকাযোগে রওয়ানা হয় সমতটের উদ্দেশ্যে। কিন্তু প্রলংকরী ঝড়ে নৌকা ডুুবি হয়। একখ- কাঠের টুকরো ধরে নীলাক্ষ বেঁচে থাকার শেষ প্রচেষ্টা চালায়। একসময় সে জ্ঞান হারায়। যখন তার জ্ঞান ফিরে আসে তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে নদী তীরে। বালির উপর শুয়ে আছে সে। শরীরে জোর নেই তেমন একটা। এ অঞ্চলের প্রধানের মেয়ে বিনিকা পানি নিতে এসে বালুর উপর পড়ে থাকতে দেখে নীলাক্ষের কাছে আসে। কথা বলে জানতে পারে ঘটনা। বাড়ি গিয়ে বাবাকে নিয়ে আসে নীলাক্ষকে উদ্ধার করার জন্য। কাটাআলের প্রধান বাঘন হাতি নিয়ে আসেন অতিথিকে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে। তাতে নীলাক্ষ সম্মত হয় না। পায়ে হেটে যাত্রা করে। কিন্তু বাঘনের সহচর বগাইর হাবভাব ভালো লাগেনা তার। বাঘনের বাড়ির পাশেই আবাস গড়ে তুলে নীলাক্ষ। অল্পকিছুদিনের মধ্যে বংগআলদের জীবনযাত্রার সাথে মিশে যায় সে। সখ্যতা গড়ে উঠে বিনিকার সঙ্গে। বাঘনও তাকে ভালোবাসে।
কাটাআলে ধীরে ধীরে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠা নীলাক্ষকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনা বগাই। কারণ বিনিকাকে যে সেও ভালোবাসে। বগাই বিনিকাকে তীব্রভাবে পেতে চায়। কিন্তু পথের কাটা হিসেবে হাজির হয়েছে নীলাক্ষ। যদিও বিনিকা-নীলাক্ষকে ভালোবাসে, বগাইকে তার ভালো লাগেনা।
একদিন ক্ষেতে কাজ করছিল নীলাক্ষ। কিষাণদের মধ্যে ভয়ার্ত শোরগোল শুনে সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পেল জঙ্গল থেকে একটা দাতাল বুনো শূকর নেমে এসেছে লোকালয়ে। এক যুবককে রক্তাক্ত করে আরেকজনকে তাড়া করছে। নীলাক্ষ পাশে থাকা বিনিকাকে ঘর থেকে তীর ধনুক আর বর্ম আনতে পাঠায়। কৃষাণদের সাহায্য করতে সাকো পেরিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হয়। একটু পরেই বুঝতে পারে মস্তবড় ভুল করে ফেলেছে সে। যারা বুনো শূকরটাকে তাড়া করছে তাদের দলের অগ্রভাগে রয়েছে বংগআলের বিখ্যাত শিকারী বগাই। সে জন্তুটাকে জঙ্গলের দিকে না তাড়িয়ে যে দিকটায় নীলাক্ষ রয়েছে সেদিকে তাড়িয়ে আনছে। বগাইর কুমতলব বুঝতে বাকী থাকেনা তার। তাৎক্ষনিক বুদ্ধি খাটিয়ে পাশের গাছের ডাল ভেঙে শূকরের দিকে ছুড়ে ফেলে নীলাক্ষ। বাধা প্রাপ্ত হয়ে আরও হিংস্র হয়ে উঠে শূকরটা। নীলাক্ষ ধাওয়া করতে আসা বাঘনের হাত থেকে বর্ষা নিয়ে শূকরের বুকে ছুড়ে মারে। বর্ষার নির্ভুল নিশানায় প্রাণ হারায় হিং¯্র শূকর। এই ঘটনায় বাঘন নীলাক্ষের উপর মহাখুশি হলেও খুশি হতে পারেনি বগাই। কারণ নীলাক্ষ আর বিনিকার অন্তরঙ্গতা বিক্ষুব্ধ করে তুলে তাকে। তাছাড়া বাঘন সবকাজে বগাইর চেয়ে নীলাক্ষকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এটাকে বগাই নিজের পরাজয় মনে করে প্রতিশোধ স্পৃহায় অস্থির হয়ে উঠে।
ঐদিন সন্ধ্যায় ছিল উৎসব। কাটালপাড়ায় ঘরে ঘরে আনন্দের জোয়ার। রাতে বাঘনের বাড়িতে গানের আসর বসে। তাতে শামিল হয় নীলাক্ষ। আসেনি শুধু একজন-সে বগাই। বিষয়টি নীলাক্ষকে উদ্বিগ্ন করে, বাঘনের সাথে আড়ালে এনিয়ে কথা বলে সে। বাঘন নীলাক্ষকে যে কথা জানাল, তাতে চিন্তিত হয়ে পড়ে নীলাক্ষ। বগাই বাঘনকে পরাস্ত করে কাটাআলপাড়ার প্রধান হতে চাচ্ছে। নীলাক্ষ বাঘানকে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দেয়। রাতে পান ভোজন-নাচ গানের পর সবাই যখন গভীর ঘুমে -এমন সময় সঙ্গীদের নিয়ে বাঘনের বাড়িতে হানা দেয় বগাই। শব্দশুনে দ্রুত উঠে দাড়ায় নীলাক্ষ। দেখতে পায় বাঘনের হাতি গরুদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে একদল লোক। এক মহুর্ত দেরী না করে উঠানে এসে দেখে হাত মুখ বাঁধা অবস্থায় বিনিকাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে একটি লোক। অন্যদিকে বাঘনের সাথে মল্লযুদ্ধে মত্ত বগাই। এক পর্যায়ে বাঘনকে বেকায়দায় ফেলে তার বুকের উপর চরে বসেছে বগাই। নীলাক্ষ ঝাপিয়ে পড়ল। তার বর্শার ফলায় প্রথমেই বিনিকার অপহরণকারী কপোকাত হল। তারপর বগাইর হাতের কাটারি ছিনিয়ে নিয়ে তাকে ধরাশায়ী করল নীলাক্ষ। দ্বিখন্ডিত দেহ পড়ে রইল বাগাইয়ের। বাঘনের দল অস্ত্রসন্ত্র নিয়ে তাড়া করল হাতি গরু নিয়ে যাওয়া লোকদের। তাড়া খেয়ে পালিয়ে গেল ওরা। যুদ্ধজয়ের পর বাঘনের কাছে বিনিকাকে চাইল নীলাক্ষ। সে জানাল আজ থেকে বংগআলই তার দেশ। তাতে আপত্তি করলনা বাঘন।
বিভিন্ন জনজাতির মিশ্রণ এই দেশকে যে বৈচিত্রময় করেছে তারই যেন প্রতিচিত্র ফুটে উঠেছে এই অধ্যায়ে। আর লেখক তা সম্পাদন করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। এ পর্বে তৎকালীন সমাজব্যবস্থার রূপরেখাও যেন চলে আসে আমাদের দৃষ্টিসীমায়। সেই সময়েও শক্তিমানরাইযে পেশি শক্তির বলে আধিপত্য ধরে রেখেছিল তা উপলব্ধি করা যায় সহজেই।
পৃথক পৃথক পর্বে উপন্যাসটি সাজানো হলেও পূর্বের পর্বের সাথে সাজুয্য রেখেই এগিয়েছে পরবর্তী অধ্যায়গুলো। তৃতীয় অধ্যায় যেখানটায় সমাপ্ত হয়েছে-চতুর্থ অধ্যায়ের শুরু হয়েছে ঠিক সেখানটায়। তবে এক্ষেত্রে চরিত্রের নামকরণে রিজিয়া রহমানের ভূয়সী প্রশংসা না করে পারা যায় না। সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে তিনি দিয়েছেন নায়ক-নায়িকার নাম। গতানুগতিক কোনও নামই ব্যবহার করেন নি আদিপর্বে। নারী চরিত্রের ক্ষেত্রে যেমন ঠিক তেমনি পরুষ চরিত্রের নামকরণেও আমরা প্রত্যক্ষ করি প্রাচীনতার প্রভাব।
‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসের রিজিয়া রহমানের অন্যতম কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল পাঠককে সেই সময়ে নিয়ে যাওয়া যে সময়ের ঘটনা বর্ণনা করতে চেয়েছেন তিনি। আমার বিশ্বাস এক্ষেত্রে তিনি শতভাগ সফল হয়েছেন। বলা বাহুল্য, আলোচ্য উপন্যাস আমাদেরকে গতানুগতিকতার বাইরে নিয়ে যায়। দাঁড় করায় ভিন্নতার মুখোমুখি। যে ভিন্নতার সম্মুখে আমাদের নিত্যই দাঁড়ানো প্রয়োজন। কারণ এ থেকে আমরা সহজেই গ্রহণ করতে পারি ইতহাসের পাঠ।
সময়ের সাথে বর্ণিত চরিত্রগুলোকে উপস্থাপনের পূর্বে ভূমিকাংশের মত প্রথমেই আলোচ্যকালকে উপন্যাসে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যা আমাদেরকে সময়ের হাত ধরে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। চতুর্থ অধ্যায়ের সূচনাপর্বে আমরা তারই স্বার্থক রূপায়ন প্রত্যক্ষ করি।
‘উত্তর ভারতের বিভিন্ন গোত্র বিভক্ত বৈদান্তিক আর্য সমাজে রাজন্য প্রথা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শিরপ্রধান ব্রাক্ষণ আর ক্ষত্রিয়ের ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় আর্য সমাজব্যবস্থা যখন জটিল, তখন উত্তরাপথে বার বার বিদেশী ক্ষমতাশালী পশুদের কোলাহল ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠল। বারংবার অস্ত্রের ঝনঝনা, আর্তের চীৎকার, রক্তে নদী অতিক্রম করে গঠিত হল মৌর্য সাম্রাজ্য। মৌর্যের তরবারী রুদ্ধ করল বিদেশী শত্রুর আক্রমণ। আর বিকৃত বেদান্ত ব্রাক্ষণ্যের প্রতিবাদে এল সামাজিক ধর্মীয় বিপ্ল¬ব। এল জৈন আর বৌদ্ধ মতবাদ।
মৌর্য সম্রাট অশোক কলিঙ্গের যুদ্ধে অসংখ্য মৃত্যুপথযাত্রীর হাহাকারে যুদ্ধে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ক্ষত্রিয়ের অস্ত্র দূরে নিক্ষেপ করলেন। জীবনের ভোগ-আসক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে আশ্রয় নিলেন গৌতমযুদ্ধের আলোকিত বেদীতলে। জৈন তীর্থংকরদের পিছে ফেলে গৌতমবুদ্ধের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে অশোকের ছত্রবাহী বৌদ্ধ মতবাদীরা মগধ গৌড়, প-্র সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। অহিংসা আর ভেদহীন মানবধর্মের ঢেউ বয়ে গেল চারিদিকে। আর সমতট! সেখানকার ইতিহাস কি? ইতিহাস নীরব। কোথায় সেই নদীর সন্তানরা? বৈদিক যুগের প্রারম্ভ থেকে যারা আর্য-সভ্য পৃথিবীর কাছে অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে অভিহিত হয়ে আসছে। সেখানে বার বার গতি পরিবর্তন করে নদী। বার বার গড়ে ওঠে নতুন লোকালয়। ঝঞ্ঝা, বন্যা ভাঙনের সঙ্গে সংগ্রাম করে এক সংগ্রামী সম্পদশালী জনপদের অস্তিত্ব ভাস্বর হয়ে আছে। আপন ধর্ম কৃষ্টি জীবন-যাত্রায় তারা বিশিষ্ট, তারা ভারতীয় নয়, বংগআল। আবার কোলাহল উত্তরে। এবারে শাসনদ- হাতে তুলে নিয়েছে গুপ্ত বংশ। দিগ্নিজয়ী হবার নেশায় সম্রাট সমুদ্র গুপ্ত ছুটে এলেন সমতট পর্যন্ত।’ (পৃ. ৬৫ )

বৌদ্ধের অহিংসা এবং ভেদাভেদহীন মানবধর্মের ঢেউ ঠিক কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল মানবমনে তারই সফল আখ্যান আমরা অনুধাবন করি এ অধ্যায়ে। ইতিহাসের সাথে তৎকালীন সমাজব্যবস্থার সংযোগ ঘটিয়ে রিজিয়া রহমান প্রবেশ করেছেন কাহিনীর ভেতরে। নীলেন্দ্র ভভ্র এবং ওয়াইমতাং-এই দুই বন্ধুর প-্রনগরে আগমনকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে চতুর্থ অধ্যায়ের ঘটনাপ্রবাহ। নীলেন্দ্র এসেছে বংগল থেকে হাতি নিয়ে, এর বিনিময়ে ঘোড়া কেনার ইচ্ছে তার। সরাইখানায় এসে দুই সৈনিকের সাথে বাদানুবাদে জড়িয়ে গ্রেফতার হয় নীলেন্দ্র। কারাগারে কাটতে থাকে দিন। সেখানে জৈন সাধু তীর্থংকর তাঁর জীবনের গতি পরিবর্তনে প্রভাব ফেলেন। একদিন কারাগার থেকে নীলেন্দ্রর মুক্তির সুযোগ আসে। কিন্তু মুক্ত না হয়ে রাজপ্রসাদ থেকে উজ্জয়িনীর ব্রাহ্মন অনঙ্গভট্টের সহায়তায় রাতের আধারে তারই বৌদ্ধ বন্ধু লাও তুংয়ের সহায়তায় প-্রনগরের সিংহদ্বার পেরিয়ে যায় সে। পালাতে গিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুর বেশ ধারণ করতে হয় নীলেন্দ্রকে। পরবর্তীতে সে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে জ্যোতির্ময় মানবে রূপান্তরিত হয়। জ্বলে উঠে সমতট। ১৬৫০ বছর পূর্বের এই আখ্যানটি-সেই সময়ের রাজত্বের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আমাদের মানসপটকেও যেন জিজ্ঞাসু করে তুলে। নিয়ে যায় প-্রনগরে, সমতটে।
পঞ্চম অধ্যায়ের নায়ক পঞ্চগোপাল চাঁদকে জাতিস্মর হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন লেখিকা। এছাড়া বোধহয় অন্যকোনও উপায়ও ছিল না। এই বদ্বীপের দীর্ঘ যে ইতিহাস, তার সাথে যুগ যুগান্তরের ঘটনাপ্রবাহকেতো একক চরিত্রে কিংবা এই চরিত্রের বংশ পরম্পরায় রূপান্তর করা সম্ভব নয়। তাই ইতিহাসের সাথে বর্ণিত চরিত্রকে সংযুক্ত করতেই রিজিয়া রহমান গ্রহণ করেছেন এমন পন্থা। বংগপতি মহারাজাধিরাজ সমচর দেবের নৌ সেনা নায়ককেই এ পর্বের নায়ক হিসেবে তিনি উপস্থাপন করেছেন আমাদের সামনে।
লেখকের ভাষ্যে আমারা সহজেই অনুমান করতে পারি তা।
‘আসলে আমি জাতিস্মর। পূর্বজন্মের স্মৃতি আমার মনে আছে। শশাঙ্কের রাজত্বকালে আমি ছিলাম রাঢ়ের বৌদ্ধ শ্রমন। চন্দ্রদ্বীপের (বাকেরগঞ্জ) ভাটিয়াল নৃপতিদের সময়ও আমি ছিলাম। আমি ছিলাম স্বাধীন সমন্তরাজ চন্দ্রদ্বীপ অধিপতির টাকশালের প্রধান কর্মকার। থাক সেসব কথা। এখন আমার নাম পঞ্চগোপাল চাঁদ।’ (পৃ. ৮৯)
লালমাই ময়নামতি অঞ্চলকে ঘিরে অগ্রসর হয়েছে সেই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ। জাতিভেদের নিদারুনতাই মূলত এই পর্বের বিষয়বস্তু। পঞ্চগোপালকে সবাই আদর করে পঞ্চু বলে ডাকে। পঞ্চুর সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে শবরী কন্যা চম্পার। কিন্তু জাতিভেদ পঞ্চুকে আহত করে। চম্পার সাথে পথ চলতে চলতেও সে ফিরে যায় অতীত জীবনে। যে জীবনে এক দাসীর সহায়তা নিয়ে সম্রাট শশাঙ্কের উপর বিষ নিক্ষেপ করেছিল সে।
স্মৃতির অলিন্দ থেকে একসময় ফিরে আসে বাস্তবে। চম্পার সাথে আবিষ্ট হয় ভাবালুতায়। ডোমপাড়ার মাঠে সহাজয়াদের গানের আসর বসে। সেই আসরে রাতে আকষ্মিক হানা দেয় বিদেশী দস্যুরা। প্রলয়কা- ঘটে। অনেক রক্তপাত হয়। মৃত ভেবে পঞ্চুকে নদীতে ফেলে দেয় হামলাকারীরা। যখন তার জ্ঞান ফিরে আসে তখন নিজেকে আবিস্কার করে বালুচরে। সেখান থেকে একটি জাহাজে করে সে একসময় পৌছে যায় চট্টগ্রামে। এই পর্বের মূল বিষয় জাতভেদের হলেও শেষটা হয়েছে সম্প্রীতির উদাহরণ দিয়ে।
ব্রাহ্মন্যবাদের নিদারুনতা এবং এ থেকে রেহাই পেতে অনেকের ধর্মান্তরিত হওয়ায় বিষয়টি প্রধান্য পেয়েছে ষষ্ঠ পর্বে। নি¤œবর্গের মেয়ের সাথে মেলামেশার কারণে এক ঘরে করা হয় কমলের পরিবারকে। আর কৈবত্যের মেয়ে মহুলীকে অপহরণ করিয়ে তাকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কৈবর্ত যুদ্ধা ঈশানমল্লের প্রতিরোধ আর সময়মত যবন সাধু কর্তৃক মহুলাকে উদ্ধার মিলনের পথে নিয়ে যায় মহুলা ও কমলকে। ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে তারা। ক্ষমতার পালাবদল ঘটে কেন্দ্রে। সেনদের ব্রাহ্মণ্য প্রতাপের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে দেবরা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। বিস্তৃত হতে থাকে দেব রাজ্য।
পরিবর্তনের বার্তা দিয়ে শুরু হয়েছে সপ্তম অধ্যায়। কান্দাহারের পাঠান হায়াত মাহমুদ খানই এ পর্বের অন্যতম নায়ক। দিল্লীতে সুলতানের সেনাবাহিনীতে তিনি কিছুদিন সৈনিকের জীবন যাপন করে ছুটে আসেন বংগালে। উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনচেতা বংগালদের এবং তাদের আবাসভূমি দেখা। ঘুরতে ঘুরতে একদিন কৃষক আলী আফসারের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। গড়ে উঠে হৃদ্যতা। আলী আফসারের বাড়িতেই নতুন ঠিকানা হয় তার। এক রাতে হায়াত মাহমুদের দেখা হয় বেদে কন্যা রূপসীর সাথে। প্রথম দর্শনেই রূপসীর প্রেমে পড়ে যায় সে। কিন্তু সুলতান শামসুদ্দীনের অধিনে থাকা বংগালদের জীবনযাত্রা তার ভালো লাগেনা। হায়াত মাহমুদের মতে, ‘জান্নাতের মত দেশ এই বংগাল। এখানে আল্লাহ নেয়ামত ভরে দিয়েছেন, এমন সোনার দেশের মানুষ হয়েও তোমরা কমজাতের গোলাম বনে আছ। বল এ জীবনের কি দাম?’
একদিন রূপসীকে রাজ সৈন্যদের চাবুুকের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে তাদের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে হায়াত মাহমুদ। সে সময় তার দেখা হয় আলাউদ্দিন হোসেনের সাথে। আলাউদ্দিনের অনুরোধে হায়াত মাহমুদ বিদ্রোহী বাহিনীতে যোগদেয়। একদিন রাজকর্মচারীরা খাজনা দিতে না পাড়ায় আলী আফসারকে বেদম প্রহার করে তার স্ত্রী জরিনাকে হেরেমে নিয়ে যায়। হাবসীদের নির্যাতনে সবাইকে তখন তটস্থ থাকতে হত। বছরের উপার্জনের অর্ধেক তুলে দিতে হত সুলতানের খাজাঞ্জীখানায়। এই জুলুমের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছিল মানুষ। সেই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের জন্য সৈয়দ আলউদ্দিন হোসেন প্রতিষ্ঠিত বাহিনী অগ্রসর হতে থাকে। সেই বাহিনীর হাতেই একদিন পরাজিত হন বাদশাহ সুলতান নামদার। আর তার প্রাণ কেড়ে নেয় সেই বেদে কন্যা রূপসী। যদিও হাবসী কন্যা গোলাপজানের হাতে রূপসীকেও প্রাণ হারাতে অল্প সময়ের ব্যবধানে।
এই অধ্যায়টি আরও সমৃদ্ধ হয়েছে শ্রী গৌরাঙ্গের আবির্ভাব ও তার ধর্ম প্রচারের বিষয়কে কেন্দ্র করে। মায়ের আকুলতায় সংসারী হলেও সেই সংসারের বন্ধন নিমাইকে আবদ্ধ করে রাখতে পারেনি। এক সময় গৃহত্যাগী হন নিমাই। ব্রতী হন বিভেদহীন ধর্মমত প্রচারে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’-প্রচার করতে থাকেন তিনি।
রিজিয়া রহমানের ভাষ্য আমাদেরকে সেই আবাহে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
‘এই শ্রীগৌরাঙ্গ আর কেউ নন গৃহত্যাগী সন্নাসী নিমাই। তার প্রচারিত ধর্ম বৈষ্ণব মতবাদ ছড়িয়ে পড়ল দ্রুত দিকে দিকে গ্রামে প্রান্তরে নগরে। একদিকে সুফী দরবেশ আউলিয়াদের মতবাদ আর হিন্দু-মুসলমানদের মিলিত বিশ্বাসের রূপ ও সত্যপীর, বংগালের ধর্মীয় জীবনেও বয়ে আনল নতুন ধারা।
শান্তির সিগ্ধতায়, জ্ঞান চর্চার উদারতায় স্থাপত্য কলাশিল্পের উৎকর্ষে আর মানববাদী উদ্দীপ্ত হয়ে আলোকিত হল হুসেন শাহের বংগাল। নদী বিধৌত, সোনার বংগাল।’ (পৃ. ১৮৪)
একদিকে শোষণ নির্যাতন, অন্যদিকে বিদ্রোহ, ক্ষমতার পালাবদলের ক্ষেত্র তৈরি, সেইসাথে বৈষম্যহীন শান্তির সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ধর্ম প্রচার এবং পরিবর্তনের সাথে সাধারণের সম্মিলন, নতুনকে আবহনের প্রচেষ্টা-তারই অনুপঙ্খ বিশ্লেষণ এ অধ্যায়কে করেছে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর।
অষ্টম অধ্যায়ের শুরুতেই লেখিকা বংগালের অপরূপ রূপ বৈচিত্রের বর্ননা দিয়েছেন। মোঘল সাম্রাজ্য চলাকালে বাংলার মানুষের জীবনযাত্রাকেও তিনি তুলে ধরেছেন সুনিপুনভাবে। এ পর্বে কাঞ্চি, চনডু আর সিলভেরিয়ার কাহিনীকে দিয়ে এগিয়েছে সময়। সিলভেরিয়া কঞ্চিকে ভালোবাসত। একদিন-তারা দুজনে যখন নিভৃতে আলাপনে মগ্ন তখন আরকান রাজ মোঘল নৌবহরের সহায়তা নিয়ে সেনাদ্বীপে আক্রমন করে। সিলভেরিয়া ছিল নাবিক। তার জাহাজে করে এই এলাকার অনেকে পালাতে গিয়েও পালাতে পারল না। সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়ে ছিন্নভিন্ন হল জাহাজ। সিলভিয়া এবং কঞ্চি একটি কাঠের খুটি ধরে বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টা চালালো। জলরাশি তাদের নিয়ে গেল কোনও এক তীরে। মরতে মরতে বেঁচে গেল তারা। ফাদার ম্যনরিকের বদান্যতায় ধর্মান্তরিত হয়ে সেখানেই আলোর ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করল। কিন্তু যে পদ্ধতিতে ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়া চলছিল তাতে সিলভিয়া কঞ্চি দুজনেরই হৃদয়ে রক্তক্ষণ হচ্ছিল। একদিন ব্যাপটাইজডের জন্য নিয়ে আসা অসংখ্য বন্দিকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিল সিলভিয়া এবং কঞ্চি। বন্দিরা তাদের সহায়তায় পালিয়ে গেল। কিন্তু পালাল না তারা। এই অপরাধের শাস্তস্বরূপ মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয় তাদের।
অন্যদিকে, জাহাংগীরনগরে মুদি দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল চ-। তার ছেলে মানিকের ইচ্ছে ছিল সৈনিক হওয়ার, হতে পারেনি। কিন্তু বাহারী কারুকাজে পারদর্শী হয়ে উঠে সে। একই এলাকার বংশীর সাথে প্রথমে সখ্যতা এবং পরবর্তীতে তা প্রেমে রূপলাভ করে। এর কারণও ছিল। একবার যগ দস্যুদের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে মন্দিরের দিঘীতে ঝাপ দেয় বংশী। সেখান থেকে তাকে যখন উদ্ধার করা হয় তখন জ্ঞানশূন্য অবস্থায় পড়ে ছিল সে। তাকে মাথায় তুলে ঘুরিয়ে পেট থেকে পানি বের করে বাঁচিয়েছিল মানিক।
দিল্লীর শাহানশাহ শাহজাহান প্রিয়তমা সম্রাজ্ঞী মমতাজের মৃত্যুতে যে প্রাসাদ গড়ে তুলেন সেখানে শিল্পী হিসেবে কাজের জন্য ছুটে যায় মানিক। কাজ শেষে ফিরে নিজ দেশে এসে দেখে বংশী নেই। পুণরায় সে চলে যায় জাহাংগীরনগরে। শাহজাদীর এক বাদীর সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে তার। গুলরুক তার প্রেমে এতটাই দেওয়ানা হয় যে শাহজাদীকে বুঝিয়ে তাকে নিয়ে চলে আসে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে বংগালে।
দুর্ভিক্ষের কারণে মানিকের জীবনের শেষ কটা দিন কেটেছে নিদারুণ বেদনায়। স্ত্রী গুলরুখ সন্তানদের ক্ষুদার জ্বালা সইতে না পেরে তাদেরকে হত্যা করে এবং এক পর্যায়ে মানিককেও গলাটিপে খুন করে। অভুক্ত অবস্থায় তারও প্রাণপাখি উড়ে যায়।
দুর্ভিক্ষে ভয়াবহতার চিত্রই মূর্ত হয়েছে আলোচ্য অধ্যায়ে। খিদে মানুষের মনুষত্বকে কীভাবে বিনষ্ট করে এবং তা- যে প্রবহমান রয়েছে কাল থেকে কালান্তরে সে বিষয়টি আমাদের ভাবনার জগৎকরে বেদানাচ্ছন্ন করে। যার জন্য রাজপ্রসাদের সুখ ছেড়ে চলে এসেছিল গুলরুখ, তাকেই সে হত্যা করে। আরেকটি বিষয় কাজ করেছে এর পেছনে। নিজ খিদে নিবৃত করতে মানিক যদি তাকে ও সন্তানদেরকে বিক্রি করে দেয়? উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রিয়তমাকেও সে আর বিশ্বাস করতে পারে না।
‘ছেলে ঘুমাল, পাড়া জুরাল, বর্গী এল দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে?-এই বর্গীদের আগ্রসন, প্রভাব বিস্তার, কৃষকদের নীল চাষ করার জন্য উৎপীড়ন, নারী নির্যাতন এবং সর্বশেষ চাষীদের বিদ্রোহী হয়ে উঠার কথা যেমন নবম অধ্যায়ে বিবৃত হয়েছে তেমনি তুলে ধরা হয়েছে বাংলার সর্বশেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের আখ্যান। মীরজাফরের বিশ্বাস ঘাকতরার কথাও বর্ণিত হয়েছে এ পর্বে।
কৃষক আছিম উদ্দিনের আশ্রয়ে বেড়ে উঠা হারু-ই এ পর্বের অন্যতম চরিত্র। নীলকরদের অন্যায় অবিচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে কৃষকদের সে বিদ্রোহী করে তোলে। তাদের কাছে মূর্তিমান আতংকে পরিণত হয় সে। বিদ্রোহ দমাতে জমিদারদের সহায়তায় তাকে হত্যা করা হয়। এই নীলকরদের একজন ফারলং তার মেয়েকে ব্রিটেন থেকে নিয়ে এসেছিল নিজের বাহাদুরী দেখাতে। বারবারার ভালো লেগেছিল এই দেশ। তার পেছনে অবশ্য অন্য একটি কারণও ছিল। নীলকুঠির ছোট সাহেব রেনীর প্রেমে তখন হাবুডুবু খাচ্ছিল বারবারা। কিন্তু একদিন ফারলং ও রেনীকে জোরপূর্বক এক অসহায় নারীর উপর পাশবিকতা চালাতে দেখে ব্রিটেনে পাড়ি জমায় সে। সেখানে গিয়ে পত্রিকায় স্বরূপ উন্মোচিত করে নীলকরদের। দাদনের জন্য যে কি অসহ্য নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে বংগাল চাষীদের, তাও তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে।
এ পর্বে ব্রিটিশ শাষনের বিভৎসরূপ আঙুল দিয়ে আরেকবার দেখিয়ে দিয়েছেন লেখিকা। যে ব্রিটিশরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করে, এককালে তাদের স্বরূপ কেমন ছিল সেটাই আমরা অবলোকন করি আরও একবার রিজিয়া রহমানের বদৌলতে। শুধু সম্পদ লুণ্ঠন ও শ্রমিকদের নির্যাতনই নয়, নারী দেহের প্রতিও কতটা উন্মত্ত ছিল তারা তা আবারও মনে করিয়ে দিলেন লেখিকা।
দশম পর্বটি অর্থাৎ শেষপর্বটি আবশ্যিকভাবে দেশভাগ এবং পাকিস্তান নামক উদ্ভট ঘোরার পিটে চড়া দেশের কথা উঠে এসেছে। সাবের সাহেবের ছেলে আনোয়ার, তার স্ত্রী জমিলা এবং তাদের সন্তান মিন্টুকে ঘিরে বহুবর্নিল হয়েছে কাহিনীর ডালপালা।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্রদের রাজপথে নামা; মায়ের ভাষার দাবিতে প্রাণ বিসর্জনের পথ ধরেই বাংলা নামের দেশের পথে অগ্রসর হয়েছে লেখকের শব্দমালা। পাকিস্তানের শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা আর নির্যাতনে এক সময় অনিবার্য হয়ে ওঠে মুক্তির সংগ্রাম। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেও ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিরা নিতে থাকে যুদ্ধের প্রস্তুতি। পচিশে মার্চ রাতে ঘুমন্ত বাঙালীদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে হায়নারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, কোয়ার্টারে ঢুকে ঢুকে হত্যা করতে থাকে মেধাবী সন্তানদের। পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্তির জন্য স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন বঙ্গবন্ধু। শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ। বিদেশ ফেরত আনোয়ার হোসেনের ছেলে মিন্টুও ঝাপিয়ে পড়ে যুদ্ধে। একদিন নিজ এলাকা শক্রমুক্ত করে সে স্বাধীনতার পতাকা উত্তলন করে। প্রিয়তমা রমিজাকে দেওয়া কথা রাখে সে। কিন্তু যুদ্ধে তার মা বাবা দুজনেই শহীদ হন। আর প্রিয়তমা রমিজা হয় নির্যাতিত। কিন্তু অগনিতের আত্মাহুতি আর অসংখ্য রমিজার বেদনাগাথা ভূলে সেদিন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে সবাই। বিজয়ের সেই মহুর্তকে লেখক চিত্রিত করেছেন হৃদয়ের ভাষায়-
‘খালের পার দিয়ে আসমতের সাত বছরের ছেলেটা স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা একটা পতাকা হাতে লাফাতে লাফাতে কচি কণ্ঠে চীৎকার তুলে বাতাসে শিহরণ জাগাল- ‘জয় বাংলা’।
নতুন নাগরিকের শিশু কণ্ঠের খুশীর অনুরণ যেন ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে গঞ্জে শহরে নগরে। মিন্টু এসে দাঁড়াল আসমতের ঘরের দরজায়। ঘরের মধ্যে মাথা গুঁজে বিড়বিড় করছিল রমিজা। অসহ্য বেদনার্থ দৃষ্টি নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল সে। বুকের বেদনার অনুভূতিটা ঢেউ জাগা পুকুরের পানির মত কাঁপতে কাঁপতে স্তিমিত হয়ে গেল। মিন্টু এগিয়ে এসে দুহাতে রমিজাকে বুকে টেনে নিল। চুলে ঠোঁটে চোখে পাগোলের মত ঠোঁটের স্পর্শ দিতে দিতে বলল-রমি। আমার রমি!
ঘোলা নি®প্রভ চোখে তাকাল রমিজা। অর্থহীন নির্বাক দৃষ্টি। দুজনেই তাকিয়ে রইল। মিন্টুর চোখ বলল-চেয়ে দেখো রমি। আমি তো মা-বাবা সবাইকে হারিয়েছি। তুমিও হারিয়েছে। তবু আমরা দুজনেই আছি। আমরা থাকব।’
…‘মিন্টুর রমিজা একটা হাত ধরল-আমরা তেমনি সব হারিয়ে নতুন গড়ার আকর্ষণে সেই নদীর ধারে বিলের পারে এসে দাঁড়িয়েছি। চল রমি নীচের ভেজা ওই মাটির বুকে এই মুক্তদেশে মুক্ত আকারশের নীচে দুজোড়া পায়ের ছাপ এঁকে দিই।
রমি কথা বলল না। শুধু হাসল। হাত ধরাধরি করে ভেজা মাটিতে দুজোড়া পায়ের ছাপ এঁকে ওরা দাঁড়াল পানির ধারে। গোধূলির সোনালী আভা যেন গৌবের আবির ছড়িয়ে দিল দুটি মানব-মানবীর ওপর, যেমন দিয়েছিল হাজার হাজার বছর আগে।’ (পৃ. ২৯২-২৯৪ )
এভাবেই রূপান্তর ঘটে বং থেকে বাংলাদেশের। বিশ্বের বুকে মাথা উচু করে দাঁড়ায় প্রিয় জন্মভূমি, বাংলাদেশ। আমরা অর্জন করি একটি মানচিত্র, একটি পতাকা। এই অর্জন বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের মহত্তম অর্জন। সেই অর্জনের ইতিহাস কতটা দীর্ঘ তারই রূপরেখা তৈরির চেষ্টায় নির্মিত হয়েছে এ উপন্যাস। বিগত সময়কেই রিজিয়া রহমান এখানে নির্মান করেছেন নান্দনিকতায়। উপন্যাসের ব্যবহৃত ভাষা এবং তাঁর বাক্য বুননের কৌশল আমাদের ভাবনার ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করে। সেইসাথে ভাবাবেগ তৈরিতেও ভূমিকা রাখে। ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসে একদিকে যেমন ইতিহাসের মহাসমুদ্র অবগাহন করতে আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে ঠিক তেমনি ভাবনার সাগরেও সাঁতার কাটার আহ্বান জানায়। এখানেই লেখকের স্বার্থকতা।
সহজে, গল্পচ্ছলে বাঙালির ইতিহাস জানতে হলে রিজিয়া রহমানের ‘বং থেকে বাংলা’ অবশ্য পাঠ্য বলে মনে করি। একজন লেখক তখনই সময়কে অতিক্রম করে, কাল থেকে কালান্তরে এবং মহাকালের ইতিহাসে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সক্ষম হন, যখন তার লেখনি হয় সত্যাশ্রয়ী। রিজিয়া রহমান সে পথ ধরেই হেটেছেন। তাইতো, বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে ঠাই করে নিয়েছে ‘বং থেকে বাংলা’। যা বেঁচে থাকবে অনেক অনেক কাল।